বিদ্যুতের বিল ২০ টাকা! অবিশ্বাস্য মাটির বাড়ি বানিয়ে তাক লাগিয়েছেন এই ইঞ্জিনিয়ার

Eco Friendly Mud House: বাড়িটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে দিনের বেলায় প্রাকৃতিক আলো পুরো বাড়িকে ঝলমল করে তোলে, তাই বিদ্যুৎ খরচও কমিয়ে দেয়।

চাঁদি ফেটে যায় না, সারাক্ষণ মেজাজও তিরিক্ষি হয়ে থাকে না। বরং প্রচণ্ড দাবদাহে বাড়ি যেন একখণ্ড ইগলু! অথচ নেই কোনও এসি, নেই কুলার। বিদ্যুতের বিল আসে মাসে ২০ টাকা! অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমনটা বাস্তবে ঘটিয়েছেন জেগাথিসান। তাঁর গ্রামে ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর আর চোখে পড়ে না তেমন। কোথাওই কি আর তেমন দেখা মেলে? সর্বত্রই মাটির বাড়ি ভেঙে উঠছে পাকা উন্নয়ন। মাটির বাড়ির এই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া দেখে অবাক হয়েছিলেন জেগাথিসান। একটিও গাছ না কেটে মাটির ইটের তৈরি বাড়ি গড়েছেন তিনি। পুনর্ব্যবহৃত কাঠ এবং না পোড়ানো ইট ব্যবহার করে যে বাড়িটি তিনি গড়েছেন, সেখানে বিদ্যুতের বিল আসে ২০ টাকা! হ্যাঁ, স্রেফ ২০ টাকা!

তামিলনাড়ুর এক ছোট্ট গ্রাম আন্নামঙ্গলামের জেগাথিসান এ এসি ছাড়াই মাটির ইটের বাড়ি গড়ে অবাক কাণ্ড ঘটিয়েছেন। পেশায় নিজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার তিনি। নিজের গ্রামে মাটির ঘর ভেঙে কংক্রিটে পরিণত করার চেষ্টা দেখেই উপলব্ধি করেন, গ্রামের বেশিরভাগ ঐতিহ্যবাহী মাটির বাড়িগুলি দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। “আমিও কংক্রিটের ঘর তৈরি করছি, তবে এই বিশেষ ঘটনাটি আমাকে গ্রামের বাড়ির রূপান্তর সম্পর্কে ভাবিয়েছে, একসময় মাটির বাড়িতে ভর্তি ছিল গ্রাম। আজ, এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলির প্রায় ৯০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সেই কারণেই আমি আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসাবে এটিকে সংরক্ষণ করতে এবং মাটির বাড়ি যে কংক্রিটের বিল্ডিংয়ের মতোই শক্তিশালী তা প্রমাণ করার জন্য নিজেরাই একটি মাটির বাড়ি তৈরি করার কথা ভেবেছিলাম,”দ্য বেটার ইন্ডিয়াকে জানিয়েছেন জেগাথিসান৷

আরও পড়ুন- বৌদ্ধ ধর্মেই লুকিয়ে পরিবেশ বাঁচানোর মূল মন্ত্র? কী বলছে গবেষণা

জেগাথিসান প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বাড়ি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। স্বপ্নের বাড়ির নাম রেখেছেন ‘থাইমান ভিদু’ (তামিল ভাষায় যার অর্থ মাতৃ পৃথিবী)। বাড়িটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং পুনর্ব্যবহৃত কাঠ এবং ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। প্রায় ১ বছর লেগেছে এই বাড়ি নির্মাণে এবং খরচ হয়েছে ২০ লক্ষ টাকা। তবে কীভাবে মাটির ঘর তৈরি করতে হবে, তা আদৌ টেকসই হবে কিনা, বিষয়টা নিয়ে বেশ অনিশ্চিত ছিলেন জেগাথিসান। মাটির ঘর তৈরির আগে সমস্ত সুবিধা এবং অসুবিধাগুলি বোঝার জন্য পুদুচেরির অরোভিল আর্থ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি।

সেখানেই তিনি শেখেন কীভাবে কম্প্রেসড স্ট্যাবিলাইজড আর্থ ব্লক (CSEB) বা আনফায়ারড ব্রিকস এবং আর্চ ভল্ট ডোম (AVD) তৈরি করতে হয়। এই ইনস্টিটিউটে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে প্রায় এক বছর কাটান তিনি। শেখেন মাটির ইট তৈরি, লাল মাটির ব্যবহার। জেগাথিসান জানান, না পোড়ানো ইট দীর্ঘস্থায়ী এবং অত্যন্ত টেকসই। “আনফায়ারড মাড ব্লক এবং মর্টার ব্যবহার করার সবচেয়ে ভালো দিকটি হলো দেওয়াল শ্বাস নিতে পারে। তারা গ্রীষ্মে ঘর ঠান্ডা রাখে এবং শীতকালে গরম রাখে। সুতরাং, আমাদের বাড়িতে এসি নেই এবং আমাদের বেশিরভাগ সময় ফ্যানেরও প্রয়োজন হয় না,” জেগাথিসান বলেছেন।

খিলানযুক্ত এবং গম্বুজ-আকৃতির ছাদ তৈরি করেছেন জেগাথিসান। ধাতু এবং সিমেন্টের ছাঁচের ব্যবহার কমানোর জন্য ওই একই উপাদান থেকে তৈরি একটি মর্টার ব্যবহার করে না পোড়ানো ইটগুলি ব্যবহার করেন। বৃষ্টির জল সংগ্রহের জন্য ২০,০০০-লিটার ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ট্যাঙ্কও বসিয়েছেন তিনি এবং ছাদে বাগানও গড়েছেন৷ মূল শোওয়ার ঘরে ফেরোসমেন্ট (তারের জাল এবং সিমেন্ট মর্টার দিয়ে তৈরি সামগ্রী) দিয়ে একটি মঞ্চ তৈরি করেছেন এবং কাঠের আসবাবপত্র কমাতে গদি পেতেছেন জেগাথিসান।

আরও পড়ুন- স্রেফ আলু দিয়েই মঙ্গলে তৈরি হবে আস্ত বাড়ি! কেন এমন অদ্ভুত চিন্তা বিজ্ঞানীদের?

বাড়িটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে দিনের বেলায় প্রাকৃতিক আলো পুরো বাড়িকে ঝলমল করে তোলে, তাই বিদ্যুৎ খরচও কমিয়ে দেয়। একটি উঠোন ধরনের জায়গাও রয়েছে যাতে যথেষ্ট আলো আসে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ এতই কম লাগে যে দুই মাসে একবার বিদ্যুৎ বিল আসে, তাও খুব বেশি হলে ২০ বা ৩০ টাকা! তামিলনাড়ু সরকারের ভর্তুকি অনুযায়ী প্রথম ১০০ ইউনিট বিদ্যুৎ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। সেই ১০০ ইউনিটও ছাড়ায় না খুব বেশি, এই মাটির বাড়িতে।

রান্নাঘর এবং বাথরুম সহ পুরো বাড়িতেই অক্সাইডের মেঝে। বাথরুমের দেওয়াল এবং রান্নাঘরের মতো নির্দিষ্ট কিছু জায়গা ছাড়া ঘর প্লাস্টার করার জন্য সিমেন্টও ব্যবহার করা হয়নি। ১০০০ বর্গফুটের দোতলা এই মাটির বাড়িটি একটি গাছও না কেটে তৈরি করা হয়েছে। সমস্ত জানালার ফ্রেম, দরজা ইত্যাদি পুরনো ভেঙে যাওয়া বাড়ির পুনঃব্যবহৃত কাঠ দিয়ে তৈরি। জানালা, গ্রিল এবং রেলিং বারে ব্যবহৃত সমস্ত ধাতুও বিভিন্ন টিনভাঙা লোহা ভাঙা বিক্রেতাদের কাছ থেকে জেগাথিসান সংগ্রহ করেছেন।

দোতলা এই বাড়ির নিচতলায় একটি বারান্দা, একটি থাকার জায়গা, একটি রান্নাঘর এবং একটি সংযুক্ত বাথরুম সহ একটি শোওয়ার ঘর রয়েছে। প্রথম তলায় একটি শোওয়ার ঘর, একটি চিলেকোঠা এবং একটি ছোট ঘর রয়েছে।

More Articles