ঠিক যেন বিদেশ! ভারতের এই জায়গাগুলি হয়ে উঠতে পারে পুজোর গন্তব্য
এই লেখায় আমরা আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব এমন কিছু জায়গার, যা ভারতেই অবস্থিত, কিন্তু এইসব জায়গা ভ্রমণে স্বাদ পাবেন বিদেশের। তাই ভারতের মধ্যে থেকে কোনও পাসপোর্ট ছাড়াই বিদেশ ভ্রমণের আনন্দ নিতে পারবেন।
মানুষ কীসের টানে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ায়? তার নতুন কিছু জানার আর শেখার ইচ্ছে বরাবরের। প্রাচীনকালে আগুন আবিষ্কারের পর থেকে তার জ্ঞানের পরিধি যেন প্রসারিত হচ্ছে দিন দিন। আর ভ্রমণের নেশা তো মানুষ পাখিদের থেকে আয়ত্ত করেছে। পাখিদের পরিযায়ী স্বভাবের মতো মানুষও তার নিজস্ব দমবন্ধ পরিবেশ থেকে কিছু সময়ের জন্য মুক্তি খোঁজে।
ভারতে কত না বৈচিত্র্য। তাই ভ্রমণপিপাসুরা দেশ ভ্রমণই শেষ করে উঠতে পারেন না। কোভিডের কড়াকড়ি হোক বা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বছরে একবার হলেও সকলেই ভ্রমণে বের হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদেশ ভ্রমণ না করলে অনেকের মনের আশ মেটে না। তাই একবার হলেও বিদেশ ভ্রমণ চাই-ই চাই। কিন্তু ভারতের মতো দেশে সকলের পক্ষে বিদেশ ভ্রমণ সম্ভব নয়। কিন্তু তাতে মন খারাপ করার কিছু নেই। এই লেখায় আমরা আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব এমন কিছু জায়গার, যা ভারতেই অবস্থিত, কিন্তু এইসব জায়গা ভ্রমণে স্বাদ পাবেন বিদেশের। তাই ভারতের মধ্যে থেকে কোনও পাসপোর্ট ছাড়াই বিদেশ ভ্রমণের আনন্দ নিতে পারবেন।
দেবঘালি বীচ এবং রেইলে বীচ
মহারাষ্ট্রের রত্নাগিরিতে অবস্থিত দেবঘালি সমুদ্রসৈকত। এই বিচটি নির্জন এবং শহরের কোলাহল থেকে দূরে অবস্থিত। শহরের কোলাহল দূরে বলে এখনও অনেকেই এই সমুদ্রসৈকত সমন্ধে সেভাবে জানে না। তবে, যদি আপনি একান্তে কিছু সময় কাটাতে চান, তাহলে চলে যেতে পারেন। সাদা বালি, ক্রিস্টাল ব্লু ওয়াটার, লাইমস্টোন দিয়ে তৈরি পাহাড়, পাহাড়ের মধ্যে তৈরি গুহা- সবকিছু যেন এক অজানা দেশের সন্ধান দেয়।
আরও পড়ুন: পাড়ি জমিয়েছিল কলকাতা থেকে লন্ডন, শতবর্ষের দোরগোড়ায় এসেও তরতাজা বেবি অস্টিন ৭
সাদা বালিতে পা দিয়ে বসে প্রকৃতির কোলে মনোরম আবহাওয়ায় মুক্ত শ্বাস নিতে নিতে চলে যাবেন এক অজানা স্থানে। এই সমুদ্র সৈকতটি তিনদিক থেকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। তবে, এখানেই শেষ নয়। এই সমুদ্র সৈকতের সঙ্গে আপনি থাইল্যান্ডের রেইলি সমুদ্র সৈকতের মিল খুঁজে পাবেন। দুটি সমুদ্র সৈকতই একটু নির্জন এবং তিনদিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা।
গুরুদংমার লেক, সিকিম– জোকুলসার্লন লেক, আইসল্যান্ড
সিকিমে অবস্থিত এই গুরুদংমার লেক বিশ্বের সবথেকে উচ্চতম লেকের মধ্যে অন্যতম। এর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, শীতকালেও এই লেকে কখনও বরফ জমে যায় না। লেকের জল যেমন থাকার, ঠিক সেইরকমই থাকে। অতি ঠান্ডাতেও তা জমে বরফ হয় না।
এই লেকের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, চারদিকে বিভিন্ন পাহাড় দিয়ে পরিবেষ্টিত হওয়ার কারণে সবসময় এই লেকের জলে সেইসব পাহাড়ের স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব চোখে পড়ে, যা আপনার চোখকে এক অনন্য শান্তি এনে দেবে। এই লেকের মতোই দেখতে আরেকটি লেক হলো আইসল্যান্ডের জোকুলসার্লন লেক। আইসল্যান্ড যেতে না পারলেও ভারতেই আইসল্যান্ডের স্বাদ অনুভব করে নিন।
জল মহল, জয়পুর– ট্রাকাই ক্যাসেল, লিথুয়ানিয়া
১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল এই জল মহল বা জলের নিচের প্রাসাদ। জয়পুরে অবস্থিত এই প্রাসাদকে বিশ্বের সেরা রাজপুত এবং মুঘলদের স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তিনদিকে পাহাড় আর তার মাঝে ছয় কিমি লম্বা বিশাল নীল জলের হ্রদ। মহল থেকে হ্রদে নামার অনেক সিঁড়ি আছে। সবুজ পাহাড়ের গায়ে হলুদ রঙের এই মহল নজরকাড়া। এই প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন মাধু সিংহ, শিকার করার প্রয়োজনে। প্রাসাদটি দেখলে একতলা বলে মনে হলেও আসলে তা পাঁচতলা-বিশিষ্ট।
৪টি তল বছরের বেশিরভাগ সময় জলের নিচে থাকে বলে সবথেকে ওপরের তলই দেখা যায়। তবে জল মহলের রাতের দৃশ্য অপূর্ব। চারদিকে বাতাসে বয়ে চলা শান্তি আর স্থিরতা যেন এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশের জন্ম দেয়। টলটলে নীল জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক অতি-প্রাচীন প্রাসাদ সময়ের সাক্ষ্য বহন করে চলছে। এই প্রাসাদের অনুরূপ প্রাসাদ আপনি দেখতে পাবেন লিথুয়ানিয়ার ট্রাকাই ক্যাসেলে।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স, উত্তরাখণ্ড– অ্যান্টেলোপ ভ্যালি, ক্যালিফোর্নিয়া
সৌন্দর্যের ডালি মেলে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স মানুষকে আহ্বান করছে। বর্ষাকালে ভারতে উত্তরাখণ্ডে বসে ফুলের জলসা। যোশিমঠ থেকে ২০ কিমি দূরে ঘানঘারিয়া থেকে এই ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-এর এলাকা শুরু। স্থানীয় মানুষদের ভাষায় ‘ফুলো কি ঘাঁটি’, সেই ফুলের উপত্যকায় ৫০০ প্রজাতির ফুল ফোটে।
আবার অনেক স্থানীয় মানুষের মতে, হনুমান এই স্থান থেকেই সঞ্জীবনী বটিকা নিয়ে গিয়েছিল রামের ভাই লক্ষ্মণের জীবন বাঁচানোর জন্য। এই উপত্যকায় ফুলের পাশাপাশি বিভিন্ন ঔষধির গাছও আছে– বিরচ, রডোডেনড্রন এবং ব্রহ্মকমল। শুধু তাই নয়, মাস্ক ডিয়ার এবং রেড ফক্স-সহ বিভিন্ন প্রাণীরও দেখা পাওয়া যায়। হিমালয়ের তুষারমণ্ডিত পর্বতের কোলে অবস্থিত এই ফুলের উপত্যকা স্বর্গ দর্শনের সামিল। বর্ষাকালে ফুলের বাহার যেন আরও খিলখিলিয়ে ওঠে। মনে হয়, উপত্যকায় কেউ যেন নানা রঙের পোঁচ ঢেলে দিয়েছে।
ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-এর মতো ফুলের উপত্যকা দেখা যায় অ্যান্টেলোপ ভ্যালি, ক্যালিফোর্নিয়ায়।
হাম্পির ধ্বংসস্তূপ– রোমের ধ্বংসাবশেষ
কর্নাটকে অবস্থিত হাম্পি যেন প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এটি একটি ইউনেসকো হেরিটেজ সাইট। বলা হয়, হাম্পির ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে রোমের ধ্বংসাবশেষের মিল থাকলেও হাম্পির নিদর্শন আরও মোহময়ী। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ‘লিস্ট অফ প্লেসেস টু গো ইন ২০১৯’-এ হাম্পি দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী।
তুঙ্গভদ্রার তীরে অবস্থিত হাম্পি একটি কয়েনের দুটো পীঠের মতো। একদিকে ধ্বংসাবশেষ, অন্যদিকে হিপি আইল্যান্ড। হাম্পি যেন খোলা আকাশের নিচে ছড়িয়ে থাকা শিল্পের এক সংগ্রহশালা।
কুতুব মিনার, দিল্লি– লিনিং টাওয়ার অফ পিসা, ইতালি
ঐতিহাসিক স্থাপত্যের দিক থেকে ভারতের স্থান অনন্য। ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত কুতুব মিনার বিশ্বের সর্বোচ্চ ইট দিয়ে নির্মিত মিনার। লাল বেলেপাথরে তৈরি এই মিনারের উচ্চতা প্রায় ৭২.৫ মিটার (২৩৮ ফুট)। কথিত আছে, একাধিক হিন্দু ও জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে এই মিনার নির্মিত হয়েছে। ইসলামিক স্থাপত্য ও শিল্পকলার বদান্যতায় ইউনেসকো হেরিটেজের তালিকায় তার নামও যুক্ত আছে।
দিল্লির কুতুব মিনার এবং ইতালির লিনিং টাওয়ার অফ পিসা, দুইয়ের মধ্যে প্রচুর মিল পাওয়া যায়, যেমন, এই দু'টি স্থাপত্যই ৬ তলাবিশিষ্ট এবং দুটো স্থাপত্যরই নির্মাণ কাজ ১১ শতকে শুরু হয়ে ১৩ শতকে শেষ হয়। অন্যদিকে, দু'টি স্থাপত্যই আরেকটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যের সঙ্গে সংযুক্ত। কুতুব মিনার, আলাই দরওয়াজা-সংলগ্ন, আবার লিনিং টাওয়ার অফ পিসা, পিসা ক্যাথিড্রালের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
খাজ্জার, হিমাচল প্রদেশ– সুইজারল্যান্ড
সুইজারল্যান্ডের সবুজঘেরা উপত্যকা আর তুষারমাখানো পর্বতের সঙ্গে বিশ্বের আর কোনও জায়গার কোনও তুলনাই করা যায় না। কিন্তু ভারতে এমন কিছু স্থান আছে, যেখানে গেলে আমরা সুইজারল্যান্ডের এই অনন্ত বিস্ময়ের স্বাদ নিতে পারব।
সুইজারল্যান্ডকে তাই স্বাভাবিকভাবে হিমাচলের খাজ্জারের সঙ্গে তুলনা করা যায়। হিমাচলের কোলে অবস্থিত খাজ্জারকে ‘ভারতের সুইজারল্যান্ড’ বলা হয়। খাজ্জারকে ‘পাহাড়ো কি মালিকা’ বলেও সম্বোধন করা হয়ে থাকে। পর্যটকদের জন্য আছে ট্রেকিং এবং প্যারাগ্লাইডিং-এর ব্যবস্থা। শীতকালে গেলে মনে হবে সুইজারল্যান্ডেই চলে এসেছেন।
পন্ডিচেরি– বুরানো
দক্ষিণ ভারতের এক অপূর্ব ছোট্ট শহর পন্ডিচেরি বা পুদুচেরি। শহরটি ছিমছাম হলেও বৈচিত্র্যময়। বহু প্রাচীন সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে। ভারতের মধ্যে ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার বললে পুদুচেরির কথাই আগে আসবে। ভারতের অন্যান্য শহরের তুলনায় এখানকার মানুষের জীবনধারা একটু ভিন্ন।
হোম-কুকড ফ্রেঞ্চ ফুড, বাগড়ু প্রিন্টের ডিজাইন আর কমিউনিটি লিভিং- এই নিয়েই পুদুচেরি। শহরের রাস্তা, অলিগলি, বাড়ি- সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ফরাসি স্থাপত্য। শহরজুড়ে এক মায়াময় নাগরিকতা। পুদুচেরির এই ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের সঙ্গে ইতালির বুরানোর অনেক মিল পাওয়া যায়।
চেরি ব্লসম, শিলং– চেরি ব্লসম, জাপান
জাপানের চেরি ব্লসমের জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে যে, বিশ্বের প্রায় সব দেশই মাউন্ট ফুজি-র এই পিঙ্ক চেরি ব্লসমের কথা জানে। কিন্তু আপনি কি জানেন, ভারতেও চেরি ব্লসম আছে। মিড নভেম্বরে আপনি যদি শিলং ঘুরতে যান, তাহলে দেখতে পাবেন, চারিদিকে অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়ান পিঙ্ক চেরি ব্লসম।
দূর থেকে দেখলে মনে হবে, কোনও এক শিল্পী তাঁর ক্যানভাসে তুলির ছোঁয়ায় পুরো শহরকে জীবন্ত করে তুলেছেন। স্থানীয় মানুষের কথায়, এই চেরি ব্লসম হিমালয়ের উপহার।
বির বিলিং, ইন্ডিয়া– মঁ ব্লাঙ্ক, ফ্রান্স
প্যারাগ্লাইডিং কথার সঙ্গে আমরা আজ অল্পবিস্তর জানি। যাঁরা অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী, তাঁদের কাছে এই শব্দ নস্যি। বিশ্বের সবথেকে উঁচুতে অবস্থিত মঁ ব্লাঙ্ক প্যারাগ্লাইডিং-এর শ্রেষ্ঠ জায়গা। কিন্তু সকলের তো আর ফ্রান্স গিয়ে প্যারাগ্লাইডিং করার মতো সামর্থ্য নেই। তাতে মনখারাপ করার দরকার নেই, খোদ ভারতেই আছে বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম প্যারাগ্লাইডিং সাইট।
বির বিলিংকে প্যারাগ্লাইডিং প্যারাডাইজও বলা হয়ে থাকে। এই বির বিলিং-এ বিভিন্ন উৎসাহী মানুষ একজন দক্ষ ট্রেনারের থেকে প্যারাগ্লাইডিং-এর শিক্ষা নিতে পারেন। শ্রেষ্ঠ এক্সপেরিয়েন্সের জন্য মার্চ থেকে জুন মাসে যাওয়া ভালো।
বৈচিত্র্যময় এই ভারতের আমরা আর কতটুকুই বা জানি। আরও কত অজানা জায়গা হয়তো এই ভারতে ছড়িয়ে আছে।