যৌনাঙ্গে নৃশংস কোপ, তবু যেভাবে বেঁচে থাকে নারীর কামনা
যৌনাঙ্গের বিভিন্ন অংশ কেটে ফেললে, মেয়েটি যে কেবল যৌন সুখ থেকে বঞ্চিত হয়, এমনই নয়। যৌনস্বাস্থ্য, সার্বিক স্বাস্থ্য, বৈবাহিক জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে খুব অদ্ভুত একটি সামাজিক প্রথা এখনও প্রচলিত আছে। সেই প্রথা অনুযায়ী মেয়েদের যৌনাঙ্গের ক্লিটোরিস আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে কেটে ফেলা হয়, কোথাও কোথাও বা ক্লিটোরিসের পাশাপাশি লেবিয়া মেজোরা অংশটিকেও কেটে বাদ দেওয়া হয়। আবার কোনও অঞ্চলে ক্লিটোরিস, লিবিয়া মেজোরা, লিবিয়া মাইনোরা- পুরো অংশটিকেই কেটে বাদ দেওয়া হয়। আরও একটি ব্যপার করা হয় কোথাও কোথাও- সেক্ষেত্রে যোনির মুখ পুরোপুরি সেলাই করে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এই পুরো পদ্ধতিটি মেয়েটিকে অজ্ঞান না করিয়েই করা হয় এবং এর কোনও বৈজ্ঞানিক বা ডাক্তারি উপযোগিতা নেই। রীতি অনুযায়ী বিয়ের পর সেই বন্ধ যোনির ভেতরে লিঙ্গ প্রবেশ করিয়ে মেয়েটির স্বামী যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ভাবে যৌনতায় লিপ্ত হলে মেয়েটিকে কী পরিমাণ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়।
আফ্রিকাতে এটি কোনও ধর্মীয় প্রথা নয়, এটি একটি সামাজিক প্রথা, যেটি মুসলিম, খ্রিশ্চান, অ্যানিমিজ়ম সমস্ত ধর্মেই প্রচলিত। তবে অন্যান্য দেশে মুসলিমদের মধ্যেই সবথেকে বেশি এই প্রথা প্রচলিত। কেবল আফ্রিকা নয়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই প্রথা প্রচলিত ছিল। ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত, কলম্বিয়া, এবং মালেয়শিয়ায় এই রীতি আজও প্রচলিত। ভারতে বোরা সম্প্রদায়ের (শিয়া মুসলমান) মধ্যে এই রীতি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে।
আরও পড়ুন: একই মানুষের বহু যৌনসম্পর্কে আগ্রহ, কেন এমন হয়!
এই প্রচলনে বিশ্বাসী যারা, তারা প্রচার করে মেয়েদের যৌনাঙ্গ অপবিত্র এবং তা কেটে ফেললেই মেয়েটি সমাজ ও ধর্মের চোখে পবিত্র হয়ে যাবে এবং সমাজে মেয়েটি ও তার পরিবারের সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। কিন্তু আদতে এর কারণ অন্য। এই প্রচলনে বিশ্বাসী যারা, তাদের ধারণা, এই ভাবে মেয়েদের সতীত্ব রক্ষা করা যাবে; তার স্বাভাবিক যৌন চাহিদা, ইচ্ছা, যৌন আকাঙ্ক্ষা দমন করা যাবে।
সমাজ নারীদের পবিত্রতা বিচার করে এসেছে তার কুমারীত্ব দিয়ে, তার সতীত্ব দিয়ে। তার শরীর, তার কুমারীত্বই যেন হয়ে উঠেছে তার একমাত্র পরিচয়। তাই সমাজ নিদান দিয়েই দিয়েছে, বিবাহ-পূর্ববর্তী যৌনতায় সে লিপ্ত হলে সে পতিতা; সে ধর্ষিতা হলে তার জীবন শেষ। তাই তার যৌনাঙ্গের কিছু অংশ কেটে বাদ দিয়ে দিলে, সে পবিত্র বলে গণ্য হয় সমাজের চোখে।
কিন্তু যৌনাঙ্গের একাধিক অংশ বাদ দিলে কেন একজন মহিলার যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যায়? কেন সে যৌন সুখ থেকে বঞ্চিত হয়?
ক্লিটোরিস, লিবিয়া মেজোরা, লিবিয়া মাইনোরা এবং যোনির বিভিন্ন অংশে রয়েছে একাধিক ছোট ছোট জায়গা, যে অংশগুলি তার যৌন উদ্দীপনা বাড়িয়ে তোলে। ঠিক এই জায়গায় থাকে লক্ষ লক্ষ নার্ভ এন্ডিং বা নার্ভের প্রান্ত, যেগুলি যৌন উত্তেজনা বোধে মহিলাদের সাহায্য করে। যে কোনও স্পর্শে উদ্দীপিত হতে পারে এই ছোট ছোট জায়গাগুলি। আর তারপর হয় অর্গাজ়ম, যখন যৌনসুখ সর্বোচ্চ স্তরে গিয়ে পৌঁছয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই অনুভূতি অত্যন্ত সুখকর।
অর্গাজ়মের ফলে ডোপামাইন এবং অক্সিটোসিন নামের দু'টি নিউরোহরমোনের ক্ষরণ হয় মস্তিষ্ক এবং একাধিক নার্ভে। ডোপামাইন, যার ডাকনাম 'হ্যাপি হরমোন', সেটি আমাদের আনন্দ পাওয়া, এবং মোটিভেশনের জন্য দায়ী। আবার একটি মানুষের সঙ্গে আরেকটি মানুষের সুস্থ সম্পর্ক স্থাপনেও এই হরমোনের পর্যাপ্ত ক্ষরণ প্রয়োজন। অন্যদিকে, অক্সিটোসিনকে বলা হয় 'ট্রাস্ট হরমোন', যার ক্ষরণে সঙ্গীর প্রতি আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে, ভালবাসা বাড়ে।
যৌনাঙ্গের বিভিন্ন অংশ কেটে ফেললে, মেয়েটি যে কেবল যৌন সুখ থেকে বঞ্চিত হয়, এমনই নয়। যৌনস্বাস্থ্য, সার্বিক স্বাস্থ্য, বৈবাহিক জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
পবিত্রতা বাদ দিলে রইল পড়ে তার যৌন আকাঙ্ক্ষা, যৌন চাহিদা, কাম, উত্তেজনা। তার যৌনাঙ্গের কিছু অংশ বাদ দেওয়ার পর তার আর যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার বাসনা প্রায় থাকে না বললেই চলে। তার স্বাভাবিক যৌন চাহিদা প্রায় মৃত তখন। নারীদের যৌন ইচ্ছা বা চাহিদাকে সব সময় অবদমন করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ও ইউনিভার্সিটি অফ স্যান ডিয়েগোর অধ্যাপিকা, জিন ট্যুয়েঞ্জ লিখেছেন, অবদমনের পিছনে দু'টি তত্ত্ব কাজ করতে পারে, প্রথমটি হল 'মেল কন্ট্রোল থিওরি'। যে তত্ত্ব বা থিওরি অনুযায়ী অনেককিছুর মতো মহিলাদের যৌন চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা- সবই পুরুষ নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করতে চায়। দ্বিতীয় তত্ত্বটি হল, 'ফিমেল কন্ট্রোল থিওরি'।
১৯৯৪ সালে ডেভিড বাস তাঁর লেখা 'ইভোলিউশন অফ ডিজা়য়ার' গ্রন্থে লিখেছেন, প্রথম তত্ত্বটিকে বিবর্তনের লেন্সে দেখলে, পুরুষ নিশ্চিত হতে চেয়েছে যেন তার জিন পরবর্তী প্রজন্মে বাহিত হয়। সেখানে অন্য পুরুষের প্রতি তার পছন্দের নারী আকৃষ্ট হলে এবং সঙ্গমে লিপ্ত হলে, সেই নারীর ডিম্বাণু আর তার ঔরসে নিষিক্ত হবে না।
এই কারণেই ১৯৮৬ সালে স্টিফ্যানি কুন্টজ় এবং পিটা হেন্ডারসন 'ওমেনস ওয়ার্ক, মেনস প্রপার্টি: দ্য ওরিজিনস অফ জেন্ডার অ্যান্ড ক্লাস' গ্রন্থে লিখেছেন, পুরুষ চায় তার পছন্দের নারীর ওপর যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে। সেক্ষেত্রে যদি জোর করে নারীর যৌন চাহিদাকেই কমিয়ে দেওয়া যায়, তার অন্য পুরুষের প্রতি আসক্ত হওয়ার প্রবণতাও কমে যাবে।
অথচ বিবর্তনের নিরিখে দেখলে, পুরুষের কিন্তু কর্ষণের বাসনা কেবল বেশি-ই নয় , একাধিক সঙ্গিনীর প্রতি তার আকর্ষণ থাকার প্রবণতা নারীর তুলনায় অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি। অথচ পুরুষের ওপর সমাজের কোনও লাগাম কোনওকালেই ছিল না।
ডিম্বাণু নিষিক্ত করতে পুরুষের অর্গাজম অত্যাবশ্যকীয়। তার আগেও অত্যাবশ্যক যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হওয়ার জন্য পুরুষের যৌন আকাঙ্ক্ষার জন্ম ও পুরুষের লিঙ্গোত্থান। জীববিদ্যার দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর যৌন আকাঙ্ক্ষা না থাকলে বা অর্গাজম না হলেও তার ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করতে পারে একটি পুরুষ। সেখানে অধিকাংশ পুরুষই ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করল না, নারীর যৌন আকাঙ্ক্ষারও প্রয়োজন আছে, যৌন সুখেরও প্রয়োজন আছে।
এ. এফ ওয়েন্স, ২০২০ সালে তাঁর বই 'সেক্সুয়ালিটি, সোস্যাইটি অ্যান্ড ফেমিনিজ়ম'-এ লিখেছেন, পিতৃতন্ত্র চেয়েছে নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সবরকমভাবে। নারীর যৌনতায় হস্তক্ষেপও সেখানে বাদ যায়নি। মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ও ইউনিভার্সিটি অফ স্যান ডিয়েগোর অধ্যাপিকা, জিন ট্যুয়েঞ্জ লিখেছেন, পুরুষ এমন মহিলাকেই স্ত্রী হিসেবে চায়, যার যৌন চাহিদা কম। যদিও তাতে সেই পুরুষটিরই সমস্যা হবে তাঁর সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হতে, কিন্তু এদিকে মহিলাটির যৌন চাহিদা বেশি হলেও তার ভয় হয়, হয়তো সে অন্য পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হবে। সেক্ষেত্রে সে মহিলাটির যৌন ইচ্ছা দমনকেই শ্রেয় মনে করে।
দ্বিতীয় তত্ত্ব, অর্থাৎ ফিমেল কন্ট্রোল থিওরি অনুযায়ী, মেয়েরা নিজেরাই মেনে নেয় যে, তারা পুরুষের অধীনে এবং নিয়ন্ত্রণে থাকবে। শুধু তাই নয়, অন্য মহিলাদেরকেও বাধ্য করে পুরুষের অধীনে থাকতে। সেখানেও মহিলাদের স্বাভাবিক যৌন ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা খর্ব হয়।
অবশ্য পাঠক প্রশ্ন বলতেই পারেন, গর্ভাধানের জন্যে তো মহিলার যৌন সুখ না পেলেও চলে, তার অর্গাজ়ম না হলেও চলে। হ্যাঁ, ঠিকই। বিবর্তনের লেন্সে দেখলে, গর্ভধারণের জন্য মেয়েদের অর্গ্যাজ়ম হওয়ার কোনও প্রয়োজনই ছিল না। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমাদের শরীরের অপ্রয়োজনীয় অঙ্গগুলির মতো মহিলাদের অর্গাজ়ম বিলুপ্তির পথে যায়নি। সে অপ্রয়োজনীয় হলে, এতদিনে বিলুপ্ত হতো বটে। কিন্তু সে আছে বহাল তবিয়তে। প্রয়োজনে পাড়া জাগানো আওয়াজেই সে ঘরে ঘরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে, যদি না ধারালো ছুরি দিয়ে তাকে স্তব্ধ করা হয়।