খোলনলচে বদলালেই একমাত্র বাঁচতে পারে বাংলা ছবি

Bengali Cinema: কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ? পরিচালকদের সঙ্গে ফেডারেশনের এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত পেরিয়ে কীভাবে ফেরত আসবে সেই সব সোনালি দিন? একান্ত সাক্ষাৎকারে পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য

বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ অন্ধকারে বলে প্রায়শই হইচই পড়ে যায়। কখনও অনুরাগ কাশ্যপের মতো পরিচালকের 'ঘটিয়া' মন্তব্য ঘিরে, তো কখনও ডিরেক্টর-টেকনিশিয়ান সংঘাত। বারবার প্রকাশ্যে এসেছে বাংলা ছবির ভুবনের অন্তঃসারশূন্য চেহারাখানাই। সম্প্রতি পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়ের বাংলাদেশে গিয়ে ছবির শুটিং সেরে আসা মধ্যে দিয়ে যে নিয়মলঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল, তার জন্য তিন মাসের জন্য পরিচালককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সেই নিষেধ ডিরেক্টরস গিল্ড তুলে নিলেও তাতে রাজি হয়নি ফেডারেশন। এমনকী রাহুল মুখোপাধ্যায়ের শুটিংয়ের দিন ভেটো দিয়ে বসেন টেকনিশিয়ানরা। সেই নিয়ে অশান্তি চরমে পৌঁছয়। অনির্দিষ্ট কালের জন্য কর্মবিরতির কথা ঘোষণা করেন পরিচালকেরা। সেই নিয়ে বহু আলাপ-আলোচনাতেও সমাধানসূত্র মেলেনি। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। শুটিংয়ে ফেরেন সকলে। তবে আসল সমস্যা কি মিটল? বাংলা সিনেমার সোনালি দিন ফিরবে কোন পথে? কী মনে করেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য?

সোহিনী: এই যে ফেডারেশনের সঙ্গে পরিচালকদের দ্বন্দ্ব, এর শিকড় ঠিক কোথায়?

প্রদীপ্ত: নিয়মের বেড়াজালটাই আসল সমস্যা। ছবি পরিচালনা করলেও আমি  ডিরেক্টর'স গিল্ডের মেম্বার নই। দীর্ঘদিন গিল্ডের নিয়ম মেনে কাজও করতে হয়নি আমাকে। তবে যেটুকু জানি, নিয়মের কঠিন বেড়াজাল রয়েছে, যেখান পান থেকে চুন খসলেই সমস্যা এসে হাজির হয়। নিঃসন্দেহে ইউনিয়ন বা গিল্ড ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি। বহু ক্ষেত্রেই পারিশ্রমিক পাওয়া, ঠিকঠাক কাজ চলছে কিনা এসব দেখার জন্য যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের একটা অ্যাসোসিয়েশন থাকা প্রয়োজন। যতদূর শুনেছি, যে ওটিটি-টা এখানে আসছিল, তাদের থেকে তিন-চার গুণ টাকা চাওয়া হয়েছে। ফলে তারা ফিরে গিয়েছে। সমস্যা আরও রয়েছে। ধরুন আমি একটা কাজ করব। সেখানে যে ক'জন টেকনিশিয়ানের প্রয়োজন, ততজনকে এখান থেকেই নেব। কিন্তু তার বাইরে কেন বেশি সংখ্যক লোককে জোর করে নিতে হবে? এই সব নিয়মকানুনের কাঠিন্যে প্রোডিউসারেরা পর্যন্ত টাকা ঢালতে ভয় পাচ্ছেন ইদানিং। মাথায় রাখতে হবে, এই মুহূর্তে প্রযুক্তি এতটাই এগিয়ে গিয়েছে, তাতে এখন একটা ছবি আর কলকাতায় এসে বানানোর প্রয়োজন পড়ে না। পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও জায়গায় বসেই একটা ছবি বানিয়ে ফেলতে পারেন যে কেউ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। যখন ফেডারেশন বা গিল্ডের নিয়মকানুনগুলো তৈরি হয়েছিল, তখন প্রযুক্তি এতটা উন্নত ছিল না। ফলে প্রযুক্তির এই এগিয়ে যাওয়ার কথা মাথায় রেখে নিয়মগুলোর পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন বলেই মনে হয়।

আরও পড়ুন: ‘হ্যামলেট’-এর মতোই আমরা প্রত্যেকে চাইছি প্রতিশোধ: কৌশিক সেন

সোহিনী: বাংলা ছবির এই মুহূর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে বলে মনে হয়?

প্রদীপ্ত: আমার মনে হয়, এই মুহূর্তে বাংলা ছবি বা অডিয়ো ভিস্যুয়াল কাজের অবস্থা খুবই খারাপ, কারণ বিনিয়োগ নেই। তার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। প্রথমত তো যাঁরা ছবি দেখবেন, তাঁদের হাতে টাকাপয়সা নেই। কলকাতার প্রায় সমস্ত সিঙ্গেল স্ক্রিনই বন্ধ। মাল্টিপ্লেক্সে আকাশছোঁয়া টিকিটের দাম, যা বাংলা ছবির দর্শকদের থেকে দূরে করে দিচ্ছে ক্রমশ। এদিকে বাংলা থেকে ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে মূলধারার ছবির যে ধারা। মূলধারার ছবি প্রচুর হতে থাকলে আশেপাশের কাজগুলো হতে সমস্যা হয় না। টাকার একটা ফ্লো থাকে। বন্ধুবান্ধবদের থেকে শুনতে পাচ্ছি, অ্যাসিসটেন্ট, ক্যামেরা কেয়ারটেকার, ছবির সঙ্গে জড়িত এমন অনেকেই এই পরিস্থিতিতে পেশা বদলে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ ক্যাব-সার্ভিসে কাজ করছেন, কেউ আবার 'ছোটা হাতি' চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ বা খালাসি হয়ে গিয়েছেন বা মাল তুলছেন। এটাও সত্যি, বহু লোক এমন আছেন, যাঁদের কাছে ফেডারেশনের কার্ড নেই, তাঁরাও কিন্তু কাজ করছেন। কিন্তু সার্বিক কাজের ফ্লো এত কম, যে প্রায় সকলেরই কাজের অবস্থা খারাপ।

সোহিনী: স্বাধীন বাংলা সিনেমার প্রাণ বাঁচানো সম্ভব আদৌ এ সবের মধ্যে থেকে?

প্রদীপ্ত: আমার মনে হয়, খুবই ব়্যাডিকাল পরিবর্তন দরকার। ছবির ভাবনা থেকে শুরু করে নিয়মনীতি, প্রায় সর্বত্রই। হলে গিয়ে সিনেমা কিন্তু কলকাতার বাইরের খুব বেশি মানুষ দেখেনই না। তার একটা কারণ তো অবশ্যই প্রেক্ষাগৃহের অভাব। হয়তো আপনি একটি গ্রামনির্ভর ছবি বানিয়েছেন, তাঁদের হয়তো ছবিটা পছন্দও হবে। কিন্তু তাঁদের কাছে ছবিটা পৌঁছে দেওয়াটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। হয়তো সেই ছবিটা তাঁকে দেখতে হলে দেড় ঘণ্টা বাসজার্নি করে এসে কোনও এক প্রেক্ষাগৃহে আসতে হবে। কারণ তাঁর কাছাকাছি তেমন কোনও হলই নেই। ফলে সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। শুধু যে ফেডারেশন-ডিরেক্টর গিল্ডের মারামারি হচ্ছে, এতটা সহজ নয় জায়গাটা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে গোটা পরিকাঠামোটারই খলনলচে পাল্টে ফেলা দরকার। সাময়িক সমাধান করে লাভ নেই। সিনেমা শিল্পটাই এমন জায়গায় যাচ্ছে, যেখানে আগামী দিনে সেখানে মানুষের ইনভলভমেন্ট কমে যাওয়ারই কথা। প্রযুক্তিগত উন্নতি এমন জায়গায় যাচ্ছে, যেখানে সত্যিই সিনেমাকে এই নিয়মের বেড়াজালে আটকে রাখা কঠিন বলেই মনে হয়। কোথাও ফ্লেক্সিবিলিটি প্রয়োজন।

সোহিনী: ফেডারেশনের দাদাগিরি এবং তার মধ্যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির কি আদতে ক্ষতি ডেকে আনছে?

প্রদীপ্ত: ব্যক্তিগত ভাবে বলতে পারি ফেডারেশনের সঙ্গে একটি মাত্র ছবি করেছি। বাকি আমার সমস্ত কাজই, তা ছবি হোক বা টেলিফিল্ম কিংবা শর্ট ফিল্ম, কোনওটাই ওই ভাবে করা হয়নি। ফলে ফেডারেশনের সব নিয়মকানুনের সঙ্গে পরিচিত নই। আমি সাধারণত নিজের সেটআপে কাজ করতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব রয়েছে, তাঁদের সঙ্গে মিলে নিজের মতো করেই কাজ করার চেষ্টা করি। সত্যি কথা বলতে, যে কোনও জায়গাতেই তো দাদাগিরি বা রাজনীতি লেগেই থাকে। সেগুলোকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তা নিশ্চয়ই বিভিন্ন স্তরে দেখা প্রয়োদন। কিন্তু এসবের বাইরে যে দুটি জিনিস ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়, তা হল ডিস্ট্রিবিউশন এবং এক্সিবিশন। মানে একজন ছবি বানিয়ে কোথায় দেখাবেন? এইখানকার দাদাগিরি নিয়েও কথা বলা প্রয়োজন। আমি মনে করি, ওটাই আসল দাদাগিরি। একজন পরিচালক ছবি বানিয়ে হল পাচ্ছেন কি পাচ্ছেন না, কেন পাচ্ছেন না, তা দেখার দরকার। হিন্দি সিনেমার সামনে প্রায়শই মুথ থুবড়ে পড়তে হয় বাংলা সিনেমাকে। কেন হয়? এগুলি নিয়ে প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন।

সোহিনী: এই যে আলাদা আলাদা সংগঠনের ভাবনা তা কি ইন্ডাস্ট্রির যুথবদ্ধতার পক্ষে কোথাও ক্ষতিকর বলে মনে হয়?

প্রদীপ্ত: একেবারেই না। বরং টেকনিশিয়ান গিল্ড খুব জরুরি বলেই আমার মনে হয়। যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জন্য একটা ইউনিয়ন গিল্ড খুবই প্রয়োজন। তবে তার সঙ্গেই এই যে অতীব নিয়ম, এই যে অযাচিত দাদাগিরি- শুটিং বন্ধ করে দেওয়া, ক্যামেরা তুলে নিয়ে চলে যাওয়া কিংবা লোককে আটকে রাখা, কিংবা কথায় কথায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করার প্রবণতা, তা শেষ হওয়া দরকার। যতদিন যাবে, তত এই নিয়ম ভাঙবে। এখনই মানুষ ক্ষীপ্ত হয়ে উঠেছেন, পরে সেই ক্ষোভ আরও বাড়বে। তবে এটা বলতে দ্বিধা নেই, এই ধরনের শুটিং আটকে দেওয়া বা শিল্পীদের সময় নষ্ট করা যথেষ্ট অসম্মানজনক, অপমানজনক। ইন্ডাস্ট্রিতে একটা সন্দেহের পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছে। কেউ লুকিয়ে শুট করছে কিনা, কারওর শুটিংয়ে পাঁচ মিনিট বেশি লেগে গেল কিনা— এত সব হিসেব-নিকেশ করে যে কোনও সৃষ্টিশীল কাজ করা খুব কঠিন। এই প্রযুক্তির অগ্রগতির যুগে এই ভাবে কোনও কিছুকে বেঁধে রাখা কঠিন। ডিস্ট্রিবিউশনটাও এমন জায়গায় যেতে চলেছে, পেপারভিউয়ের মতো ব্যবস্থা আসতে চলেছে, যেখানে পরিচালক সরাসরি দর্শকের কাছে নিজের ছবি পৌঁছে দেবেন। এমন একটা পর্যায়ে এইসব বজ্রআঁটুনি দিয়ে কোনও উন্নতি সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। বরং ফ্লেক্সিবিলিটিটাই অনেক বেশি কাম্য। একই সঙ্গে ভীষণ জরুরি ভালো ছবি তৈরি হওয়া।

Exclusive interview of Bengali Film Director Pradipta Bhattacharya about the situation of Bengali movie industry and recent glitch between Directors and federation

সোহিনী: টেকনিশিয়ানদের এই বিক্ষোভ বা আন্দোলন কতটা স্বতঃস্ফূর্ত? নাকি এর নেপথ্যেও কোথাও রয়েছে সেই ফেডারেশনের চাপ, কার্যত যাকে বলা যেতে পারে দাদাগিরি?

প্রদীপ্ত: আসলে মেম্বারশিপের তো অনেক শর্ত থাকেই। সেটা দু'পক্ষেই আছে বলে আমার মনে হয়। মতপার্থক্য সমস্ত জায়গাতেই থাকবে, তবে সেটাকে বুঝে কোথাও একটা তৃতীয় রাস্তা তৈরি করার প্রয়োজন আছে বলেই মনে হয়।

সোহিনী: বাংলা ছবির প্রেক্ষাগৃহ পাওয়া নিয়ে প্রায়শই নানা ধরনের অভিযোগ কানে আসে। হিন্দি ছবির জন্য বাংলা ছবি হল পায় না যেমন, তেমনই বড় প্রোডাকশন হাউজের সামনেও কোণঠাসা হয়ে যায় ছোট ছোট হাউজ। প্রযোজকদের ক্ষেত্রেও বহু ক্ষেত্রে এমন ধরনের মনোপলি দেখা যায়, দাদাগিরি চলতে থাকে। এই পুতুলনাচের রশি আসলে কাদের হাতে?

প্রদীপ্ত: এই জায়গাটা নিয়ে প্রচুর আলোচনার জায়গা রয়েছে বলে মনে হয়। একজন পরিচালক একটি ভারতীয় ছবি রেজিস্টার করাবেন এবং তিনি হলে দেখাতে চান। যে কটা হলে তাঁর ক্ষমতা আছে, সেখানে যাতে তিনি ছবি দেখানোর সুযোগ পান, পছন্দের দর্শকের কাছে ছবিটিকে দেখাতে পারেন, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

Exclusive interview of Bengali Film Director Pradipta Bhattacharya about the situation of Bengali movie industry and recent glitch between Directors and federation

সোহিনী: সেটার জন্য সরকারি তরফে কোনও উদ্যোগ দরকার বলে মনে করেন?

প্রদীপ্ত: একেবারেই। সরকারের উদ্যোগ ছাড়া এই জায়গাটা পাল্টানো কঠিন। আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলা ছবির জন্য অনুদান দিত। করছাড়, শুটিংয়ের জন্য সুবিধা করে দেওয়া, বহু ক্ষেত্রে ছবি দেখানোর সুবিধা করে দেওয়ার মতো ভূমিকাগুলো সরকার পালন করত। দক্ষিণী ছবির ক্ষেত্রে সিনেমা বানানো, দেখা, চর্চা করার বিষয়টাকে রীতিমতো আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটা বাংলাতেও একটা পর্যায়ে ছিল। সেই চর্চাটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে এখানে। এটাও একটা ক্ষতির জায়গা। ফলে তৃণমূল স্তর থেকে জায়গাগুলোর পরিবর্তন দরকার। একজন পরিচালক নানা কারণে ছবি বানাতে চান। ছবিটা মানুষকে বিনোদন দেবে, ছবিটার কোনও শৈল্পিক গুণ থাকবে, ছবিটার পিছনে যে টাকা খরচ হয়েছে তার দ্বিগুণ মুনাফা সেটি তুলে আনবে। সেই লভ্যাংশ থেকে ফের নতুন ছবি বানানোর মূলধন উঠে আসবে। এই এতকিছু নিয়মের বেড়াজাল, দাদাগিরি, মনোমালিন্য, সন্দেহের ভয়— এসবের সঙ্গে হয় না। ফলে কোথাও শিকড় থেকে বদল দরকার। একই সঙ্গে দরকার নতুন ছবিনির্মাতাদের উৎসাহ দেওয়া, তাঁদের ছবিগুলিকে ছড়িয়ে দেওয়া। নাহলে আমরা এখানেই আটকে যাচ্ছি। আন্তর্জাতিক ভাবে তো দূরের কথা, জাতীয় স্তরেও আমাদের ছবি কোথাও পৌঁছচ্ছে না। বিনিয়োগ আসছে না। যেটা খুবই চিন্তার।

সোহিনী: বাংলাদেশের প্রযোজনা সংস্থার ছবি ঘিরে এই যে এতবড় অশান্তি হল টলিপাড়ায়, সেটা কি বাইরের প্রযোজনা সংস্থা বা যারা বাংলায় আসতে চাইছেন ছবি বানানোর জন্য, তাঁদের জন্য কি একটা অসংহতির বার্তা গেল না এই ঘটনায়?

প্রদীপ্ত: যে প্রযোজনা সংস্থার আটকে দেওয়া হয়েছে কাজ, অর্থাৎ এসভিএফ, আমার খুবই সন্দেহ জাগে এসভিএফের মতো বড় প্রযোজনা সংস্থা না হলে এই ঘটনা নিয়ে এতটা হইচই আদৌ হত কিনা? শুনেছি, বাংলাদেশের যে প্রযোজনা সংস্থা এখানে এসে কাজ করতে চেয়েছিলেন, তারা বড়সড় বিনিয়োগ নিয়ে আসছিল। কিন্তু তাঁদের কাছে আরও অর্থ চাওয়ায় তারা পিছিয়ে যায় শেষমেশ। এখানে প্রযোজকদের মনোপলির ব্যাপারটাও চলে আসে অনেকখানি। বহু সময়ই দেখা যায়, নিয়ম-দাদাগিরির জন্য বিনিয়োগকারীরা ফিরে যাচ্ছেন। আবার উল্টো দিকে প্রযোজকদের দিক থেকেও বহু সমস্যা তৈরি হয়। ফলে দু'দিক থেকেই ভাবনাচিন্তা করে রাস্তা বের করা দরকার।

সোহিনী: কীভাবে হতে পারে এই সংশোধন?

প্রদীপ্ত: আমার মনে হয় মেকিং থেকে ডিস্ট্রিবিউশন অবধি একটা সিস্টেমের পরিবর্তন দরকার, নিয়মের পরিবর্তন দরকার। যাঁরা এই কাজটা জানেন, শুটিং, এডিট বা আরও অন্যধরনের কাজ যা যা থাকে, সেগুলোর অভিজ্ঞতা রয়েছে, তেমন সদস্য দরকার। অন্য কোনও ক্ষেত্রের লোক হঠাৎ করে এখানে ঢুকে সব কিছু আমূল পাল্টে দিতে পারবেন, এমনটা সম্ভব নয়। একটা ছবি বানানো খুবই ইন্টিগ্রেটেড একটা প্রসেস। যাঁরা এই ব্যাপারটায় আছেন, জানেন, একই সঙ্গে যাঁরা স্বাধীন ভাবে ছবি বানাচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেকের মতামত নিয়ে সমীক্ষার করে দেখা দরকার, সমস্যাগুলো আসলে ঠিক কোথায়? সেই জায়গাগুলোর সমাধান করে টেকনিক্যাল অগ্রগতির কথা মাথায় রেখে নতুন নিয়মনীতি তৈরি করতে হবে।

সোহিনী: এই গোটা প্রক্রিয়ায় রাজনীতির প্রবেশ কতটা সঙ্গত মনে করেন?

প্রদীপ্ত: সিনেমারও একটা আলাদা রাজনীতি থাকে। সেটা দলীয় রাজনীতির থেকে আলাদা। সেই রাজনীতিটা তিনিই বুঝবেন, যিনি এই কাজটা হাতেকলমে করেছেন। ফলে চারটি রাজনৈতিক দলের সদস্য দিয়ে এই কাজটা হওয়া সম্ভব নয় কিছুতেই। ফলে এই সব কমিটি বা সংগঠনগুলোর মাথায় সিনেমাঅভিজ্ঞ মানুষের থাকাটা বেশি প্রয়োজন বলে আমার অন্তত মনে হয়। একটা ছবির অজস্র বিভাগ থাকে। শুটিংয়ের সময়, পোস্ট প্রোডাকশন এমনকী একটা ছবি যখন সেন্সর বোর্ডে যায়, তখনও আলাদা আলাদা দফতর কাজ করে। তার বিজ্ঞাপনের নেপথ্যে থাকে আলাদা দফতর। ফলে একে একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ বলতে পারেন। সেটা না জেনে, না বুঝে সামলানো কঠিন।

আরও পড়ুন:‘মনের মতো চরিত্র পেলে তবেই সিরিয়ালে ফিরব’: সুদীপ্তা চক্রবর্তী

সোহিনী: পরিচালকের অহং, টেকনিশিয়ানের ইগো, এর যে দ্বন্দ্ব, তা কি আদতে বাংলা সিনেমাকেই বিপন্ন করে তুলছে না?

প্রদীপ্ত: বর্তমানে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এমন জায়গায় গিয়েছে, তাতে যে কেউ চাইলে একটি ছবি তৈরি করে ফেলতে পারে রাতারাতি। সম্প্রতি হলিউডে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-র বিরোধিতায় একটি বড় আন্দোলনে সামিল হন সেখানকার অভিনেতা-চিত্রনাট্যকারেরা। ভবিষ্যতে হয়তো এমন একটা সময় আসতে চলেছে, যেখানে পরিচালকও গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। এআই-ই হয়তো চিত্রনাট্য লিখে দেবে, বলে দেবে ছবিটা কীভাবে পরিচালনা করতে হবে, কিংবা কলাকুশলীদের কাজও হয়তো সামলে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই। ফলে এই ভাবনাগুলো ভেবে সামনের দিকে এগোতে হবে। এমন একটা দিন আসতেই পারে, যেদিন পনেরো জনের কাজ পাঁচ জন করে দেবে। তখন কী হবে? বহু পেশাই হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে এই মুহূর্তে সমস্ত অহং ঝেড়ে ফেলে একটু সুদূরপ্রসারী ভাবনার দরকার রয়েছে বাংলা ছবিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সবশেষে বলতে চাই, ছবি ভালো তৈরি হোক। বিনিয়োগ আসুক। মানুষের হাতে কাজ থাকুক। মাল্টিপ্লেক্সের বিকল্প হিসেবে সিঙ্গেল স্ক্রিন ফিরে আসুক, যেখানে দর্শক কম খরচে ভালো সিনেমা দেখতে পারেন। বাঙালি দর্শকদের হাতে টাকা আসুক, যাতে তাঁরা সিনেমার টিকিটটা কাটতে পারেন। কারণ দর্শক না থাকলে আসলে পরিচালক, টেকনিশিয়ান, অভিনেতা কারওরই কোনও অস্তিত্ব নেই। ওঁরাই আসলে সব।

 

More Articles