বিদেশি গাছের আঠাই আসলে জনপ্রিয় মশলা! কীভাবে ভারতীয় রান্নায় জায়গা করে নিল ‘হিং’?
Hing Spice : ফোড়ন অথবা কচুরি, বাঙালি হেঁশেলের জিয়নকাঠি হিং, কী ভাবে ভারতে জনপ্রিয়তা পেল এই মশলা?
রান্নায় ফোড়নের ভূমিকা আসে সবার প্রথমে। কড়াইয়ে গরম তেল চাপিয়ে তাতে গোটা মশলা ছেড়ে দেওয়ার এই সাবেকি প্রথাই স্বাদ বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। আর এই ফোড়ন হিসেবেই রান্নায় প্রথম ব্যবহার করা শুরু হয় হিংয়ের। সময়ের সঙ্গে ক্রমেই নিজের স্বদযশে বাঙালির হেঁশেলে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে মশলাটি। সাবেকি রান্নার ফোড়ন থেকে শুরু করে কচুরি, পরোটা ইত্যাদি ময়দার ভাজা পদে যোগ হতে শুরু হয়ে হিংয়ের স্বাদ। কিন্তু জানেন কি বাংলায় বহুল প্রচলিত এই জনপ্রিয় মশলাটির জন্ম আসলে বিদেশের মাটিতে! শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি, বিদেশি গাছের আঠা থেকেই এই মশলার সূত্রপাত।
সাবেকি বাংলার রান্নায় হিংয়ের চল ছিল। সেই রেওয়াজ আজও বহাল। ডাল, তরি-তরকারি থেকে শুরু করে তেলে ভাজা খাবারেও এর স্বাদ বহাল। শহর অথবা শহরতলীর রাস্তার ধারে আজকার প্রায়ই দেখা যায় বড় বড় করে দোকানের সামনে বোর্ড টাঙানো থাকতে, “এখানে হিংয়ের কচুরি পাওয়া যায়”। শুধু পথচলতি জলখাবার হিসেবেই নিয়ে, বাড়িতেও অতিথি আপ্যায়নে হিংয়ের কচুরির দেদার চল বাংলায়। শুধু তাই নয়, বহু কাল ধরেই নিরামিষ রান্নায় আমিষ স্বাদের ঘাটতি পূরণ করতে বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয় এই মশলাকে।
সময়টা আজ থেকে অনেক বছর আগে, তখনও বাঙালির হেঁশেলে চাইনিজ, মোগলাই অথবা কুইজন খাবার ঢোকেনি। ফলে বাংলার নিরামিষ তরকারিতে একঘেঁয়ে স্বাদ বদলে দিতে হিংয়ের জনপ্রিয়তা ক্রমেই তুঙ্গে ওঠে। এর আরও একটা বড় কারণ হল ভারতে সে সময় অর্ধেকের বেশি মানুষই ছিলেন নিরামিষভোজী। ফলে নিরামিষ পরিচিত রান্নার মধ্যে হিংয়ের স্বাদের নতুনত্ব সহজেই হৃদয় গ্রাহ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু ভারতে তো সে সময়ে মোটেই হিংয়ের চাষ অথবা উৎপাদন হতো না, তাহলে কীভাবে এদেশে আসতো এই জনপ্রিয় মশলা?
আরও পড়ুন - ‘লুচি’ নামের আসল রহস্য কী? জানেন কীভাবে জন্ম হল এই জনপ্রিয় খাবারের?
ভারতীয় খাবারের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, অনেক বিশেষজ্ঞই আলেকজান্ডারকে এদেশে হিংয়ের স্রষ্টা বলে দাবি করেছেন। ভারতীয় খাবার সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে খাদ্য ইতিহাসবিদ ডক্টর আশিস চোপড়া বলেন, আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী হিন্দুকুশ পর্বত থেকে এই হিং সিন্ধুতে নিয়ে এসেছিল। প্রাথমিক ভাবে বিরল সিলফিয়াম উদ্ভিদ হিসেবেই গণ্য করা হয়েছিল একে। এমনকী সে সময়ে গ্রীক এবং রোমানরা এটি ব্যবহার করলেও বিশেষ চল ছিল না অন্যান্য পশ্চিমী দেশগুলিতে।
মূলত আফগানিস্তান, ইরান এবং উজবেকিস্তানের অ্যাসফোটিডা উদ্ভিদের প্রজাতি হল হিং। এই প্রজাতির গাছের শিকড়ের যে আঠা তা থেকে তৈরি করা হয় জনপ্রিয় এই মশলা হিং। হিংয়ের মধ্যে একটা তীব্র গন্ধ রয়েছে। যার জেরে গরম তেলে ওই গন্ধ দিলে পুরো রান্নায় সেটি ছড়িয়ে পড়ে স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। ইংরেজিতে এই Asafoetida বলা হয়। এই শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ থেকে, যার অর্থ আঠা। সে কারণেই হিংয়ের গুঁড়ো এর গন্ধ অনেকক্ষণ থাকে। শুধু তাই নয় হিং খাঁটি হলে তা জিভে রাখলে জ্বালা শুরু করে দেয়।
খাবার ছাড়াও আরও অনেকে ক্ষেত্রেই হিং-এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। একসময় আফ্রিকা এবং জ্যামাইকার মনুষ ভূত-প্রেত তাড়াতে হিং-এর তাবিজ পরত বলে শোনা যায়। ১৯১৮ সালে আমেরিকায় স্প্যানিশ ফ্লু চলাকালীন কেউ কেউ হিং-এর পাউচ পরতেন বলেও সূত্রের খবর। শুধু তাই নয়, আজও অনেকে কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে হিং ব্যবহার করেন। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে গোটা বিশ্বের নিরিখে ভারতেই সবচেয়ে বেশি হিং ব্যবহার করা হয়। ফলে ভারতীয় না হয়েও প্রয়োজন আর ব্যবহারের দিক থেকে এই মশলাটি দেশীয় তকমা যে দাবি করে, তা বলাই বাহুল্য।