নস্টালজিয়ায় ছেদ! নাহুমসের মেনু থেকে কেন চিরতরে হারাল এই পদ?
Nahoum Bakery: আগে সপ্তাহের সাতটি দিনই ক্রেতাদের জন্য খোলা থাকত প্রসিদ্ধ এই বেকারি। তবে এবার থেকে খাঁটি ইহুদি রীতি মেনে নিউ মার্কেটের দোকানটি বন্ধ থাকবে প্রতি শনিবার।
বড়দিন মানে যদি কেক হয়, তাহলে গত কয়েক দশকে কলকাতার মানুষের কাছে কেকের সমার্থক হয়ে উঠেছে নাহুমস অ্যান্ড সনসের নাম। শুধু কেক নয়, প্রায় ১২২ বছর ধরে চিকেন পাফ, চিকেন প্যাটিজ, চিকেন ক্রোসেঁ বা চিকেন মেয়োনিজের মতো একাধিক লোভনীয় পদের মনকাড়া ইহুদি ঠিকানা হয়ে উঠেছিল এই নাহুমস। কলকাতার একমাত্র ইহুদি কনফেকশনারি হিসেবে যা বছরের পর বছর ধরে মানুষের মন জিতেছে, গন্ধে-স্বাদে মানুষকে মোহিত করেছে। বড়দিনের সময় হগস মার্কেটের ভিতর লম্বা লাইন মানেই নাহুমস। এমনই হাজার বনেদি কলকাতাবাসীর মগজে ঢুকে রয়েছে নাহুমস-নস্টালজিয়া।
তবে সেই নস্টালজিয়া থেকে একটি বিশেষ অংশ সম্প্রতি বাদ পড়েছে। নাহুমসে আর মিলবে না চিকেনের সেই সব লোভনীয় পদ। সুদূর ইজরায়েলে বসেই কলকাতার মাটিতে এই ইহুদি কনফেশনারিটি চালান নাহুমসের বর্তমান মালিক আইস্যাক ইলিয়াস নাহুম। সেই সুদূর ইজরায়েল থেকেই এসেছে নয়া নির্দেশিকা। যার ফলে কনফেশনারির মেনুতে বড়সড় বদল এসেছে। মেনু থেকে বাদ গিয়েছে লোভনীয় সব মাংসের পদ। না, ইহুদিদের মাংস খাওয়া বা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনও বিধিনিষেধ রয়েছে, এমন নয়। তবে মুরগি রান্না করার ক্ষেত্রে তাদের বেশ কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। আর সেই নিয়মের বেড়াজালেই নাহুমস থেকে বাদ পড়ল চিকেনের সব পদ। তবে মাছ ও ডিমের পদগুলি এখনও মিলছে ইহুদি এই কনফেশনারিতে।
আরও পড়ুন: বঙ্গভঙ্গ থেকে নকশাল আন্দোলন, ১২০ পেরিয়েও কলকাতার সেরা কেক ঠিকানা নাহুমস
একই সঙ্গে আরও একটি বড়সড় বদল এসেছে নাহুমসে। আগে সপ্তাহের সাতটি দিনই ক্রেতাদের জন্য খোলা থাকত প্রসিদ্ধ এই বেকারি। তবে এবার থেকে খাঁটি ইহুদি রীতি মেনে নিউ মার্কেটের দোকানটি বন্ধ থাকবে প্রতি শনিবার। এর কারণও সেই ধর্মীয় নিয়ম। কর্তৃপরক্ষের তরফে জানা গিয়েছে যে, শনিবার দিনটিকে ইহুদিরা বিশ্রামের দিন বলে মনে করেন। এই দিনে ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা বাইবেলের নানা গল্প স্মরণ করে থাকেন। সে কারণেই এবার থেকে শনিবারে তালা পড়ছে নাহুমসের দরজায়।
১৯০২ সালে কলকাতার বুকে শুরু হয় খাঁটি ইহুদি কনফেশনারি। নাহুম ইসরাইল মোরদেকাই ছিলেন এক বাগদাদি ইহুদি। যার হাত ধরে শুরু হয় নাহুমসের পথচলা। প্রথমে দোকানটি ছিল হগ মার্কেটের সামনের দিকে। প্রায় ১৪ বছর পরে দোকানের অবস্থান পরিবর্তন হয়। কলকাতার শহরের প্রাচীনতম বেকারিগুলির একটি এই নাহুমস। ইসরাইল মোরদেকাইয়ের পরে দোকানের দায়িত্ব যায় তাঁর দ্বিতীয় প্রজন্ম ইলিয়াসের হাতে। ১৯৬৪ সাল নাগাদ ইলিয়াসের মৃত্যুর পর তৃতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি ডেভিড নাহুম দোকান পরিচালনার দায়িত্ব নেন। ডেভিডের ভাই নরম্যান ও সলোমনও বিভিন্ন সময় নাহুমসের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালে ডেভিডের মৃত্যুর পর দোকান এখন আইস্যাক ইলিয়াস নাহুমের দায়িত্বে। বেকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, এর আগের মালিক কলকাতাতে থাকলেও আইজ্যাক গোটা ব্যবসাটাই সামলান ইজরায়েলে বসে। এখন আর হার্টফোর্ড লেনের বাড়িটায় সারা বছর থাকেন না নাহুমরা। শীতের সময় শুধু তাঁরা আসেন কলকাতায়। নাহুম ভাইদের মধ্যে সলমন ও ডেভিড নাহুমের সমাধি রয়েছে কলকাতার নারকেলডাঙায়। এখন ইজরায়েল থেকেই বিভিন্ন নির্দেশ আসে নাহুমসের কর্মীদের কাছে। সেই অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনা করা হয়। যদিও বড়দিনের সময় এখানে আসতেন তিনি। তবে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন লড়াইয়ের দৌলতে গত এক বছর কলকাতায় আসতে পারেননি আইজ্যাক।
কিন্তু কেন হঠাৎ চিকেনের পদ মেনু থেকে বাদ দিলেন নাহুমস কর্তৃপক্ষ? জানা গিয়েছে,ইহুদি নিয়ম অনুযায়ী তাদের দোকানে চিকেনের পদ বিক্রি করা যেতেই পরে। তবে সেই চিকেন কাটতে হবে একজন ‘সহেট’ (shochet)-কে। এই সহেটকে ইহুদি কসাই আইন ও নিয়মকানুন জানতেই হবে। আর সেই নিয়ম অনুযায়ী, মুরগি কাটার পর রান্না হওয়ার আগে তার মধ্যে যেন এক ফোঁটা রক্ত না থাকে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হয়। এক কোপে কাটতে হয় মুরগির গলা। আগে কলকাতা শহরে ইহুদি সহেট পাওয়া যেত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা শহরে সেই পেশার মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে গিয়েছে, যিনি এত সব নিয়ম মেনে বেকারির জন্য চিকেন সরবরাহ করবেন। এই সব নিয়মের বেড়াজালেই নাহুমস থেকে বাদ পড়ছে লোভনীয় চিকেনের সব পদ।
আরও পড়ুন:২৯৫ টাকা থেকে শুরু করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা, কোন রহস্য লুকিয়ে ব্রিটানিয়ার সাফল্যে
নাহুমসের চিকেন প্যাটিজ বা চিকেন পাফের মতো পদের আবেদন ছিল সর্বকালের। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় থেকে মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। নাহুমসের চিকেন প্যাটিজের ভক্ত ছিলেন এমন অনেকেই। আজও বিকেল গড়ালেই নাহুমসের বাইরে ভিড় জমে। বড়দিনের দিনগুলোতে কেকের আবেদন তো ছিলই, তবে সাধারণ দিনেও চিকেনের সেইসব পদ চাখতে লম্বা লাইন পড়ত নাহুমসের বাইরে। দোকানের ক্যাশ বাক্স সামলানো ‘হালদারবাবু’ সম্প্রতি ম্লানমুখে জানালেন, "চিকেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বদলে চিজ খান বা ভেজ।" মেহগনি কাঠের শো-কেসে থরে থরে সাজানো শতাব্দীপ্রাচীন রেসিপির সব পদ, যার গন্ধ-স্বাদ বাঙালির হৃদয়ে-মগজে ভালোবাসা ছড়িয়ে এসেছে এত বছর ধরে, সেই স্বাদের কিছুটা অংশ এবার হারিয়ে ফেলল কলকাতাবাসী। হারিয়ে ফেলল খুব প্রিয় এক নস্টালজিয়া।