৪,০০০ বছরের ঐতিহ্যের শবযাত্রা! মহেঞ্জোদারোর বিখ্যাত মূর্তি যেভাবে বদলে গেল...

Mohenjodaro Dancing Girl Mascot: ৪০০০ বছর আগেকার নগ্ন মূর্তিতে এখন, এই ২০২৩ সালে এসে অশ্লীলতা খুঁজে পাচ্ছেন প্রশাসনের আধিকারিকরা।

নগ্ন দেহ, ডান হাত কোমরে দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে সেই কত কত শতাব্দী ধরে। দেহে কোনও আবরণ নেই, আভরণ আছে সামান্য। হাতে বিস্তর চুড়ি, বালা। আর গলায় পাতার মতো লকেটওয়ালা হার। চুলে খোঁপা। নগ্ন দেহে ফুটে উঠেছে অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাস। দাঁড়ানোর ভঙ্গি, হাতের ওই বিশেষ অবস্থান- সবটা মিলে এই মূর্তি শুধুই ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়। নগ্নতাকে শিল্পে ফুটিয়ে তোলার অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভূত হয় এই মূর্তি দেখেই। মহেঞ্জোদারোর 'ডান্সিং গার্ল' মূর্তিটি সম্প্রতি এক নয়া 'মেকওভার' পেয়েছে। এই নগ্ন মূর্তির নয়া ভার্সন দেখে আঁতকে উঠতে হয়! সম্প্রতি 'বিশ্ব জাদুঘর দিবস' উপলক্ষ্যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংস্কৃতি মন্ত্রকের আন্তর্জাতিক জাদুঘর এক্সপোর 'মাস্কট'-এর উন্মোচন করেছেন। নতুন দিল্লির প্রগতি ময়দানে অনুষ্ঠিত এই এক্সপোতে মাস্কটটি আসলে জাতীয় জাদুঘরের সিন্ধু সভ্যতা গ্যালারির এক মূর্তির রেপ্লিকা। মাস্কটটি মহেঞ্জোদারোর সেই বিখ্যাত ডান্সিং গার্ল। কিন্তু এ কেমন মূর্তি!

হরপ্পা-সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার গ্যালারিতে সাড়ে ১০ সেন্টিমিটার লম্বা একটি ছোট মোমের ব্রোঞ্জ মূর্তি রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক ডি.আর. সাহানি মহেঞ্জোদারোর সিন্ধু উপত্যকায় এক এলাকার 'নবম গলিতে' একটি ভাঙা বাড়িতে ১৯২৬-২৭ সালে এই ব্রোঞ্জের যুবতীর নগ্ন মূর্তিটি আবিষ্কার করেন। একটি হাত কোমরে, অন্য হাতটি আলগাভাবে রাখা, বাঁকানো হাঁটু পর্যন্ত প্রসারিত। চেহারায়, ভঙ্গিমায় অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসের ছাপ।

আরও পড়ুন- “তুমি আমার সঙ্গে গিয়ে করবে টা কী,” কেন যশোদাবেনকে বিয়ের কথা স্বীকার করতে চাননি মোদি?

মিউজিয়াম এক্সপোতে যখন এই মাস্কটটি প্রধানমন্ত্রী উন্মোচন করলেন, সে যে কী ভয়াবহ দৃশ্যদূষণ! গোলাপি রঙের পোশাকে ঢাকা গোলাপি ক্রিম মাখা এক মূর্তি! কোথায় সেই রোদে পোড়া ব্রোঞ্জের রঙ, কোথায় সেই নগ্নতার প্রকাশ, কোথায়ই বা সেই আত্মবিশ্বাস, শিল্পই বা কোথায়! ফর্সা হওয়ার ক্রিম মাখা এক অদ্ভুত মূর্তি, যার কেবল কোমরে হাত রাখাটুকুই অনুকরণ করা হয়েছে মূল মূর্তি থেকে। বাকিটা কী? শিল্প, রক্ষণশীলতা, নাকি অসহায়তা!

মূর্তির রোদে পোড়া চামড়া কই? এমন মাখনের মতো চকচকে, গোলাপি, গৌরবর্ণ কীভাবে হলো এই মূর্তি? প্রধানমন্ত্রী ৮০,০০০ টাকার মাশরুম খেয়ে ত্বক মাখনের মতো রাখেন বলে নিন্দুকদের দাবি! মূর্তিও একই মাশরুম খায়, বা অন্তত সেই বাসনা থেকেই তার এই 'রূপ' কিনা জানা যায় না। জানা যায় না, এ মহেঞ্জোদারোর মূর্তির আড়ালে সুসজ্জিত ট্যাবলোতে থাকা এমন মূর্তি তৈরির কথা কারাই বা কেনই বা ভাবলেন! নগ্নতাকে ঢেকে ফেলার কেনই বা এত তাড়া? নগ্ন দেহের শ্লীলতার কাছে এমন অশ্লীল শিল্পকর্ম হাজার গোল খেলেও, প্রশ্ন তবু থেকেই যাবে।

দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ামে আসল মূর্তিটি যেখানে রাখা হয়েছে সেই কাঁচের বাক্স থেকে কিছু দূরেই সিন্ধু উপত্যকার এক মহিলার কঙ্কালের অবশেষ রাখা আছে। হাড়গুলি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন সবেমাত্র খনন করে পাওয়া গিয়েছে। পাকিস্তানে করাচির ন্যাশনাল মিউজিয়ামেও একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি আছে। আর্নেস্ট ম্যাকে ১৯৩০-৩১ সালে এটি খুঁজে পান হরপ্পা সভ্যতার এলাকায়। করাচির এই মূর্তিটিকে দিল্লির মূর্তিটির যমজ বোন বলা হয়। আপাতত ব্রোঞ্জের এই দু'টি ক্ষুদ্র মূর্তি, দু'টি দেশের দুই জাতীয় জাদুঘরে কাঁচের আড়ালে রাখা। মাঝে এক সীমান্ত, এক দগদগে ঘা।

আরও পড়ুন- কেউ ভাঙা টিন-লোহা কোড়ান, কেউ করেন পেট্রল পাম্পে কাজ! কেমন আছেন মোদির ভাইয়েরা?

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে মূর্তি চার হাজারেরও বছর ধরে এভাবেই নগ্নরূপে চিত্রিত হয়েছে, তাকে এমন পোশাকে ঢাকা হলো কেন? পোশাকে ঢাকতে চাওয়া কোথাও মহিলার যৌনতাকে ঢেকে-চেপে রেখে আরেকধরনের যৌন নিপীড়ন নয় তো? কেন মনে করা হচ্ছে এই নগ্নতা অশ্লীল? 'ভারতীয়' সংস্কৃতির নামে এমন অশ্লীলতা শেষে মূর্তিকেও বাদ দিল না! অবশ্য নগ্ন জৈন মূর্তিকে ঢাকা, নাগা সন্ন্যাসীদের উপর নিষেধাজ্ঞা- এসব বিশেষ দেখা যায় না ‘ভারতীয়’ সংস্কৃতিতে।

সমস্যা হচ্ছে, ৪০০০ বছর আগেকার নগ্ন মূর্তিতে এখন, এই ২০২৩ সালে এসে অশ্লীলতা খুঁজে পাচ্ছেন প্রশাসনের আধিকারিকরা। যারা এই মূর্তির অনুমোদন দিয়েছেন, যারা তৈরি করিয়েছেন, যিনি উন্মোচন করেছেন- সকলেই মেনে নিয়েছেন, মনে নিয়েছেন যে যুবতী নগ্ন মহিলার মূর্তিটি অশ্লীল। যে পথে দেশ ও দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এগোচ্ছে তাতে 'ভারতীয়' সংস্কৃতির নামে মহিলাদের দেখা হচ্ছে এমন এক চশমা দিয়ে, যে চশমা আর যাই হোক, যুক্তির নয়, স্বাধীনতার নয়। 

যে প্রত্নতাত্ত্বিক এই মূর্তিটি খনন করেছিলেন, সেই জন মার্শাল, এই কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার এই শারীরিক ভঙ্গিটিকে 'উদ্ধত' বলেছিলেন। আরেক ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক, মর্টিমার হুইলার এই মূর্তির চোখে উদ্ধত ভাব নিয়ে কথা বলেছেন। 'ঔদ্ধত্য' কখন আদরের, কখন লজ্জার তা লিঙ্গভেদে আলাদা হয়ে যায়। যে পুরুষরা মহিলাদের পোশাকহীনভাবে দেখতে চায় এবং যে পুরুষরা নগ্ন মহিলাদের পোশাকে ঢেকে রাখতে চায়, তাদের উদ্দেশ্য আসলে খুব একটা আলাদা নয়। দুই ক্ষেত্রেই, মহিলা কীভাবে নিজেকে মেলে ধরবেন, কী পরবেন, কীভাবে দাঁড়াবেন, কীভাবে আচরণ করলে তাঁকে উদ্ধত বলা হবে সবটাই পুরুষদের দৃষ্টিতেই মাপা, তখনও, এখনও!

More Articles