কেউ ভাঙা টিন-লোহা কোড়ান, কেউ করেন পেট্রল পাম্পে কাজ! কেমন আছেন মোদির ভাইয়েরা?

Narendra Modi family: নরেন্দ্র মোদি ক্যান্টিনে ঘুমাতেন। দিনের বেলা কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় রাজ্যের আরএসএস সদর দফতরে যেতেন।

দ্বিতীয় পর্ব

নরেন্দ্র মোদি সিংহ হৃদয়, দেশের কাছে তাঁর এই 'ইমেজ'ই বরাবর তুলে ধরতে চেয়েছে বিজেপি। এর আগে আরএসএসের গভীর আনুগত্যে থেকে তিনি শিখেছেন 'ফোকাস'। পাখির চোখ দেখতে গেলে বাকি সব কিছুই ঘোলাটে হয়ে যায়। নরেন্দ্র মোদির কাছে পরিবার যত আবছা হয়েছে ততই স্পষ্ট হয়েছে পাখির সেই চোখ। তিনি বেরিয়ে এসেছেন, পরিবারের বাকিরা রয়েছেন ঠিক সেখানেই, যেখানে তিনি ছেড়ে এসেছিলেন বাকিদের। মোদি বংশের বাকিদের, মানে প্রধানমন্ত্রীর ভাই, ভাগ্নে এবং ভাইঝি বা খুড়তুতো ভাই বোনদের জীবনের গল্প তাই অত্যন্ত সরল এবং সংগ্রামের। মোদির বংশের এমনও অনেকে রয়েছেন যাদের দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড়েও হিমশিম খেতে হয়।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির খুড়তুতো ভাই অশোকভাই (মোদির প্রয়াত কাকা নরসিংহদাসের ছেলে) ভাদনগরের ঘিকান্তা বাজারে ঠেলা গাড়িতে ঘুড়ি, পটকা এবং স্ন্যাক্স বিক্রি করতেন। কিছুকাল হল তিনি ওই একই জিনিস বিক্রি করার জন্য মাসে ১,৫০০ টাকায় ৮x৪ ফুটের একটি ছোট দোকান ভাড়া নিয়েছেন। দোকান থেকে তার আয় মাসে প্রায় ৪,০০০ টাকা। স্ত্রী বীণার সঙ্গে তিনি স্থানীয় জৈন ব্যবসায়ীদের দ্বারা পরিচালিত দরিদ্রদের জন্য এক সাপ্তাহিক বিনামূল্যের খাবারের দোকানে কাজ করেন। সেখান থেকে মাস গেলে আরও হাজার তিনেক টাকা উপার্জন করেন। অশোকভাই ওই দোকানে খিচুড়ি এবং কড়ি রান্না করেন এবং তাঁর স্ত্রী বাসন ধুয়ে দেন। ওই শহরেই তিন কামরার একটি ছোট্ট ঘরে তাঁদের বাস।

তাঁর বড় দাদা, ভরতভাইয়ের জীবনও একই রকম কঠিন। ভাদনগর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে পালানপুরের কাছে লালাওয়াড়া গ্রামে একটি পেট্রল পাম্পে কাজ করেন তিনি, মাসে ৬,০০০ টাকার মতো উপার্জন করেন। রোজ বাড়ি আসাও সম্ভব নয়, ১০ দিন বা তারও বেশি সময় পর পর বাড়ি ফেরেন। ভাদনগরে, তাঁর স্ত্রী রমিলাবেন তাঁদের ছোট বাড়িতেই খাবার সামগ্রী, মুদির জিনি এবং আরও বিবিধ জিনিস বিক্রি করেন, মাসে আয় প্রায় ৩,০০০ টাকা। তৃতীয় ভাই, চন্দ্রকান্তভাই আহমেদাবাদের একটি দাতব্য গোয়ালে কাজ করেন।

আরও পড়ুন- ১৯৭১-এ সংসার ছেড়েছিলেন মোদি! প্রধানমন্ত্রীর বাকি পরিবারের কথা কেন জানেই না দেশ

অশোকভাই

প্রধানমন্ত্রী মোদির আরেক খুড়তুতো ভাই, অশোকভাই এবং ভারতভাইয়ের চতুর্থ ভাই অরবিন্দভাই ভাদনগর এবং আশেপাশের গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যবহৃত তেলের টিন, বাক্স এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ সংগ্রহ করেন। সেগুলো তারপরে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে মাসে প্রায় ৯,০০০ টাকা উপার্জন করেন। তাঁর কাছে অবশ্য, দু'জনের পেট চালানোর জন্য এই টাকা যথেষ্ট। তিনি এবং স্ত্রী রঞ্জনবেন- এই দু'জনেরই সংসার। তাঁদের কোনও সন্তান নেই। নরসিংহদাসের সন্তানদের মধ্যে ভরতভাই সবচেয়ে বেশি উপার্জনকারী।

নরসিংহদাসের বড় ছেলে ভোগীভাইয়েরও ভাদনগরে একটি মুদির দোকান রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নরসিংহদাসের পাঁচ ছেলের কেউই ম্যাট্রিকুলেশনের পর পড়াশোনা করেননি। তাঁর ভাই দামোদরদাসের মতো নরসিংহদাসও ভাদনগর রেলস্টেশনের কাছে একটি চায়ের দোকান চালাতেন। নরসিংহদাস, নরোত্তমদাস, জগজীবনদাস, দামোদরদাস, কান্তিলাল এবং জয়ন্তীলাল- ৬ ভাই ছিলেন তাঁরা। জয়ন্তীলাল এবং কান্তিলাল দু'জনই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। জয়ন্তীলাল অবসরের পরে গান্ধীনগরে থাকেন। তাঁর মেয়ে লীনার বিয়ে হয়েছে ভাদনগরের কাছে ভিসনগর শহরের একজন বাস কন্ডাক্টরের সঙ্গে। ভাদনগরের আরএসএস কর্মী ভারতভাই মোদিও জানিয়েছিলেন, ভাদনগর বা আহমেদাবাদে তাঁদের কোনও আত্মীয়ই কখনও নরেন্দ্রভাইয়ের নাম করে রোয়াব দেখাননি।

ভারতভাই

নরেন্দ্র মোদির নিজের ছোট ভাই, পঙ্কজ মোদি গুজরাতের তথ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা। তাঁর অবশ্য নিজের সহোদরের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হতো কারণ তাঁদের মা, হিরাবেন, গান্ধীনগরে তাঁদের বাড়িতেই জীবনের শেষ ক'টা দিন কাটিয়েছেন। বাসন্তীবেন মোদি হলেন নরেন্দ্র মোদির একমাত্র বোন। স্বামী হাসমুখ লাল এলআইসিতে কর্মরত ছিলেন।

নরেন্দ্র মোদির এই 'বিবর্তন' বিষয় নিয়ে সুস্পষ্ট স্মৃতি রয়েছে তাঁর দাদা অম্রুতভাইয়ের। ১৯৬৯ সালে তিনি আহমেদাবাদের গীতা মন্দিরের কাছে গুজরাত রাজ্য সড়ক পরিবহন সদর দফতরে একটি ক্যান্টিন চালাতেন। নরেন্দ্র মোদিও সেখানে তাঁর সঙ্গেই কাজ শুরু করেছিলেন। ক্যান্টিনের কনট্র্যাক্ট পেয়েছিলেন আসলে তাঁদের মামা, বাবুভাই মোদি। অম্রুতভাই জানিয়েছিলেন, ক্যান্টিনের কাছে তাঁর এক কামরার একটি বাড়ি ছিল, বড্ড ছোট। স্বাভাবিকভাবেই জায়গা হত না। নরেন্দ্র মোদি তাই ক্যান্টিনে ঘুমাতেন। দিনের বেলা কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় রাজ্যের আরএসএস সদর দফতরে যেতেন। যত কাজই থাক না কেন, যেভাবেই হোক সময় বের করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রবীণ প্রচারকদের সেবা করতে যেতেন। বেশ রাত করেই ক্যান্টিনে ফিরতেন। ক্যান্টিনের টেবিলে বিছানা তৈরি পাততেন। তাঁর আগে ভাইতের পাঠানো রাতের খাবার খেতেন।

অরবিন্দভাই

আরও পড়ুন- “তুমি আমার সঙ্গে গিয়ে করবে টা কী,” কেন যশোদাবেনকে বিয়ের কথা স্বীকার করতে চাননি মোদি?

আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়ার আগে, ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নরেন্দ্রভাই কীভাবে শেষবার অম্রুতভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তাও মনে আছে তাঁর। পারিবারিক জীবন চিরতরে ত্যাগ করার কথা জানিয়েছিলেন মোদি। নিজের ভাইয়ের এমন সংসার ত্যাগ দেখে, অনিশ্চিত জীবিন দেখে আর পাঁচজন স্বাভাবিক দাদার মতোই কষ্ট পেয়েছিলেন অম্রুতভাই, ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি নিজে ছিলেন শান্ত।

দেশের একাংশ বলেন, পরিবারকে ছেড়ে আসা মানুষ দেশ সামলাবেন, এমন ভরসা করা ভুল। অন্য অংশ মনে করেন, পরিবারের বন্ধ ছেড়েছেন বলেই কঠোর হতে পেরেছেন মোদি। স্বজনপ্রীতির যে তির দিয়ে নিকটতম রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসকে বিদ্ধ করেছেন, নিজে আর সেই পথে হাঁটেনই বা কী করে? তবু, প্রশ্ন থেকে যায়। স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ের কথা স্বীকার না করা, পরিবারের দায়িত্ব থেকে বেরিয়ে আসা তাঁকে কঠোর করেছে ঠিকই- আত্মকেন্দ্রিকও কি করেনি?

More Articles