গালে ছুরি থেকেই নাম ফাটাকেষ্ট! এই কালীপুজোয় আসতেন বচ্চনও
Fatakeshto Kalipuja: ফাটাকেষ্টকে ঘিরেই এক ভিন্ন কালীপুজোর ইতিহাস বিরচিত হয় বারবার।
'মারব এখানে, লাশ পড়বে শ্মশানে!' মিঠুন চক্রবর্তীর মুখের এই সিনেমা-সংলাপ বিখ্যাত করেছিল পর্দার ফাটাকেষ্টকে। সিনেমার চরিত্রের লড়াইয়ে মেতেছিল বাংলা! কিন্তু বাস্তবেও ছিলেন এমনই একজন। যাঁর জীবন্ত লড়াই ছিল প্রায় রিলের মতোই। যাঁকে কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল একাধিক কথকতার ভিড়। তাঁকে ঘিরেই এক ভিন্ন কালীপুজোর ইতিহাস বিরচিত হয় বারবার।
কে এই মানুষটি? কী তাঁর ইতিহাস? কীভাবে তিনিই হয়ে উঠলেন বাস্তবের ফাটাকেষ্ট? অমিতাভ বচ্চন থেকে উত্তমকুমার, কেন জড়িয়ে গিয়েছিলেন ফাটাকেষ্টর কালীপুজোয়? একাধিক প্রশ্নের উত্তর দেব আমরা। জানাব ফাটাকেষ্টময় এক যুগের পুজো-ইতিহাস।
ফাটাকেষ্ট কে
১৯৫০ সাল। কংগ্রেস শাসনের বাংলায় উদ্বুদ্ধ হল বামেরা। তীব্র শক্তিতে রাজপথ কাঁপল খাদ্য আন্দোলনের আবহে। এর সঙ্গেই কলকাতার সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের গোকুলে বেড়ে উঠছিলেন কৃষ্ণ। অর্থাৎ কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত। ১৯৭০-৭১ সাল। ফের উত্তপ্ত বাংলা। এবার শিয়রে নকশাল আন্দোলন। দিকে দিকে বোমা-গুলি-রক্ত আর প্রতিবাদের আগুনে পুড়ে খাক একাধিক। ঠিক এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাবার পানের দোকানে বসা ছোটখাটো কৃষ্ণ হয়ে উঠলেন কেষ্ট! নামের সঙ্গে ফাটা জুড়ল অনেক পরে। ওই এলাকার তিনজন কেষ্ট; বিড়ি, ড্রাইভার, পান। এই পানের আবহেই ক্রমশ পরিচিতি পেলেন এই কেষ্ট। যুগে যুগে সাহসী সত্তার আবির্ভাবের উদাহরণ সৃষ্টি করে, খানিকটা কংগ্রেসি রাজনীতির পরোক্ষ সাহায্যে নকশাল বিদ্রোহের আঁচ আটকে দিতে তৎপর হলেন পান-কেষ্ট।
আরও পড়ুন: কীভাবে বাংলায় এল জনপ্রিয় ক্যাপ বন্দুক! অবাক করবে দুর্গাপুজোর এই খেলনার ইতিহাস
একদিন নিজের বাড়ির কাছেই বরাহনগরের কুখ্যাত নীলু-কাণ্ডে, নিজের পাড়ার নকুলের ছুরিতে মুখ কাটল তাঁর। তারপর হাসপাতাল। সেখান থেকে ফিরেই নাম হলো ফাটাকেষ্ট। একবার বোমার আঘাতও হয় তাঁর ওপর। মির্জাপুর স্ট্রিটের গন্ডারের ছোড়া সেই বোমা ফাটেনি সেদিন। বরঞ্চ পাল্টা সেই বোমা ছুড়ে মারেন কেষ্ট!
এই কেষ্ট, অনুব্রত মণ্ডলের মতো গরু-কয়লা পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন না। কিন্তু গুন্ডামি, ধনীদের ভয় পাওয়ানোয় ওস্তাদ ছিলেন তিনি। যদিও নাইট শো থেকে মেয়েদের ঘরে ফেরা থেকে শুরু করে এলাকার নারী নিরাপত্তায় দারুণ নজর ছিল তাঁর। নিজের দলের ছেলেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, মহিলাদের যেন কোনও অসুবিধা না হয়।
বিয়ে করেছিলেন পালিয়ে। কথিত আছে, সেই লুকিয়ে বিয়ের পর বউমাকে নাকি স্বয়ং আশীর্বাদ করেছিলেন উত্তমকুমার! সোমেন মিত্র, কংগ্রেস। বাম। সব মিলিয়ে মধ্য কলকাতার অলিগলিতে মুখরিত হত ফাটাকেষ্টর নাম।
ফাটাকেষ্টর কালীপুজো
একদা বাঘে-গরুতে জল খেত যাঁর নামে, যাঁর নামে কাঁপত একটা এলাকা সেই ফাটাকেষ্টর কালীপুজোর বহর বাড়তে থাকে নকশাল আমল থেকেই। পরাক্রমশালীর এই কালীপুজো এমন এক উৎসব হয়ে গিয়েছিল যে, সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে তা যেন ছিল, কলকাতার বিখ্যাত কোনও ক্লাবের বিরাট দুর্গাপুজোর মতো। এই পুজো নিয়ে যেমন তারকা-সংযোগ ছড়িয়ে আছে। ঠিক তেমনই এই পুজো নিয়ে আছে নানান কথকতাও।
গাঢ় নীল রঙের মাতৃ প্রতিমার দৈর্ঘ্য হয় বিরাট। যে রীতি পালিত হয় এখনও। সাবেকি প্রতিমার গয়না, নাকছাবি নিয়েও রয়েছে ইতিহাস। এই প্রতিমার ভাসান ছিল দেখার মতো। বহরে এখন অনেকটাই কমেছে ঠিকই, কিন্তু ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে এখনও গুরুত্বপূর্ণ রয়েছে এই পুজো।
শোনা যায়, এই পুজোর সময় নাকি ভরে পড়তেন মহিলারা। একবার এক মহিলা বলেন, 'আমাকে (কালী) ছোট গ্লাসে জল দিস কেন!' সেই থেকে বড় গ্লাসে জল পান দেবী। আবার বিসর্জনের দিন বিরাট ব্যান্ড পার্টি আর লাইট সহযোগে শোভাযাত্রার সময় এক মহিলা ভরে পড়েন। তিনি জানান, 'আমাকে কাঁধে করে নিয়ে চল গঙ্গায়।' তারপর নাকি ওই বিরাট মূর্তি বহনে প্রচুর লোক লাগে। আবার এক মহিলার ভরে পড়ে লাল শাড়ি পরানোর আবদারও রাখতে হয় একবার।
ফাটাকেষ্টর পুজোয় তারকা-যোগ
ঠিক যে যে কারণে এই পুজো বিখ্যাত। তার মধ্যে অন্যতম এই পুজোর সঙ্গে তারকা-যোগ। উত্তম কুমার তো একবার নাকি বলেই ফেলেন, এই পুজো তাঁরও। আর তারপরেই উত্তম-পুত্রের দোকানের সামনে বোমা পড়ে। মারা যান এক মহিলা। তখন নকশাল আন্দোলন চলছে জোরকদমে। এই পুজোয় প্রতিবার উত্তম কুমারের যাতায়াত ছিল। আর সেই কারণেই মহানায়কীয় ছোঁয়ায় তখন বাদ যাননি টলিউডের অভিনেতা থেকে পরিচালক কেউ-ই। তারকা দেখতে এই পুজোয় ভিড় জমত আরও। একবার ১৯৮২ সাল নাগাদ মধ্যরাতে মঞ্চে উঠে গান গান আশা ভোঁসলে!
বিদেশ থেকে শুরু করে মুম্বই। দাউদ ইব্রাহিমের মতো না হলেও ফাটাকেষ্টর কালীর প্রভাব ছিল সর্বত্র। মূল পুজোর পিছন দিক থেকে ঢুকতেন তারকারা। রাজেশ খান্না, বিনোদ খান্না থেকে আরডি বর্মন। সমকালীন প্রায় কেউ-ই বাকি ছিলেন না ওই পুজোয় আসতে।
ফাটাকেষ্ট-অমিতাভ-নাকছাবি
পরিচালক দুলাল গুহর যাতায়াত ছিল ওই অঞ্চলের এক পানের দোকানে। ঠিক সেই সূত্রেই ফাটাকেষ্ট প্রবেশ করলেন গ্র্যান্ড হোটেলে। তখন অমিতাভ বচ্চন কলকাতায় এসেছেন 'দো আনজানে' ছবির শুটিং করতে। ফাটাকেষ্ট তাঁর ঘরে উপস্থিত হয়েই বলে ফেললেন, 'কবে যাবেন আমাদের পুজোয় বলুন!' বিস্মিত অমিতাভ রাজি হলেন। রাত দশটায় উপস্থিত হবেন পুজোয়। সেই মতো গাড়ি এল। অমিতাভ গেলেন ফাটাকেষ্টর পুজোয়। সংলাপ বললেন। দর্শকদের সামনে থাকলেন বহুক্ষণ। এর মধ্যেই কালী মূর্তির সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক মিনিট। এর পরে ফাটাকেষ্টর কালীর জন্য হিরে বসানো নাকছাবি পাঠান বিগ বি। যার মূল্য ছিল সেই সময়েই ৭৫ হাজার টাকা।
এক সময় 'নমকহারাম' ছবির সংলাপও এই পুজোয় গিয়ে বলেছেন অমিতাভ। যদিও এই নাকছাবি চুরি যায় পরে। একদিন ভোরে মঞ্চ ফাঁকা হতেই মূর্তির মাথার চুলের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে পাড়ার একটি ছেলে চুরি করে। পরে ধরা পড়লেও বেচে দেওয়া নাকছাবি ততক্ষনে গলিয়ে ফেলেছেন স্যাঁকরা। যদিও এর পরিবর্তে সোনা দেওয়া হয়েছিল সেদিন।
সোমেন মিত্র-ফাটাকেষ্ট বিবাদ
সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের এই পুজো এবং সোমেন মিত্রের পুজো। যার অবস্থান ছিল আর্মস্ট্রিটে। এই দুই পুজোর মধ্যে ছিল ঠান্ডা লড়াই। কার পুজোর বহর কতবেশি, তাই নিয়ে একটা সময় চলত টানাপড়েন। ১৫ দিন ধরে প্রতিমা থাকত প্যান্ডেলে। এমন একটা অবস্থা ছিল, একে অন্যের তুলনায় প্রতিমা একদিন বেশি রাখতে পারলেই যেন যুদ্ধজয় হত! ফাটাকেষ্টর পুজোর ভাসান ছিল বিরাট। বহু আলোকের সমারোহ। বাজনা। সমগ্র মধ্য, উত্তর কলকাতার একটা বড় অংশ প্রদক্ষিণ করে এই পুজোর ভাসান হত। আবার সোমেন মিত্রের এলাকায় এই ঠাকুর পৌঁছলে তিনিই প্রণাম করতেন। ফাটাকেষ্টর সঙ্গে আলিঙ্গন করতেন। অনেকেই বলেন, ফাটাকেষ্টর বাড়ন্তে হাত ছিল সোমেন মিত্র-বিরোধী কংগ্রেসের একটা গোষ্ঠীর!
ফাটাকেষ্টর পুজো এবং বিতর্ক
একবার কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা আনায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। নকশাল আন্দোলনে স্তব্ধ হয় সব। সেবার সোমেনের পুজোর ঠাকুরও আটকে যায়। কিন্তু ফাটাকেষ্ট প্রতিমা আনেন বিতর্ক কাটিয়ে। আবার বিসর্জনে একই সমস্যা হয় একবার। সেবারও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নিরঞ্জন হয় প্রতিমার। তখন প্রায় রোজ অভিযোগ উঠত, সমাজবিরোধীদের মদত দিচ্ছে কংগ্রেস সরকার। তাই এই বাড়াবাড়ি! যদিও তিনি কোন অর্থে সমাজবিরোধী ছিলেন, তা নিয়ে এখনও চলে তর্ক।
এদিকে ওই পুজোয় বহু শিল্পীর উপস্থিতি। লাখ লাখ টাকার যোগান নিয়ে প্রশ্ন উঠত বারবার। একাধিক বার পুলিশের সমস্যাও বাড়িয়ে দিতেন ফাটাকেষ্ট। অপরাধের ক্ষেত্রেও নাম জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর। স্ত্রী নিয়েও একবার বিতর্কের কেন্দ্রে এসেছেন তিনি। আবার বাম-শাসনে কংগ্রেস ঘনিষ্ঠতা কমেছে ফাটাকেষ্টর। ক্রমশ এগিয়ে গিয়েছেন লালের দিকে।
ফাটাকেষ্টর প্রভাব
অনেকেই বলেন, এত তারকা সমাগম বা উত্তম কুমারের যোগ আসলে ভয়ের ফলেই। কারণ, অনেকেই জানতেন ওই সময়ে এমন কোনও লোকের সঙ্গে না থাকলে বিপদ আসতে পারে ঘনিয়ে! বিশেষভাবে কংগ্রেস, পরে বাম আমলে সিপিআইএম ঘেঁষা হয়েছিলেন ফাটাকেষ্ট। তাঁর পুজো চলত রাজনৈতিক সমর্থনেই। আয় কমেছিল ক্রমশ। কিন্তু প্রভাবে তিনিই ছিলেন সেই সময়ের সেরা।
ফাটাকেষ্ট-অবসান
তিনি ঠিক কতটা অবদান রেখেছেন সমাজে, এই নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই বলা যায়, তিনিই এমন এক ব্যক্তি ছিলেন যাঁর অপরাধ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও নারীর প্রতি ব্যবহার ছিল নিষ্কলঙ্ক। ফাটাকেষ্ট শুধু কালীপুজোয় বিখ্যাত নন, তিনি এক্ষেত্রেও ছিলেন অনন্য। এই লোকটি, যাঁর মৃত্যু হতে পারত বোমা, গুলি অথবা ছুরির আঘাতে। সেই লোকটি মারা গেলেন হৃদরোগে। ১৯৯২ সালে। তারপর থেকেও পুজো হয়। ফান্টাদের হাত ধরে আজও জেগে ওঠে দীপাবলির উৎসব। কিন্তু তিনি আর নেই! তাই জাঁকজমক হারিয়েছে এই পুজোও। শুধুই রয়ে গিয়েছে ইতিহাস আর ফেলে রাখা কিছু স্মৃতি।