আব্বু, তোমার চোখভরা গর্ব আর হাসি মাখা মুখখানি দেখার অপেক্ষায় আছি...
Father's Day 2023: এখনও ঠিক মনে আছে আব্বুর বলা সেদিনের শব্দগুলো, "মন দিয়ে পড়াশোনা করবা। ঠিক আছে? জীবনে এগিয়ে যাবা।"
প্রিয় আব্বু,
কেবলমাত্র ভাষার একটি ক্রিয়া বা বিশেষ্য নও, বাংলা ভাষার ব্যঞ্জনবর্ণের ব এবং স্বরবর্ণের আ থেকে গড়ে উঠা সাধারণ শব্দটির সঙ্গে অসাধারণ আবেগের নাম তুমি 'বাবা'।
বাবা সেই আবেগ যে আবেগে আমার মতোই বাকি সন্তানরা বাবাদের মুখে সর্বদা হাসি দেখতে চায় এবং নিজের পদোন্নতি দিয়ে সুদূর ভবিষ্যতের হাজারও স্বপ্ন দেখে, তাতেই বাবারা গর্বিত। বাবা সেই স্বস্তির নাম যেখানে সন্তান যত বড়ই হোক না কেন বাবার আঙুল ধরে পথ চলতেই যেন শান্তি। বাবা শব্দটির ইংরেজি মানে হয়তো, কমপ্লেক্স ইন টার্মস অব ইমোশন। এই ধরো, বাবার বকা খেয়ে মুখ ফুলিয়ে রাখাটা আবেগ। তারপর আবার নিজেই অপেক্ষা করো কখন বাবা অভিমান ভাঙাতে আসবে। সঙ্গে করে তোমার প্রিয় খাবারটি নিয়ে আসবে। ছুটির দিনে বাবার সঙ্গে সময় কাটানো, চিড়িয়াখানায় ঘুরতে যাওয়া, চকলেট খাওয়ার বায়না করা- সবই ছোটবেলার আবেগ। যখন সন্ধেবেলায় কলিং বেলের আওয়াজ শুনতেই ছুটে গিয়ে দরজা খোলো আর অফিস থেকে বাড়ি ফেরা ক্লান্ত বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তখন তাঁর অক্লান্ত সেই হাসির আবেগ ভাষায় বলে বোঝানোর মতো নয়। তোমার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য বাবার অজস্র পরিশ্রম এবং তোমার মুখে হাসি ফোটাতে তাঁর হাজারও কষ্টের বিনিময়ে মুখ ফুটে বাবাকে একবার ধন্যবাদ বলতে চাওয়া খুশির আবেগ। আবার সেই 'ধন্যবাদ' বাবার সামনে বলতে না পেরে মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখাটাও অদ্ভুত এক আবেগ।
৮ বছর পর সেদিনের স্মৃতি আজও স্পষ্ট। ১০ বছরের ছোট্ট আমি বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে ১,৮১৬.২ কিলোমিটার দূর ভারতের দিল্লিতে চলে আসি পড়াশোনা করতে। ওইদিন ঢাকা ছেড়ে আসার সময় বাবার সেই মলিন মুখের জলভরা চোখ এবং জোর করে হাসার চেষ্টা কখনও ভুলব না। বাবাকে আমি আব্বু ডাকি। এখনও ঠিক মনে আছে আব্বুর বলা সেদিনের শব্দগুলো, "মন দিয়ে পড়াশোনা করবা। ঠিক আছে? জীবনে এগিয়ে যাবা। আমার চিন্তা করবা না। আমি যেখানেই থাকি না কেন আমার দোয়া তোমার সঙ্গে সব সময় থাকবে।"
বয়স কম ছিল বলে গুছিয়ে কথা বলতে শিখিনি তখনও। চুপ করে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় শুধু 'হ্যাঁ' বলেছিলাম সেদিন আব্বুকে।
"নিজের খেয়াল রেখো আব্বু। আর… তুমি দেখবে একদিন আমি পরিশ্রম করে কিছু একটা হয়ে দেখাব যাতে তোমার বুক গর্বে ফুলে ওঠে।" কথাগুলো এতটাই ফিশফিশিয়ে বলেছিলাম যে আমি ছাড়া কেউই শুনতে পায়নি সেদিন।
সেদিন অনেক চেষ্টা করেও আব্বুকে কথাগুলো বলতে পারিনি, জানি না কেন। তাঁর সকল পরিশ্রম যে শুধুমাত্র আমাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার জন্য, এটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে না উঠতেই দেখলাম ঢাকা থেকে কলকাতা পৌঁছনোর বাসটা ছেড়ে দিয়ে বেশ সামনে চলে এসেছে, বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা আব্বুকে আর দেখতে পেলাম না।
পড়াশোনার ব্যস্ততায় এই ৮ বছরে ঢাকা যে খুব যেতে পেরেছি তা নয়। তার মানে এই না যে তোমার চোখের সামনে থেকে একসঙ্গে সময় কাটাতে না পারার শূন্যতা বুঝি না। যখনই মন খারাপ হয়, তোমার বলা সেদিনের কথাগুলো মনে করে নিই। এটাও কখনও বলিনি তোমাকে আব্বু।
সবেই দ্বাদশ শ্রেণি শেষ করলাম। জানি আরেকটু সময় লাগবে আমার তোমার কাছে ছুটে এসে বলতে, "পেরেছি আব্বু! আমি পেরেছি! আকাশের সবথেকে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি হতে পেরেছি!" এটা শুনতেই, গর্বে জ্বলে উঠা তোমার চোখদুটো আর হাসি মাখা মুখখানি দেখার অপেক্ষায় আছি।
তোমার মেয়ে ঠিক নিজের লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে, এইটুকু বিশ্বাস তোমার বরাবরই ছিল, রয়েছে। জানি তোমার ত্যাগের সামনে ধন্যবাদ শব্দটি অনেক ছোট তবু আজ বাবা দিবসে তোমার মুখোমুখি বসে বলতে চাওয়ার প্রবল আকাঙ্খার নিশ্চুপ আবেগ নাড়া দিয়ে বলছে তোমায়, ধন্যবাদ আব্বু।