কাল আর্জেন্টিনা, আজ জার্মানি! এই বিশ্বকাপ কি অঘটনের
FIFA World Cup 2022: জার্মানির হার জাপানের কাছে, এই বিশ্বকাপ কি অঘটনের?
হাফ টাইমের চাকা গড়িয়ে ম্যাচ তখন একটু একটু করে শেষের পথে যাচ্ছে। এক গোলে এগিয়ে আছে চারবারের বিশ্বজয়ী জার্মানি। প্রতিপক্ষ জাপান। ধারে ভাঁড়ে অনেকটাই এগিয়ে জার্মানরা। হঠাৎই খেলার বোর্ড উল্টে গেল। ৭৫ মিনিটে জাপানের রিটসু দোয়ান পরাস্ত করলেন নিউয়ারকে। আর ৮৩ মিনিটে অঘটনটা ঘটিয়েই দিলেন তাকুমা আসানো। একজন ডিফেন্ডারের প্রতিরোধ উপেক্ষা করেই ফের জার্মানির গোলে বলটা জড়ালেন। অতিরিক্ত সময়ের সাত মিনিটের মরিয়া চেষ্টাও কাজে এল না। এবারের বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্বেই আরও একটি অঘটনের সাক্ষী থাকল। সৌদি আরবের ফের এশিয় দলের কাছে পরাস্ত হল ফুটবল বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ। তাহলে কি এবার অঘটনই ভবিতব্য? দর্শক ও ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে গুঞ্জন চলছে সমান উদ্যমে।
গুঞ্জন হওয়াটাই স্বাভাবিক। গতকাল, অর্থাৎ মঙ্গলবারের ম্যাচটাই ধরুন। সৌদি আরবের সামনে মেসি, এবং আর্জেন্টিনা। সদ্য কোপা আমেরিকা জিতে আসা, এরপর ফাইনালিসিমায় ইউরোজয়ী ইতালিকে হারিয়ে আসা একটি দল। টানা ৩৬টি ম্যাচে কোনও দল হারাতে পারেনি নীল-সাদা জার্সিদের। তার উপর দলে রয়েছেন লিওনেল মেসি, পাবলো ডিবালা, ডি মারিয়া, এমিলিয়ানো মার্তিনেজের মতো খেলোয়াড়। সেই আর্জেন্টিনাকেই একেবারে শক্ত গাঁটে বেঁধে রাখল আরব্য রজনীর দেশের খেলোয়াড়রা। ২-১ গোলে জয় ছিনিয়ে নিয়ে গ্রুপ টেবিলের শীর্ষেও নিজেদের নিয়ে গেল। তারপরই জার্মানির হার। ফলাফল সেই একই, ২-১। বিপক্ষ জাপান, যারা ফিফা র্যা ঙ্কিংয়ে ২৪তম স্থানে থাকা একটা দল। তারাই কিনা হারিয়ে দিল নিউয়ার, গোমেজদের জার্মানিকে? ম্যাচ দেখতে দেখতেও হয়তো অনেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না অনেকে।
আরও পড়ুন : বারবার বাজিমাত! লেভ ইয়াসিন থেকে কান, ফিরে দেখা বিশ্বকাপের গোলরক্ষকদের
অবশ্য এবারের বিশ্বকাপে দেখলে এমন অঘটনই বারবার চোখে পড়বে। জাপান-জার্মানির আগের ম্যাচটাই ধরুন। গতবারের বিশ্বকাপের রানার্স-আপ ক্রোয়েশিয়ার বিশ্বকাপ অভিযান শুরু হল। লুকা মদ্রিচ, পেরিসিচ, ক্রামারিকের মতো খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি একটি শক্তিশালী দল। প্রতিপক্ষ ছিল উত্তর আফ্রিকার একটি দেশ, মরক্কো। সেই ম্যাচেও দেখা গেল আন্ডারডগদের দাপট। ম্যাচের ফলাফল? গোলশূন্য ড্র।
তাহলে কি এবারের ফুটবল বিশ্বকাপ আন্ডারডগদের? নাকি বড় দলগুলির মধ্যে কোনওরকম সমন্বয়ের অভাব? অবশ্য এটাও ঠিক, বিশ্বকাপ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। এখনও অনেক খেলা বাকি। বরং এসবের মধ্যে না গিয়ে একটা ছোট্ট প্রশ্ন বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে ফুটবল বিশ্বে ‘আন্ডারডগ’ তকমাটির আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে? কাটার বিশ্বকাপ এই প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসেছে। তথাকথিত ছোট দলগুলির এমন উত্থানের কারণ কী? এমন ভয়ডরহীন ফুটবল অবশ্যই দৃষ্টিনন্দন, উত্তেজনাপূর্ণ। কিন্তু এমন ঘটনার কারণ কী?
আরও পড়ুন : এভাবেও প্রতিবাদ সম্ভব! ম্যাচে হেরেও ইরানকে যেভাবে জিতিয়ে দিল নিস্তব্ধ জাতীয় সংগীত
জার্মানি-জাপান ম্যাচের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ভাবনা সহজে মাথায় আসবে। এর আগে জার্মান দলে ফিলিপ লাম, বাস্তিয়ান সোয়াইনস্টাইগার, মিলোস্লাভ ক্লোসের মতো খেলোয়াড়রা ছিলেন। সেই পুরনো বিশ্বজয়ী দলের মধ্যে টিকে আছেন গোলরক্ষক নিউয়ার, ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের নায়ক মারিও গোমেজ, টমাস মুলার। অন্যান্য খেলোয়াড়রাও নিজেদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিভাবান। কিন্তু সেই ঝাঁঝটা কি কোথাও হারিয়ে আছে? উপরন্তু বিশ্বকাপজয়ী কোচ জোয়াকিম লো-ও এখন আর এই দলে নেই।
অন্যদিকে কেবল ফুটবলই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন খেলায় এখন ঢুকে পড়েছে প্রযুক্তি। ক্রিকেটে ডিআরএস থেকে শুরু করে ফুটবলে ভিএআর টেকনোলজি, ম্যাচ পরিচালনার ব্যাপারটা আরও তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রায় প্রতিটি দলেরই অন্যতম মূল পুঁজি ডেটা অ্যানালিসিস ও টেকনিকাল অ্যাসিসটেন্স। এর ফলে বিপক্ষের শক্তি, দুর্বলতা সহ নানা খুঁটিনাটি উঠে আসছে মনিটরে। সেইসঙ্গে প্রশিক্ষণেও এসেছে অত্যাধুনিক সব নিয়মকানুন। সব মিলিয়ে দেখেশুনে দল পরিচালনা ও দল সাজানোর কাজে হাত দিতে পারেন কোচেরা। শুধু এই বিশ্বকাপের বিচারে দেখলে হয়তো একটু ভুল হবে। বিগত বেশ কয়েকবছরের পরিসংখ্যান দেখুন। ক্লাব ফুটবল থেকে আন্তর্জাতিক স্তর, সব জায়গায় প্রযুক্তি অন্যতম হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার অন্যতম উদাহরণ আর্জেন্টিনা বনাম সৌদি আরবের ম্যাচটি। প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনা রীতিমতো অফসাইডের জালে জড়িয়ে পড়ে। একের পর এক অফসাইডে নাকানিচোবানি খেতে থাকেন লিও মেসিরা। যার মূল প্রেক্ষাপটে ছিল ভিএআর বা ভার টেকনোলজি।
আরও পড়ুন : মেসির জারিজুরি শেষ তাঁর সামনে! সৌদির গোলকিপারকে চেনেন?
তবে এবারের কাতার বিশ্বকাপে অন্যতম প্রধান জায়গায় থাকবেন গোলরক্ষকরা। জার্মানি-জাপান ম্যাচে দু’পক্ষের গোলরক্ষকরাই সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে খেলার চেষ্টা করেছেন। জার্মানির পোস্টের নিচে ম্যানুয়েল নিউয়ার বরাবরের ভরসার হাত। বিশ্বের অন্যতম সেরা গোলরক্ষকের সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়েছেন জাপানের শিউচি গন্ডা। গোটা ম্যাচে আটটা গুরুত্বপূর্ণ সেভ করেছেন। সেইসঙ্গে জাপানের ডিফেন্স ক্লিয়ারেন্সের সংখ্যা ৩৭। অন্যদিকে সেই পরিসংখ্যানেই জার্মানির ক্লিয়ারেন্স মাত্র ৩। লক্ষ্যের বাইরেও বেশি শট মেরেছেন জার্মান বোম্বাররা। পাশাপাশি পোল্যান্ড বনাম মেক্সিকো ম্যাচে একা কুম্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ৩৭ বছরের গুইলেরমো ওচোয়া। পরবর্তী ম্যাচে অবশ্যই ওচোয়ার দিকে নজর রাখবেন ডি মারিয়া, মেসিরা। সৌদি আরবের গোলরক্ষক মহম্মদ আল ওয়েইসের খেলাও নিশ্চয়ই অনেকদিন মনে থাকবে দর্শকদের। মনে থাকবে অসামান্য সব গোললাইন সেভ।
আরও পড়ুন : ‘ছোটো’ টিমের কাছে হেরে ভূত মেসির আর্জেন্টিনা! এই বিশ্বকাপেও ট্র্যাজিক পরিণতি?
সবশেষে, ‘আন্ডারডগ’ তকমাটাই এবার হয়তো উঠিয়ে দেওয়ার দাবি জানাতে পারেন দর্শকরা। ফুটবল ও টেকনোলজির মেলবন্ধনে এখন সমস্ত কিছুই প্রায় সবার কাছে পরিষ্কার। তাই এমন প্রবল বিক্রমে খেলা চলছে। আমরাও সেই খেলা দেখতে দেখতে উত্তেজিত হয়ে পড়ছি। হয়তো হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে গরম চায়ের কাপ। একপাক্ষিক খেলায় কি এমন উত্তেজনা থাকত? সেয়ানে সেয়ানে টক্কর হলেই হয়তো আসল খেলা শুরু হয়। ‘দু’বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না’ এই মন্ত্রই তো একজন খেলোয়াড়ের মধ্যে সেই স্পর্ধা নিয়ে আসে। মাঠের মধ্যে দেখতে পাই সেই স্পার্ক, সেই ম্যাজিক। তাহলেই আমাদের রাত জাগা হয়তো সার্থক হবে। সার্থক হবে আমাদের প্রতিদিনের লড়াই। শূন্য থেকে শুরু করে বারবার ফিরে আসা, জিতে ফেরার ক্ষমতা- দিনের শেষে এই বিধ্বস্ত পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে এগুলোই তো খানিক সাহস দেয় আমাদের। তাই না?