কাকে বলে 'গুড ইন্ডিয়ান'? বলিউড যেমনটা দেখায়, আর বাস্তব যা বলছে
সবশেষে আয়ুষ্মান খুরানার মুখ দিয়ে 'ভারতমাতা কি জয়' বলিয়ে, অনুভব সিনহা আদতেই সেই 'উরি', 'কাশ্মীর ফাইলস'-এর পাশে 'অনেক'-এর নাম বসিয়ে দিলেন।
ভারতের মানচিত্রের উত্তর-পূর্বে আটটি রাজ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে 'নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া'। দেশের এই অংশের সঙ্গে দেশের সমতল অংশের যোগাযোগ বেশ খানিকটা খটোমটো। তা আজকের বা কালকের ঘটনা নয়। এ এক সুদীর্ঘ সময়কালজুড়ে চলে আসছে। তবে বিষয় হলো, এই 'সমস্যা' বা 'জটিলতা', যে চোখেই দেখি না কেন, তার সমাধান বা সেই অর্থে এই জটিলতার উৎস-র দিকে কোনওকালেই দৃষ্টিপাত করা হয়নি। না করেছে দেশের সরকার, না করেছে 'মূলধারার' গণমাধ্যমগুলি। কোনওখানেই নিজেদের আওয়াজ পৌঁছে দিতে পারেননি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীরা। ফলে, দিনে দিনে সে সম্পর্ক যেন জটিলতর রূপ-ই ধারণ করেছে।
ক'মাস আগে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি হিন্দি ছবি 'অনেক' সেই জটিলতা নিয়েই চর্চা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই ছবিটির বিষয়বস্তু মূলত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। অনুভব সিনহা পরিচালিত এবং আয়ুষ্মান খুরানা অভিনীত এই ছবিটির মূলে রয়েছে নর্থ ইস্টের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলির সঙ্গে দিল্লি সরকারের শান্তিচুক্তির কাহিনী। ছবির গল্পে আয়ুষ্মান খুরানা একজন পুলিশের গোপন অফিসার। যে আত্মগোপন করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুলিশি অপারেশনে অংশগ্রহণ করে। ছবিতে তাঁর নাম আমন, তবে গোপনীয়তা রক্ষার্থে সে 'জ্যশুয়া' নাম ব্যবহার করে। জ্যশুয়ার মূল কাজ হলো বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা টাইগার সাঙ্গা-কে ভারতরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে বসতে বাধ্য করানো। সঙ্গে সঙ্গে নর্থ ইস্টের বাকি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলিকেও ভারতরাষ্ট্রের দখলে রাখা।
অন্যদিকে রয়েছে আইডো, একটি আঞ্চলিক মেয়ে। যে বক্সিং-এ ভারতের হয়ে খেলতে চায়। তবে তার বাবা ওয়াঙ্গনাও ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সে মনেপ্রাণে একথা বিশ্বাস করে যে, ভারত তাদের দেশ নয়। তাই সে 'জনসন' নাম নিয়ে নতুন করে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। পিতা-কন্যার এই বিবাদ ছবিতে সহজেই ধরা পড়ে যায়। ওয়াঙ্গনাও-রা টাইগার সাঙ্গার সঙ্গে দিল্লির যে শান্তিচুক্তি, তার বিরোধিতা করে আক্রমণের ছক কষা শুরু করে। আর ওয়াঙ্গনাও-কে ধরার এই সুযোগ যাতে হাতছাড়া না হয়, তার জন্য 'জ্যশুয়া' আইডোর সঙ্গে একপ্রকার প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করে। কাহিনির কিছু ঘোরপ্যাঁচ বাদ রাখলে, মোটের ওপর আখ্যান এমন করেই এগোয়।
আরও পড়ুন: Film Review: গৃহহিংসার চাপা অন্ধকারে আলো ফেলল আলিয়া ভাটের ‘ডার্লিংস’
তবে আমাদের আলোচ্য বিষয়, এই ছবির রাজনীতি। যেখানে পরিচালক ছবির শুরুতেই এলাকার নামটি 'নর্থ ইস্ট' বলে বড় বড় অক্ষরে স্ক্রিনে হাজির করে। কতকটা যেন 'নর্থ ইস্ট' ভারতের নতুন কোনও রাজ্য। একথা আরও জোরালোভাবে মনে হতে থাকে, যখন ছবিতে ব্যবহৃত প্রতিটি গাড়ির নাম্বার প্লেটে বড় বড় অক্ষরে 'NE' লেখা দেখা যায়। যেখানে আমরা জানি যে, দেশের আটটি রাজ্যকে মিলিয়ে নর্থ ইস্ট গঠিত। সেখানে 'নর্থ ইস্ট'-কে একটি রাজ্য হিসেবে হাজির করা হলে তা অবশ্যই ভুল বার্তা পৌঁছয়। শুধু ভুল বার্তাই নয়, ছবির উদ্দেশ্য-ও যেন খানিক বিঘ্নিত হয়।
যেখানে অনুভব সিনহা ছবির শুরু থেকে শেষ অবধি 'এক মে আনেক' বলে ভারতের বৈচিত্র্যময়তার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, সেখানে আটটি রাজ্যকে একটি রাজ্যে 'ফিট' করে দেওয়ার ভাবনা আদতেই সমতলভূমির অধিবাসীদের 'নর্থ ইস্ট' সম্পর্কে যে সমস্ত ভ্রান্ত ধারণা, তার-ই প্রতিচ্ছবি মাত্র।
অরুণাচল প্রদেশ, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, সিকিম, মিজোরাম, আসাম, মেঘালয়, মণিপুরকে নিয়ে 'নর্থ ইস্ট' গঠিত। নাগাল্যান্ড সরকারের অফিশিয়াল পোর্টাল থেকে জানা যাচ্ছে যে, শুধু নাগাল্যান্ডে ১৭টি জনগোষ্ঠীর বসবাস। এই ১৭টি জনগোষ্ঠীর মধ্যেও আবার ভাগ রয়েছে। অন্যদিকে মণিপুরে রয়েছে ৩৩টি জনগোষ্ঠী। ত্রিপুরাতে ১৯টি, সিকিমে ৩টি, অরুণাচল প্রদেশে ২৬টি, মিজোরামে ৫টি, মেঘালয়ে ১৭টি। আসামে ১৪টি সমতলভূমি জনগোষ্ঠী আর ১৫টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী। এখানে একথাও খেয়াল রাখা দরকার যে, এই প্রতিটি রাজ্যের প্রতিটি জনগোষ্ঠীই কিন্তু পরস্পরের থেকে ভাষাগত দিক থেকে, পোশাকের দিক থেকে, খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে ভিন্ন। তাই এদের এক কাপড়ে মুড়ে হাজির করা অন্যায়। তা অসম্মানের। তা ভুল। এই আচরণ আদতে 'এক মে আনেক'-এর বার্তা বহন করে না।
'মাইলস্টোন লোকালাইজেশন'-এর একটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়ার আটটি রাজ্যকে মিলিয়ে, সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে ২২০টি ভাষা ব্যবহৃত হয়। সেখানে এই ছবির সংলাপে মাত্র দু'টি বাক্য রয়েছে মণিপুরীতে আর বাকি কয়েকটি নাগামিজে। বাদবাকি সব হিন্দিতে। আর একটি নাগা লোকসংগীত। ব্যস! এছাড়া আর নর্থ ইস্টের বৈচিত্র্যময়তার ছোঁয়া এই ছবিতে মেলে না।
অন্যদিকে জ্যশুয়া চরিত্রটি যেন উত্তর-পূর্ব ভারতের মুক্তিদূতের মতো হাজির হলো। সমতলভূমির 'অভিজ্ঞ' 'জাতীয়তাবাদী', 'মাসকুলিন' এবং 'সৎ' অফিসার। যে আঞ্চলিক মানুষের কথা পৌঁছে দেওয়ার দায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। এই চরিত্রটি যেন সিনেমাজুড়ে এক অদ্ভূত 'সুপিরিয়র' বোধ নিয়ে ঘুরে বেড়াল। এটা এমনই একটা চরিত্র, যাকে এক বাক্যে মূলধারার ছবির নায়ক-ও বলা চলে না। বেশ খানিকটা যেন অনুভব সিনহার সেই পরিচিত 'সৎ অফিসার'-এর ধারণা। যা 'আর্টিকল ফিফটিন' থেকে চলে আসছে। যেখানে একজন ব্রাহ্মণ হয়ে উঠল দলিতদের মুক্তিদূত। আর এখানে একজন সমতলভূমির মাসকুলিন জাতীয়তাবাদী যুবক হয়ে উঠল পাহাড়ি জনজাতির কণ্ঠস্বর। জ্যশুয়া চরিত্রটিকে যেন উত্তর-পূর্ব ভারতের যে দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস, তাকে আড়াল করতেই হাজির করা হলো।
ছবির প্রচারের সময় একাধিক সাক্ষাৎকারে পরিচালক একথা দাবি করেছিলেন যে, তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্র মূলধারার ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে চান। যাতে দেশের বাদবাকি অংশ উত্তর-পূর্ব ভারতের সমস্যা নিয়ে ভাবিত হয়। তবে যা আক্ষেপের, তা হলো, এতশত দাবি করার পরও নর্থ ইস্টের সমগ্র রাজনৈতিক চিত্রটি সামনে আনলেন না অনুভব সিনহা। খানিকটা যেন পিঠ বাঁচিয়ে পালিয়ে গেলেন।
নর্থ ইস্টের একটা দীর্ঘদিনের সমস্যা আফস্পা। তার প্রসঙ্গ ছবিতে মাত্র একবার শোনা গেল টাইগার সাঙ্গার মুখে। তাও এক ভুল তথ্যসমেত। সেখানে টাইগার সাঙ্গা দাবি করেন যে, নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়াতে ১৯৪৭ সালে আফস্পা লাগু করা হয়েছিল। তবে তথ্য অন্য কিছু বলছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে একবারে ১৯৪৭-এ আফস্পা লাগু করা হয়নি। তা ভাগে ভাগে করা হয়।
এই ছবিতে বাদ পড়ে গেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে যে আফস্পা বিরোধী আন্দোলন চলেছে, তার চিত্র। এক দীর্ঘ সময়জুড়ে আফস্পার বিরুদ্ধে মানুষ স্বর চড়িয়েছেন এই রাজ্যগুলিতে। অতি সম্প্রতি ২০২১-র ৪ ডিসেম্বর, নাগাল্যান্ডে ছ'জন খনিশ্রমিককে জঙ্গি ভেবে খুন করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী। তারপর গোটা নাগাল্যান্ড ফের আরেকবার উত্তাল হয়ে ওঠে আফস্পাবিরোধী আন্দোলনে।
এই আফস্পা রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীকে যে বাড়তি ক্ষমতা দেয়, তার ফলে দীর্ঘদিন বহুরকম অত্যাচারের শিকার হয়েছেন উত্তর-পূর্ব ভারতের অধিবাসীরা। থাঙ্গজাম মনোরমার অসহনীয় হত্যার কথা আজ আর অজানা নয়। ৩২ বছরের থাঙ্গজাম মনোরমাকে ১১ জুলাই, ২০০৪-এ আসাম রাইফেলস হত্যা করে। পরবর্তীতে তাঁর হত্যার প্রতিবাদে ইম্ফলের আসাম রাইফেলসের হেড কোয়ার্টারে মণিপুরী নারীরা উলঙ্গ হয়ে প্রতিবাদে নামেন। সেই প্রতিবাদও ছিল আফস্পার বিরুদ্ধে।
তবে 'অনেক' ছবিতে সেসব ছবি গায়েব হয়ে গেল। ভাবটা যেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশে এগুলি মামুলি কিছু ঘটনামাত্র। না দেখালেও চলে। অনুভব সিনহা উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে ছবি করতে গিয়ে, সেই রাজনৈতিক পরিবেশটাকেই বাতিল করে দিয়েছে ছবি থেকে। ছবিটা সেই সমস্যার মূলে না গিয়ে, ইতিহাসের দিকে নজর না দিয়ে, ভাসা ভাসা ভাবে কিছু জিনিস ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। ছবিটা এককথায় অসম্পূর্ণ।
অন্যদিকে আইডো-র কাহিনিটাও সেই এক গোলাকার বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। যেখানে আইডো-কে ভারতের জন্য খেলে একথা প্রমাণ করতে হয় যে, সে তার দেশকে কতটা ভালবাসে। ছবিজুড়ে অনুভব সিনহা যে ফাঁদটি এড়ানোর চেষ্টা করেছেন, বারবার তাতেই গিয়ে পড়েছেন। দেশে চর্চিত যে 'গুড ইন্ডিয়ান'-এর সংজ্ঞা, তাকেই মজবুত করেছেন পরিচালক আইডোর চরিত্রের মধ্য দিয়ে। যেখানে আইডো-কে প্রতি ধাপে তার দেশের প্রতি ভালবাসা, আনুগত্যের প্রমাণ দিয়ে যেতে হয়।
সবশেষে আয়ুষ্মান খুরানার মুখ দিয়ে 'ভারতমাতা কি জয়' বলিয়ে, অনুভব সিনহা আদতেই সেই 'উরি', 'কাশ্মীর ফাইলস'-এর পাশে 'অনেক'-এর নাম বসিয়ে দিলেন। এই ছবি আর নতুন কিছুই নয়। সেই একই চর্বিতচর্বন। যে ফাঁদ টপকানোর স্বপ্ন দেখেছিল, সেই ফাঁদেই পড়ে রইল 'অনেক'।