পুলিশ এলে সতর্ক করে দিতেন মালিক, নেতাজির প্রিয় এই দুই হোটেল আজও সুখাদ্যর ঠিকানা

Netaji: কলেজ স্ট্রিট এলাকার দুটো দোকানের সঙ্গে নেতাজির নাম জড়িয়ে রয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই লড়ছে, সেখানেই অন্য প্রতিষ্ঠানের সুনাম এবং ব্যবসা আগের থেকে অনেকটা ফুলেফেঁপে উঠেছে।

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু । মহান দেশনায়কের নাম শুনলেই আমাদের মনে আসে স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদানের কথা। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেতাজির নাম জড়িয়ে রয়েছে । নেতাজির নাম শুনলে প্রথমেই খাবারের দোকানের কথা আমাদের মনে না এলেও কলেজ স্ট্রিট এলাকার দুটো দোকানের সঙ্গে নেতাজির নাম জড়িয়ে রয়েছে। বহু বছর অতিক্রম করে বর্তমানে যেখানে একটি প্রতিষ্ঠান নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই লড়ছে, সেখানেই অন্য প্রতিষ্ঠানের সুনাম এবং ব্যবসা আগের থেকে অনেকটা ফুলেফেঁপে উঠেছে।

কলেজ স্ট্রিটের খুব কাছেই রয়েছে শতবর্ষ অতিক্রম করা ফেভারিট কেবিন। ঠিকানা ৬৯, সূর্য সেন স্ট্রিট। ১৯১৮ সালে তৈরি হওয়া এই ফেভারিট কেবিনকে প্রথম দেখায় হাল ফ্যাশনের ক্যাফেতে যাওয়া মানুষের পছন্দ নাও হতে পারে। আলো-আঁধারের মধ্যে থাকা ছোট এক জগৎ। পুরনো কয়েকটা মার্বেল টপ টেবিল ঘিরে বসার জন্য রয়েছে কয়েকটা পুরনো আমলের অনুষ্ঠান বাড়িতে দেখতে পাওয়া লোহার চেয়ার এবং কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার। মেনু বলতে বেশি কিছু নেই। চা, লেবু চা, টোস্ট, কেকের মতো কিছু পদ খুবই অল্প দামে পাওয়া যায়।

ফেভারিট কেবিনের মালিকানা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পরিবারের হাতে থাকার কারণে এখানে নিরামিষ কেক বিক্রি করা হয়। এই একই কারণে ডিম অথবা মাংসের কোনও পদ মেনুতে নেই। ফেভারিট কেবিনে নিয়মিত যাতায়াত করা মানুষরা বলেন, বিশাল কয়লার উনুনে তৈরি হওয়ার কারণে এখানকার টোস্টে একটা আলাদা স্বাদ পাওয়া যায়। ফেভারিট কেবিনের আগত মানুষের সংখ্যা বর্তমানে কমে গেলেও এই জায়গাটার একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।

আরও পড়ুন: পরমহংস রামকৃষ্ণ থেকে নেতাজি: সকলের প্রিয় তেলেভাজার দোকান ছড়িয়ে এই শহরেই

স্বাধীনতা সংগ্রামের সশস্ত্র বিপ্লবী থেকে কল্লোল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বহু বিখ্যাত মানুষ এবং পরবর্তীকালে বহু স্বনামধন্য মানুষ এখানে আসতেন। তাদের মধ্যে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, কাজি নজরুল ইসলাম, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শিবরাম চক্রবর্তী কিছু উল্লেখযোগ্য নাম। কথিত আছে যে, নেতাজি এবং পরবর্তীতে কাজি নজরুল ইসলামের জন্য এখানে তাঁদের পছন্দের টেবিল রাখা হতো। 'যুগান্তর' পত্রিকায় ফেভারিট কেবিন সম্পর্কে লেখা হয়েছিল। লোকমুখে শোনা যায় যে, স্বদেশি আন্দোলন এবং পরবর্তীতে এই কেবিনের তিনটে ভাগ করা হয়েছিল। বাইরের দিকে দরজার সামনে সাধারণ মানুষের বসার জায়গা, বাইরে থেকে দেখা যায় না, সেইরকম একটা জায়গা বিপ্লবীদের জন্য এবং রান্নাঘর। দোকানের মালিক দোকানের আশপাশে পুলিশের লোক দেখলে ক্যাশ কাউন্টার থেকে বিপ্লবীদের নানা পদ্ধতিতে সতর্ক করে দিতেন। নেতাজির নাম জড়িয়ে থাকা এই ফেভারিট কেবিন নিজের সুনাম এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

কলেজ স্ট্রিটের কাছেই শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বহু মানুষকে নিজের বাড়িতে তৈরি বাঙালি খাবারের মতো প্রায় সমান স্বাদের খাবার পরিবেশন করে চলেছে স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল। ৮/২, ভবানী দত্ত লেনের বাড়িটার একতলায় এই হোটেলের ১৯২৭ সালে পথচলা শুরু হয়েছিল। সেই সময় এই হোটেলের নাম ছিল শুধু হিন্দু হোটেল। স্বাধীনতার পর নামের পরিবর্তন হয়ে স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল হয়ে যায়। রোজ সকাল সাড়ে দশটা থেকে বিকেল চারটে এবং সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে দশটা অবধি এই হোটেল খোলা থাকে।

খুব আহামরি নয়, বরং ঘরোয়া বিভিন্ন পদ পরিবেশন করেই এই প্রতিষ্ঠান নিজের সুনাম অর্জন করেছে। বিভিন্ন রকমের ডাল, আলু, পটল, বেগুন ভাজা, পুঁইশাকের চচ্চড়ি, বরবটির ডালনা, উচ্ছের চচ্চড়ি, ধোকার ডালনা, মাছের ডিমের বড়া, বিভিন্ন রকমের মাছের ঝোল, ঝাল, মাংস এবং বিভিন্ন রকমের চাটনি। পাইস হোটেল হওয়ার কারণে মেনুর বদল ঘটলেও ঘুরেফিরে একই ধরনের বিভিন্ন পদ এখানে পাওয়া যায়। বহু বছর অতিক্রম করেও আজও কলাপাতায় ভাত এবং মাটির বড় ভাঁড়ে জল দেওয়া হয়। ভাতের সঙ্গে বিভিন্ন পদ বাটিতে দেওয়া হয়। বাংলার বিভিন্ন পাইস হোটেলের মতো নিয়ম মেনেই এখানে দাম ঠিক করা হয়। যেমন, প্রথমবারের ভাতের দাম পঁচিশ টাকা হলেও তার পরে ভাত চাইলে একহাতা ভাতের দাম হয় পাঁচ টাকা।

কথিত আছে যে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এই হোটেলে খেতে আসতেন এবং এই হোটেলের পুঁইশাকের চচ্চড়ি তার খুব প্রিয় পদ ছিল। নেতাজি ছাড়াও অন্য বহু বিপ্লবী এই হোটেলে খেতে আসতেন। দোকানের মালিক পুলিশ দেখলে বিপ্লবীদের বিপদ সংকেত দিয়ে দিতেন, যাতে তাঁরা পুলিশের হাতে ধরা না পড়েন। স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলে আজও প্রথা মেনে স্বাধীনতা দিবস, বাংলা নববর্ষ, দোলযাত্রা, পুজোর সময় কিছু বিশেষ পদ পরিবেশন করা হয়।

স্বাধীনতার ৭৫ বছরের দোরগোড়ায় পৌঁছে বহু বছর চলার পথে দু'টি প্রতিষ্ঠানের বহু সমর্থক এবং সমালোচক তৈরি হয়েছে। সমর্থকদের প্রশংসা এবং সমালোচকদের সমালোচনা- উভয় সঞ্চয় করেই দু'টি প্রতিষ্ঠান আজও হাসিমুখে মানুষকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে খাবার পরিবেশন করে চলেছে।

 

More Articles