দ্রাবিড় শিখিয়েছেন: যত্ন করে হারতে শেখাটাও জরুরি
World Cup Cricket 2023: খুব মনে পড়ে দ্রাবিড়ের সেই ব্র্যাডম্যান ওরেশনে বলা কথাগুলো। বলেছিলেন, ‘লার্ন টু ফেল ওয়েল’।
আচ্ছা আমরা ঠিক কোথায় পিছিয়ে গেলাম? বা কখন, খেয়াল পড়ে? এই যে আমরা, বাঙালিরাই আর কী, শুধু লিখে গেলাম, একটা ক্রিকেটের খেলাকে এমন তারে বাঁধলাম, যেন প্রায় মহাকাব্যের পটভূমিকায় হয়ে যাওয়া মরণবাঁচন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে চমৎকার লিখলামও হয়তো কিন্তু ফ্যাক্ট অফ দ্য ম্যাটার ইজ, আমরা শুধু লিখেই গেলাম আর আমাদের লড়াইগুলো লড়ে গেল অন্যেরা। কেন? কারণ অন্যেরা (আমাদের) মনে সুন্দর আর আমরা মোবাইল ফোনে? তারপর সে লড়াইয়ে আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম মুখে রক্ত তুলে সূচাগ্র মেদিনী না দেওয়ার পণ, চাকা বসে যাওয়া সত্ত্বেও শ্বাসরুদ্ধ অসিযুদ্ধ, কপালগুণে পেয়ে যাওয়া অশ্বমেধের ঘোড়া আর একান্তই সে সব লগ্নছুট হলে নিজেরাই মগনলাল সেজে অদৃশ্য কোনও অর্জুনকে ডেকে ‘অযোগ্য’ আঙ্কলজিকে সটান দাঁড় করিয়ে একের পর এক নাইফবাজি।
না, মানে আমাদের ঠিক আটকাল কোথায়? আটকাল কে? আমি বা আমার মতো একজন কেন নেই আজ মোটেরায়? এবং খেয়াল করে দেখুন, কত বছর ধরে নেই আমরা। স্যরি, এখানে সংকীর্ণতা, প্রাদেশিকতা ইত্যাদি দেখতে যাবেন না (দেখলেও আমার বয়ে গেছে, কারণ সেসব নেই)। এবং না, আমার ক্রিকেট বা অন্য কোনও খেলাকে জীবনের গাথা করে নেওয়াতে ও তাতেই হাবুডুবু খাওয়াতেও কোনও আপত্তি নেই, থাকলেও বা পাত্তা দিচ্ছে কে? কিন্তু খটকা আছে, বিরক্তি আছে, মাঠে না নামাতে, এক রকম না নামতে চাওয়াতেও। অসহ্য লাগা আছে বঞ্চনার ঢালে শান দেওয়াতে, মজ্জাগত এই অজুহাত খাড়া করাতে। সমস্যাটা কি ছোটবেলায় ঘুমপাড়ানি গানের আধিক্যে? কে জানে এত রূপসায়রে ভিজলে হয় কিনা। আর যদিও বা হয়, আমাদের হলো না কেন? সর্বক্ষণ দেখো, লিপ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। আরে ভাই হোয়াই! গতর নাড়িয়ে নাম না কোদাল হাতে। এমনও তো নয় যে, ফার্স্ট জেনারেশন বিপ্লবী। বিপ্লবের যে বর্ণময় ইতিহাস প্রায় ঘরে ঘরে ব্যাটারি চাপা দেওয়া ক্যালেন্ডারে ঝুলত, তা দেখেই তো আজ এত হ্যাজ নামাচ্ছি। তা বলে, হ্যাজ থেকে প্রকৃত কাজে গিয়ে উঠতে পারব না? শেমফুল কিন্তু।
আর তাই, বাঙালি অপু হবে। স্যরি, অপুর মতো হতেও তো দম লাগে। আমরা জাস্ট ওই রোম্যান্টিকতাটুকু দইয়ের ওপরের ভাগ ভেবে চেঁছে নেব। বাঁশি বাজাব, দূরে নদী দেখতে দেখতে আর বালিশের নীচে এক্সপেক্ট করব স্ত্রী সিগারেটের রাংতায় লিখে রেখেছে, জাস্ট একটা খাওয়ার কথা। কিন্তু তারপর, সেই স্ত্রীর হঠাৎ মৃত্যু নিতে পারব তো? দিদির জ্বরে নিভে যাওয়া দাঁড়িয়ে দেখতে পারব তো? একটা নিশ্চিন্দিপুর নাকি নিশ্চিন্তিপুর বলি, ছত্রাখান হয়ে যাওয়া সামলে ফেলতে পারব তো?
আরও পড়ুন: খেলার ভিতরে এত বিদ্বেষ, ভাবিনি কখনও
ছাই পারব। আরে, পাড়ায় চোর সন্দেহে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে রাখা ছোকরাকে যখন হাতের সুখ করে পেটায় সবাই, লুকিয়ে পুলিশে একটা ফোন পর্যন্ত করার ধক নেই, আবার নজরুলের গানের বাজে সংস্করণ হয়েছে কোন এক বলিউডি ছবিতে, তাই নিয়ে মাথা জল ঢালা প্রতিরোধ কমিটি। আমি জানি, সেল্ফ ক্রিটিকাল হওয়া, বাঙালি হয়ে নিজেদেরই গালি দেওয়া এখন একটা ভাল প্রফেশন প্রায়, মন্দ কাটতি নেই, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ ঠিক করছি না। আসলে আমার প্রবলেমটাও হয়েছে, পশ্চাৎদেশে লাথি মেরে বা ঘাড়ে ধরে বা নিদেনপক্ষে প্রবল অপমান করে আমায় কেউ ঘেঁটে দিচ্ছে না। হ্যাঁ মানে, কোনও লেখার জন্য খামোখাই যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ট্রোলড হতে হয় সোশ্যাল মিডিয়াতে, তাকে মানুষই মনে করছি না। আমি বলছি, আমার, আমাদের কি প্রপার অপমান কম পড়িয়াছে। ঠিক কীসে, রগটা যাবে ফেটে? ক্রিকেট নিয়ে, আজকের ফাইনাল নিয়ে তখনও মহাকাব্য করব, সেটা সত্যিই ক্ষমতা কিন্তু একই সঙ্গে যদি চেষ্টাও করি, ওই মহাকাব্যিক পরিসরে একটু হলেও ঢুকে পড়ার, জাস্ট একটা চেষ্টা, কোথায় ক্ষতি। আমাদের এত দর্শক হতে, বাইস্ট্যান্ডার হয়ে থাকতে কেন যে প্রাণ আনচান?
এখানটাই বোধহয়, অন্তত আমার মনে হয় রাহুল দ্রাবিড়ের মতো একজন অন্য একটা পথ দেখান। বা, ওকে, পথ দেখান হয়তো বড় স্টেটমেন্ট হয়ে যাচ্ছে, বলি, আমি তাঁর পদক্ষেপের ভিতর দেখতে পাই/দেখতে পছন্দ করি, একটা হাতড়ে যাওয়া। খুঁজে ফেরা। মধ্যবিত্ত ভীরুতার মধ্যেও যেখানে জেগে থাকে একটা অল্প দরজা ফাঁক করে বেরোতে চাওয়া। যে গিয়েই দেখি না, হোক না বেলা, এত বড় বাজার, একটা পদের মাছ পাব না? (আমি কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে লিখতে গিয়ে খামোখাই রোম্যান্টিক হচ্ছি না।) দ্রাবিড় বা তাঁর মতো করে যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা নিশ্চিত ইনিশিয়াল আশার পর যদি বাজার থেকে কিছুই না পেয়ে ফিরে আসেন, মোটেও মুখ ভার করে থাকবেন না। কারণ, দ্রাবিড় শেখান, ট্রাস্ট দ্য প্রসেস। হ্যাঁ ফলের আশাই করবে, কেউ বলছে না, কর্ম করে যাও ফলের আশা ছেড়ে, দ্রাবিড়পন্থা বলে, নিজেকে সময় দাও, অন্যের থেকে সময় চেয়ে নাও। চাইবে কেন? দুরন্ত ফলের আশা করছ বলেই তো। প্রাণপণ আশা করছ বলেই তো। এই খুঁজে ফেরার মধ্যে গ্ল্যামার নেই, কারণ যে খোঁজে, সে তো টার্গেট মিসও করে একাধিক। দ্রাবিড়ও করেছেন, আমাদের সবাইকেই করতে হয়। তাতে গ্লানি হবে কেন? পাথর ভাঙাতে কবে থেকে বাঙালির এত লজ্জাবোধ এল?
খুব মনে পড়ে দ্রাবিড়ের সেই ব্র্যাডম্যান ওরেশনে বলা কথাগুলো। বলেছিলেন, ‘লার্ন টু ফেল ওয়েল’। এই যে ফেল করার কথা বলছেন তিনি এবং অসম্ভব যত্ন করে ফেল করতে বলছেন, এই প্রসেসটিকেই কি আমরা আমল দিয়েছি কখনও? নেপথ্যের লজিক খুঁজতে চেয়েছি কখনও? আমাদের ঐতিহ্য, শিক্ষা, সব কিছু ফেল না করাতে। হ্যাঁ ঠেকে শেখা একটা পর্ব আছে বটে কিন্তু তা বলে সাড়ম্বরে ব্যর্থ হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামব? কিন্তু দ্রাবিড়ের প্রসেস বলে, হ্যাঁ আলবাৎ। তোমার কোথাও না কোথাও অন্দরে একটা সিসিফাস থাকবে। সেই পাথর ঠেলে টেলে পাহাড়ে নিয়ে উঠবে আবার পাথর গড়িয়ে নেমে গেলে আবার খেলা শুরু করবে। হ্যাঁ, কেউ কেউ কালের নিয়মেই আর সিসিফাস থাকবে না। সফল হবে, কিন্তু সে এইটা জানবে যে সিসিফাস ঠিক কী করত। দ্রাবিড় নিজে আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, এই দলটিকেও নির্ঘাৎ সে জলে ফেলেছেন।
তাঁর দল কি জানে না যে, তাঁদের কোচ নিজেকেও ডাহা ব্যর্থও বলেছেন। যুক্তি দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, ৬০৪ বার দেশের হয়ে ব্যাট করলাম, তার মধ্যে ৪১০ বার তো ৫০ রানই পেরোতে পারিনি। ফলে আমি তো ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলার বেশ যোগ্য মানুষ! কে বলছেন, না যাঁর টেস্ট ও ওয়ান ডে, দুটোতেই ১০,০০০-এর ওপর রান। মাইন্ডসেটটাই ধরতে পারা মুশকিল। এবং আমার মতে এইটাই একটা মস্ত শিক্ষা দিয়ে যায়, ইফ এনিওয়ান কেয়ার্স টু নোট! ফলে, কেন শামিকে তিনি শুরু থেকে নামাননি এবং কেনই বা শার্দুল খেলছিলেন এবং হার্দিক যাওয়ার পর সেই শার্দুলই বাদ গিয়ে শামি এলেন, সে ব্যাখ্যা আমি-আপনি করতেই পারি, বাক-বিতণ্ডাও কিন্তু দল জানে আর তিনি জানেন, প্রসেসের গোড়ায় কোন চিন্তা কাজ করছিল। এই দল এবং ভারতীয় ক্রিকেটের আরও অনেকেই, এই প্রসেসের খোলনলচে জানেন, আশা। সেটাই ভরসা জোগায় এই তীব্র আকালেও।
কবে থেকে যে কে আমাদের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে গেল যে, স্টেজে মেরে দেওয়াতেই গ্ল্যামার এবং ধক থাকে তো সে পথের পথিক হও বাপধন! আলবাৎ তাতে গ্ল্যামার। কিন্তু আমাদের ছোট থেকে এইটা শেখানো হয়েছে কি, যে প্রথম দশ ওভারে নব্বইয়ের কাছে রান যে দিন উঠবে না আর সবাই যখন বাপের নাম খগেন করে ছাড়বে, সে দিনও মনেপ্রাণে এক অসীম স্থৈর্য যেন বিরাজ করে? এই ভারতীয় দল এবার একই সঙ্গে হাড়হিম করা রিস্কটেকিং এবং ব্যর্থ হওয়ার ভারকে এক ডাঙায় নিয়ে এসে জল খাওয়াতে সক্ষম হয়েছে। কোথাও কি এর জন্য দায়ী, কোচ, ক্যাপ্টেনের ওই মধ্যবিত্ত ভীরুতার মাঝেও দরজা অল্প ফাঁক করার আপ্রাণ প্রয়াস? একটা অন্ধের মতো বিশ্বাস রাখা প্রসেসের শেষমেশ সফল হওয়া? যে প্রসেস বলে, ব্যাপারখানি এমন নয়, যে হয় তুমি হেডলাইন হবে নয় টিকিট কাটা দর্শক। মিডজার্নি একটা স্থানের নাম। সেখানে পৌঁছতে গেলে, প্রবল গতর নাড়াতে হয়। অবশ্য গতর নাড়ানোর আগে, ফোন বন্ধ রেখে, ফোকাস করতে হয়, একটা দিক বেছে নিতে হয় লজিক বুঝে। নিরপেক্ষ একালে খুব সেফ অবস্থান।
আরও পড়ুন: ‘খলনায়ক’ থেকে মহানায়ক! কেন মহম্মদ শামিই ভারতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র?
ও, আবার লজিকেরও ধার ধরতে বলছি। ডিমান্ডের শেষ নেই সত্যি আমার! এনিওয়ে, আজ যাই হয়ে যাক রেজাল্ট, কাল কিন্তু সিম্পলি আর একটা দিন। যদি প্রসেসে বিশ্বাস থাকে, তা হলে, ফাইনাল অলরেডি ইতিহাস। প্রসেসটাই গাঢ় সত্য। আর সে প্রসেস কিন্তু বলে, পরবর্তী দিক বেছে নেওয়ার মুহূর্ত… মোড় ঘুরে বড় রাস্তাতে গিয়ে পড়লেই… রোজ রোজ কিন্তু দূরের এ আর রহমান বা আরও দূরের ইজরায়েল সমস্যা হয়ে আসবে না। আপনার গায়ে যে দিন হাত পড়বে সে দিন কী করবেন? নিরপেক্ষ পিপুফিসু?
তা হলে গুড লাক।
ওকে বাই, যাই, এই লেখাটাই ফেসবুকে স্টেটাস দিই। চারটি লাইক, শেয়ার হোক!
আমার আর রাখাল সাজা হবে কি?