শরীরে নিঃশব্দে বাড়ছে ক্যানসার! এবার যন্ত্র জানান দেবে এক দিনেই
নিউটাউনের ইন্টারন্যাশানাল ইউনিভার্সিটি অফ পাব্লিক হেলথ অ্যান্ড টেকনোলজিতে বসল জিনোম সিকোয়েন্সিং মেশিন, যা এ শহরে প্রথম। জিনোম সিকোয়েন্সিং মেশিন দিয়ে খুব সহজেই কোনো মানুষের সমগ্র জিনের গঠন জানা যাবে, তাও একদিনে। এই মেশিনটির মডেল হল জেনেক্সাস সিকোয়েন্সার, যার নির্মাতা মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের থার্মো-ফিশার নামের একটি বহুজাতিক সংস্থা।
কী লাভ হবে জিন সিকোয়েন্সিং করে?
জিন সিকোয়েন্সিং-এর সাহায্যে জিনের গঠন জানা যায়, তা তো আগেই বলা হল। আমাদের জিনের গঠনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আমাদের আমাদের শারীরিক গঠন থেকে শুরু করে যাবতীয় শারীরিক কাজের রহস্য। শুধু এখানেই শেষ নয়, আমাদের জিনের গঠন দেখে বলে দেওয়া যায় আমাদের বা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানদের কোনো বংশানুক্রমিক অর্থাৎ জিনগত অসুখ হতে পারে কিনা।
জিনগত অসুখের মধ্যে অন্যতম হল ক্যানসার, যা বাবা বা মায়ের পরিবার থেকে বাহিত জিন থেকে সন্তানের শরীরে আসতে পারে। ধরা যাক, বাবার মা, অর্থাৎ ঠাকুমার ক্যানসার আছে, তার পুত্রের তখনও ক্যানসার হয়নি অথচ শরীরে ক্যানসারের জিন রয়েছে। কিন্তু সেই জিন যে উপস্থিত আছে ইতিমধ্যেই পুত্রের শরীরে, তা কেউ টেরও পাননি। জিন সিকোয়েন্সিং করলে কিন্তু ধরা পড়বে পুত্রের শরীরে ক্যানসারের জিনের উপস্থিতি। সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি আগেভাগেই নিজের শরীর নিয়ে সচেতন হবেন। এবং শুধু তাই নয় ওই ব্যক্তির পরবর্তী প্রজন্মের সন্তানদের ক্যান্সার থেকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অনেক আগে থেকেই নিতে পারবেন।
এছাড়াও একাধিক বিরল জেনেটিক অসুখের জন্য দায়ী জিন বা জিনের পরিবর্তন ধরা পড়বে জিনোম সিকোয়েন্সিং-এর মাধ্যমেই। ন্যাশানাল পলিসি ফর ট্রিটমেন্ট অফ রেয়ার ডিজি়জে়র তথ্য অনুযায়ী ভারতীয়দের মধ্যে বিরল জেনেটিক অসুখগুলোর মধ্যে অন্যতম হিমোফিলিয়া, থ্যালাসেমিয়া, সিকল-সেল অ্যানিমিয়া, ইম্যিউনো ডেফিসিয়েন্সি, লাইসোজো়মাল স্টোরেজ ডিসঅর্ডার, গশার্স ডিজি়জ়, সিস্টিক ফাইব্রোসিস প্রভৃতি।
প্রত্যেকটি রোগেরই ফলাফল মারাত্মক। এগুলির ফলে কেবল যে অবর্ণনীয় শারিরীক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তা নয়, এর অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক প্রভাবও সুদূরপ্রসারী।
জিন সিকোয়েন্সিং কী?
এবার আসা যাক আসল প্রশ্নে, তা হলো জিন সিকোয়েন্সিং কী। কিন্তু তার আগে জানতে হবে জিন কী এবং তার প্রাথমিক গঠন কী। জিন হল আমাদের ডিএনএ-এর একটি অংশ, যা এক বা একাধিক শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্যে দায়ী। সোজা কথায় জিন আদতে ডিএনএ বা ডি-অক্সি রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিডের অংশ।
ডিএনএ-তে বা জিনে ক্রমান্বয়ে কতগুলো নাইট্রোজেন বেস সাজানো থাকে। প্রতিটি মানুষের ডিএনএ-তে কোন ক্রমে এই নাইট্রোজেন বেসগুলি সাজানো থাকবে, তা ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই একই। ওই ১ শতাংশ তফাতের জন্যে একটি মানুষ আরেকটি মানুষের থেকে এত ভিন্ন - তাকে দেখতে, তার চলন-বলন, তার শারীরবৃত্তীয় কাজের ধরণ কিংবা অসুখ-বিসুখের প্রকৃতি লক্ষ্যণীয় ভাবে আলাদা।
আরও পড়ুন-হাড়ের চিকিৎসায় এবার নতুন দিগন্ত দেখালেন আইআইটি কানপুরের গবেষকরা
ডিএনএ-এর এই নাইট্রোজেন বেসগুলি কী কী? এগুলি হল অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থিয়ামিন, এবং সাইটোসিন। এগুলি মানুষ নির্বিশেষে একটি নির্দিষ্ট সিকোয়েন্স বা ক্রমে সাজানো থাকে। এই ক্রমই নির্ধারণ করে মানুষটির সমস্ত শারীরবৃত্তীয় কাজ কেমন হবে, এমনকি তাঁর কোনো জটিল রোগ আছে কিনা কিংবা ভবিষ্যতে কোনো রোগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা।
একাধিক জেনেটিক অসুখ থাকে, যা আবার জিনের পাকাপাকিভাবে রাসায়নিক পরিবর্তনের কারণে ঘটে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে মিউটেশন।
জিন সিকোয়েন্সিং করলে ধরা পড়বে মিউটেশন?
মিউটেশন হল জিনের স্থায়ী রাসায়নিক পরিবর্তন। একাধিক জিনগত অসুখের জন্য দায়ী এই মিউটেশন।
মিউটেশন ঘটতে পারে নানান ভাবে। এই যে নাইট্রোজেন বেসের বর্ণনা দেওয়া হল, দেখা গেল একটি বেস জিন থেকে উধাও হয়ে গেছে। বা নাইট্রোজেন বেসের আশাতীত ক্রমের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, অথচ একটি নাইট্রোজেন বেস এসে বসে পড়েছে। কিংবা দেখা গেল পুরো ক্রম বা সিকোয়েন্সটাই ওলোট-পালট হয়ে গেল।
মিউটেশন হলে বোঝা যায় না, যতক্ষণ না অসুখ হচ্ছে। মিউটেশন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বাহিত হয়। জিন সিকোয়েন্সিং যন্ত্রটিতে ধরা পড়ে সেরকম কোনো পরিবর্তন হলে। আগেভাগেই সে ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া যায়।