কেন ফের নতুন করে অশান্তি? কবে শান্তি ফিরবে হিংসাদীর্ণ মণিপুরে?
Manipur Violence: নদীতে দেহ উদ্ধারের ঘটনার পর থেকে অশান্তির আগুনে আরও জ্বলে উঠেছে মণিপুর। মেইতেই খুনের প্রতিবাদে ইম্ফল সংলগ্ন এলাকায় বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছে ওই জনগোষ্ঠীর সদস্যেরা।
ফের জ্বলছে মণিপুর। দিন কয়েক ধরেই নতুন করে আগুন জ্বলতে শুরু করেছে উত্তর-পূর্বের এই ছোট্ট রাজ্যটিতে। দীর্ঘদিন ধরে কুকি মেইতেই গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বে অশান্ত মণিপুর। এ রাজ্যে মেইতেইরা সংখ্যালঘু। তারা চায় তফসিলি উপজাতির স্বীকৃতি। কুকিরা চায় না তেমনটা হোক। তাহলে তাঁদের একচ্ছত্র ক্ষমতার ভাগে ভাগ বসাবে মেইতেইরা। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গোষ্ঠী সংঘর্ষ লেগেই রয়েছে রাজ্যটিতে। ২০২৩ সালের মে মাসে গোষ্ঠী সংঘর্ষে কেঁপে উঠেছিল মণিপুর, হিংসার পারদ চড়েছিল এমন জায়গায় যা কার্যত তা হয়ে উঠেছিল গোটা বিশ্বের মাথাব্যথার বিষয়। যদিও এসব নিয়ে কোনও কালেই তেমন মাথা ঘামায়নি কেন্দ্র সরকার। হিংসাদীর্ণ মণিপুরে একবারও পা পড়েনি প্রধানমন্ত্রী বা তেমন কোনও শীর্ষ নেতৃত্বের। গত বছর থেকে হিংসায় অজস্র মৃত্যু দেখেছে মণিপুর। অজস্র বাসিন্দা ঘরছাড়া, কোনও মতে মাথা গুঁজেছেন শরণার্থী শিবিরে। তবু সেই অশান্ত মণিপুরের মাটি কিছুটা হলেও ঠান্ডা হয়েছিল। গত কয়েকদিনে ফের অশান্তি ছড়িয়েছে রাজ্য জুড়ে। আবার ভয়ঙ্কর জায়গায় পৌঁছেছে দুই গোষ্ঠীর জাতিগত হিংসা।
অশান্তির শুরুটা হয়েছিল গত ৭ নভেম্বর। হামার উপজাতির এক মহিলাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে খুনের অভিযোগ উঠেছিল মেইতেইদের বিরুদ্ধে। তাঁর স্বামীর অভিযোগ , খুনের আগে নাকি ধর্ষণও করা হয় তাকে। ওই মহিলা খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অশান্তির আগুন জ্বলে উঠেছিল জিরিবামে। সেখানে অন্তত ১৬টি বাড়িতে অতর্কিতে আগুন ধরিয়ে দেয় জঙ্গিরা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় নির্যাতিতার বাড়ি। ভয়ে গ্রাম ফাঁকা হয়ে যায়। এর পরেও মণিপুরের বিষ্ণপুর জেলায় আরও এক মহিলা খুনের অভিযোগ ওঠে। জমিতে কাজের সময় মেইতেই কৃষক রমণীকে গুলি করে জঙ্গিরা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। পার্বত্য এলাকা থেকে কুকি জঙ্গির একটি দল এসে এমন করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। এর পর মণিপুরের জিরিবাম জেলায় জিরিবাম জেলায় পর পর হামলার অভিযোগ ওঠে কুকি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে। অসম-মণিপুর সীমান্তে একটি থানায় হামলা চালিয়েছিল কুকি জঙ্গিরা। ওই থানার পাশেই ছিল একটি রিলিফ ক্যাম্প। অনুমান করা হচ্ছে ওই ক্যাম্পটিও জঙ্গিদের নিশানায় ছিল। এর পর থানা থেকে এক কিলোমিটার দূরে জাকুরাডোর কারংয়ে হামলা চালায়। এরই মধ্যে জিরিবামে সিআরপিএফের সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত্যু হয় ১১ জন কুকি জঙ্গির। যদিও কুকি সম্প্রদায়ের দাবি, নিহত ১০ জন ছিলেন ‘গ্রামের স্বেচ্ছাসেবী’। সেই সংখ্যাটা অবশ্য সরকারি খাতায় কলমে। বেসরকারি ভাবে তা বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়। সেই লড়াইয়ে মৃত্যু হয়েছিল এক সিআরপিএফ জওয়ানেরও। আর তার পর থেকেই বেশ কয়েকজন মেইতেই নিখোঁজ বলে শোনা যায়।
আরও পড়ুন: বই সরিয়ে হাতে উঠছে অস্ত্র! জ্বলন্ত মণিপুরে যেভাবে বিপদের মুখে শৈশব
একটি দশমাসের শিশু-সহ মোট তিনটি শিশু এবং তিন মহিলা সদস্যের শিবির থেকে রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা যেন আরও বেশি করে ঘি ঢেলেছিল অশান্তিতে। তার পর থেকেই জ্বলছে মণিপুর। রাজ্যের পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০ কোম্পানি প্যারামিলিটারি ফোর্স পাঠানো হয়। বন্ধ রাখা হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। এরই মধ্যে সেই আগুনকে উস্কে রবিবার জিরিবাম জেলার জিরি নদী থেকে দু’টি দেহ উদ্ধারের খবর মিলেছে। মণিপুর পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, ষাটোর্ধ্ব এক বয়স্কা এবং বছর দুয়েকের এক শিশুর মুণ্ডহীন দেহ নদীতে ভেসে আসে। রবিবার পর্যন্ত জিরিবাম জেলায় মোট ছ’টি দেহ উদ্ধার করা হল। মেইতেই গোষ্ঠীর অনেকেরই ধারণা, ওই সব দেহ নিখোঁজ মেইতেইদের। যদিও আরও একটি অংশের দাবি, নদীতে আরও কিছু দেহ ভেসে আসতে দেখা গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কুকি জঙ্গিদের হাত রয়েছে বলেই অভিযোগ উঠেছে।
নদীতে দেহ উদ্ধারের ঘটনার পর থেকে অশান্তির আগুনে আরও জ্বলে উঠেছে মণিপুর। মেইতেই খুনের প্রতিবাদে ইম্ফল সংলগ্ন এলাকায় বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছে ওই জনগোষ্ঠীর সদস্যেরা। প্রশাসন সূত্রের খবর, শনিবার সে রাজ্যের পূর্তমন্ত্রী গোবিন্দদাস কন্ঠৌজাম, বিজেপি বিধায়ক ওয়াই রাধেশ্যাম, বিজেপি বিধায়ক পাওনাম ব্রজেন, কংগ্রেস বিধায়ক টিএইচ লোকশ্বরের বাড়িতে আগুন ধরানো হয়। সে সময় মন্ত্রী, বিধায়ক এবং তাঁদের পরিবারেরা কেউ বাড়িতে ছিলেন না। ফাঁকা বাড়িতে ঢুকে বিক্ষোভকারীরা প্রথমে জিনিসপত্র ভাঙচুর করেন। বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন বলে অভিযোগ। ইম্ফল পূর্ব জেলার লুয়াংশাংবামে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের পৈতৃক বাড়িতে হামলার অভিযোগও ওঠে। হামলা হয়েছে মণিপুরের স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণমন্ত্রী সাপম রঞ্জন, বিজেপি বিধায়ক তথা মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের জামাই আরকে ইমোর বাড়িতেও। হামলাকারীদের দাবি, জিরিবাম জেলায় ছ’জনকে খুন করায় অভিযুক্ত যাঁরা, তাঁদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে। এরই মধ্যে আবার রবিবার জিরিবাম জেলাতেই নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মৃত্যু হয়েছে বছর কুড়ির এক মেইতেই যুবকের। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেও উত্তেজনা ছড়ায় এলাকায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইম্ফলে জারি করা হয় কার্ফুও। ইম্ফল পশ্চিম, ইম্ফল পূর্ব, বিষ্ণুপুর, চূড়াচাঁদপুর-সহ মোট সাত জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তাজনিত একাধিক বিধিনিষেধও জারি হয়েছে সেখানে। সেনাবাহিনী এবং অসম রাইফেল্সের জওয়ানদেরও এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে। মণিপুরে নতুন করে হিংসা ছড়ানোর পরই সেই রাজ্যে যান সিআরপিএফ-এর ডিজি অনীশ দয়াল সিং। সম্পত্তি ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ইতিমধ্যেই ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে মণিপুর পুলিশ।
নভেম্বর মাস থেকে শুরু হওয়া অশান্তির জেরে মণিপুরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০। যাদের মধ্যে রয়েছে ১১ জন কুকি জঙ্গি রয়েছে বলে। সাম্প্রতিক এই অশান্তির জেরে নেতামন্ত্রীদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি জ্বালানো হয়েছে গির্জা, স্কুল, পেট্রল পাম্প। জ্বলেছে একাধিক বাড়ি-ঘর। ইতিমধ্যেই মণিপুরে নতুন করে হিংসার ঘটনায় ৩টি মামলা দায়ের করেছে এনআইএ। সূত্রের খবর, মণিপুর পুলিশের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে ১৩ নভেম্বর ৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তার তদন্ত শুরু করেছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা। এদিকে এই অশান্তির আবহে মণিপুরের রাজনীতিতেও নয়া মোড়। বিজেপি নেতা তথা মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিল কনরাড সাংমার ন্যাশানল পিপলস পার্টি। দলের সভাপতি কনরাড সাংমা, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডাকে এই সিদ্ধান্তর কথা চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছেন। যেহেতু বহুদিন ধরে অশান্ত মণিপুর এবং রাজ্যের হিংসার পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ মুখ্যমন্ত্রী, তাই এই মতন পরিস্থিতিতে সরকারের তাঁদের পক্ষে থাকা সম্ভব নয় বলে জানায় এনপিপি। এহেন পরিস্থিতিতে শান্তি রক্ষায় ব্যর্থ বলে বিজেপি সরকারকে তোপ দেগে সমর্থন প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী।
মণিপুরের পরিস্থিতি ফের অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠার পরেই নিজের নির্বাচনী প্রচারসভা বাতিল করে তড়িঘড়ি দিল্লি ফেরেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ভোটমুখী মহারাষ্ট্রে রবিবার তাঁর চারটি সভা করার কথা ছিল। কিন্তু শনিবার থেকে মণিপুর আরও অশান্ত হওয়ার খবর পেয়েই বিদর্ভের সভাগুলো বাতিল করে দেন শাহ। নাগপুর থেকেই তিনি ফিরে গিয়েছেন সোজা দিল্লিতে। তার পরেই মণিপুরের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছেন তিনি। ডাকা হয়েছে একাধিক জরুরি বৈঠকও। কেন্দ্র সরকার এই পরিস্থিতিতে নতুন করে ৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীও মোতায়েন করেছে মণিপুরে। দিন কয়েক আগে থেকেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য জারি হয়েছে আফস্পা।
আরও পড়ুন: মণিপুরের বুকে এখনও জমাট চাপ চাপ অন্ধকার
২০২৩ সালের মে মাস থেকে মণিপুর হিংসায় অন্তত ২৫০ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। বাস্তুচ্যুত ৬০ হাজার মানুষ। কবে শেষ হবে মণিপুরের এই রক্তক্ষয়ী অশান্তি? সেই কবে থেকে জ্বলছে মণিপুর। মণিপুর হিংসার আবহে কেন্দ্র সরকারের ভূমিকার বারবার সমালোচনা হয়েছে জাতীয় রাজনীতিতে। অথচ এ নিয়ে তেমন হেলদোল দেখা যায়নি সরকারের মধ্যে। নতুন করে উস্কে ওঠা হিংসাকে কি আদৌ প্রতিহত করতে পারবে মোদি সরকার? নাকি হিংসার আগুন একদিন ছাড়খার করে দেবে গোটা মণিপুরকেই? এ প্রশ্নের উত্তর বোধহয় এতগুলো দিন পরেও একই রকম কঠিন।