বেসনে চুবিয়ে শাপলার ভেলাভাজা! ওপারের হেঁশেলে লুকিয়ে অচেনা রান্নার গন্ধ
Folk culture: এই হেঁশেল-কথন শুনলে খুলে যাবে তুলে রাখা কাপড়ে গিঁট বেঁধে রাখা অনেকদিনের ঘ্রাণ, অনেক গল্পের ভান্ডার।
যে কোনও রান্নাঘর আসলে অনেক অনেক না-বলা কথার কুঠুরি। কাশীরাম যেমন বলেছেন, পুণ্যবানদের মহাভারত শোনার কথা, এই হেঁশেল-কথন শুনলে তেমন পুণ্য হবে কি না জানা নেই, তবে খুলে যাবে তুলে রাখা কাপড়ে গিঁট বেঁধে রাখা অনেকদিনের ঘ্রাণ, অনেক গল্পের ভান্ডার।
প্রতিটা রান্নাঘর আসলে আলাদা। নিজস্ব রূপ, নিজস্ব ভঙ্গিমায় উজ্বল। যদিও যত দিন যাচ্ছে, আস্তে আস্তে অনেককিছুর মতোই সব বৈচিত্র্যহীন হামানদিস্তায় কুটে-পিষে কারা যেন হাওয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। ছাঁচে ফেলা এক রং, এক খাবার, এক পোশাক- একইরকম উৎসব।
যিনি রান্না করছেন, তাঁর নিজস্ব রুচি, নিজস্ব শিল্পকাজ একটু একটু করে প্রতিদিন গড়ে তোলে হেঁশেলের মানচিত্র। ঘুঁটিয়ারি শরিফের যে মুসলিম মহিলা আচারের শিশিগুলিকে জ্যামিতিক কায়দায় পরপর সাজিয়ে রেখে ময়দার ডেলা চিনি দিয়ে মেখে জলে গুলে আগুনের আঁচে পুড়িয়ে রং ধরে আসা সুস্বাদু খাবার তৈরি করল হাসতে হাসতে, তা দেখার মতো জিনিস। বনেদি পুরনো বাড়ির দেওয়াল থেকে চাটাই পেড়ে খেতে দিল। ওই দেওয়ালে ঝুলে থাকা চাটাই খেজুরপাতা চিরে চিরে বানানো, গরম জল ফুটিয়ে কোনওটা আবার হলুদ রঙে রাঙানো। রান্নাঘরে ঝুলে থাকা এই চাটাই ওঁর শাশুড়ির শাশুড়ি তৈরি করত, তারপর তাঁর শাশুড়ি, এখন এই মহিলা তৈরি করেন।
আরও পড়ুন: ম্রিয়মান পটুয়া গান! লোকসংস্কৃতির অন্তর্জলিযাত্রায় লক্ষ্মীর পট, পাঁচালির গান
এ-পারের মানুষদের বাড়িঘর অধিকাংশ সময়েই পাঁচিলঘেরা চারদিকে। কাঁচা পাঁচিল কিংবা ইটের।মাটির পাঁচিল হলে খড়ের টোপর পরানো। রান্নাঘরগুলি ঝকঝকে নিকানো, আঁটোসাটো একটু। ছিটে বেড়ার দিয়ে তৈরি দেওয়ালে ছোট ছোট জানলা। গোয়ালঘরের হাতকয়েক তফাতে টেপাকল। লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছে থানকুনির জঙ্গল। মা ছেলেকে ভাত খাওয়াতে খাওয়াতে গল্প বলছে। সেই বহুদিনের শোনা গল্প। হরিণ আর ইলিশ মাছ দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করলে, হরিণ হেরে যেতেই হরিণের মাংস কেটে ইলিশের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হলো। সেই গল্প সমানে চলিতেছে। রান্নাঘর, খাবার তৈরি- এর পাশাপাশি কিন্তু বয়ে চলেছে গল্পের স্রোতধারা।
ওপার থেকে আসা মানুষদের রান্নাঘরগুলি বেশিরভাগ সময়েই ঢিলেঢালা প্রাণের, শক্তপোক্ত গোছের। যেমন-তেমন করে গড়া মনে হলেও কিন্তু যত্নহীন নয়। ভেতরের অন্দরসজ্জা দেখেও টের পাওয়া যায়, কত বৈচিত্র্য! রান্নার কৌশল, মশলার কৌটো, সবজি কাটার ভঙ্গিতে যে কতরকম অভিনব সব পন্থা। বরিশালের একজন মানুষকে দেখেছি, নারকেলকাঠি শাপলার নরম অংশে গেঁথে গেঁথে ভেলা বা মান্দাসের চেহারা দিচ্ছে। তারপর সেটিকে বেসনগোলায় ডুবিয়ে তেলে ভেজে তৈরি করছে শাপলার ভেউড়া বা শাপলার ভেলাভাজা। ওপার থেকে চলে আসা নদীনালার মানুষটির অবচেতনে কি এভাবে থেকে গেছে জলস্মৃতি? অথবা ভেলা বললেই কিন্তু টান লাগে মনসামঙ্গলে। সেই গাঙুর নদীতে বেহুলার ভেসে যাওয়া লখিন্দরের লাশ নিয়ে। একটি রান্নার পদে মিশে থাকতে পারে কত রঙের সব আশ্চর্য উপাখ্যান।
বিভিন্ন কলোনি অঞ্চলের রান্নাঘর ঘুরলে বা গাঁ-গেরামের রসুইঘর একটু মন দিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, কীভাবে ধীরে ধীরে বদল ঘটে গেছে এই দশ-কুড়ি বছরের মধ্যে।
যেমন করেই হোক, রান্নাঘরের মেঝেতে টাইলস বসাতেই হবে- এমন অলিখিত নিয়ম কী করে যে গেঁড়ে বসল কে জানে। গ্যাস এসে গেছে বহুদিন। ফিল্টার ও ফ্রিজের জল অবশ্যই খাওয়া দরকারই, পতঞ্জলি প্রোডাক্টের রান্নায় ব্যবহৃত জিনিসপত্র একশো শতাংশ খাঁটি ও রোগ উপশমকারী, কুঁজো-কলসি আসলে গরিবচিহ্ন- এমন সব ধারণা ঘুরে বেড়ায় বাতাসে বাতাসে। ঠিক কবে থেকে কীভাবে যে চারিয়ে গেল এইসব সুখের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত জিনিসপত্র, তা আর স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়!
রান্নাঘরগুলি থেকে বনজ-উপাদান প্রায় লুপ্ত। একটা মাটির খোলায় মুড়ি ভাজা হচ্ছে, আগের দিন যত্ন করে নিকিয়ে রাখা হয়েছে উনুন, গরম চাল থেকে সাদা সাদা ফুলের মতো মুড়ি ছিটকে ছিটকে উঠছে, তপ্ত বালিতে মুড়ি তৈরি করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে নারকেল কাঠি।চুড়িপরা হাত নারকেলকাঠি হাতে মুড়ি ভাজতে গিয়ে এমন সব অপরূপ মুদ্রা তৈরি করত, তা আর নেই।
ডাল ঘোঁটার হাতায় দেখেছি নারকেলমালাইয়ের ব্যবহার, অনেক ভিখিরি চা খেত এতে, শিলে মশলা পেষা হচ্ছে সুপুরিগাছের খোল যত্ন করে কেটে মশলাকুরুনি তৈরি হলো, দড়ি দিয়ে তৈরি হলো শিকা, জিনিসপত্র ঝুলিয়ে রাখতে, এইসব হাতে বানানো, গাছের কাছ থেকে পাওয়া জিনিসপত্র উবে গিয়ে এখন দখল নিয়েছে বাজার মাত করা চোখধাঁধানো জিনিসপত্র। ফেলো কড়ি মাখো তেল, অত ঝক্কি কে আর পোহাচ্ছে বাপু!
এই করতে গিয়ে আমরা হারিয়ে ফেললাম আমাদের নিজস্ব মুদ্রা, তাজা কিছু সুগন্ধ, অবাক-উপাখ্যান।আমাদের হেঁশেল থেকে হারিয়ে গেল আমাদের চিরায়ত গানগুলি।