ভারতে হু হু করে বাড়বে তাপপ্রবাহ, ধ্বস নামবে অর্থনীতিতেও? যে আশঙ্কা দানা বাঁধছে
Heat Wave: ভারত আগামী কয়েক দশকে ঘন ঘন তাপপ্রবাহের শিকার হবে, বৃদ্ধি পাবে সাধারণ মানুষের হয়রানি।
২০২০ সালের আগে কতগুলি গ্রীষ্মে আপনি শিরোনামে বারবার 'তাপপ্রবাহ' শব্দটি দেখেছেন বা শুনেছেন? বিশ্ব উষ্ণায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও খুব একটা বেশি কথা শোনা গিয়েছে বলে মনে হয় না। যদিও বিজ্ঞানীরা তিন দশক আগে থেকে আমাদের সতর্ক করার চেষ্টা করেছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই কেউ পাত্তা দেননি। তবে বিগত দুই-তিন বছরের বিভিন্ন বিপর্যয় ছবিটা সামান্য হলেও পাল্টেছে। কিন্তু আমরা কি অনেক দেরি করে ফেললাম? উত্তরটা হলো, হ্যাঁ।
কেন দেরি হয়েছে, সেই আলোচনায় আসার আগে আলোকপাত করা যাক বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি রিপোর্টে। যাতে রয়েছে ভারতের জন্য এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা। কী আছে সেই রিপোর্টে? বিশ্ব ব্যাঙ্ক মনে করছে, আগামী দিনে তাপমাত্রার পারদ এতটাই চড়তে চলেছে, তাপপ্রবাহ এতটাই চরম রুপ নিতে চলেছে যে, তা মানুষের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাবে। শুধু মানুষের প্রাণহানি, স্বাস্থ্যহানি হবে না, সেই সঙ্গে অর্থনীতিও আক্রান্ত হবে চূড়ান্তভাবে।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট 'Climate Investment Opportunities in India's Cooling Sector'-এ বলা হয়েছে, দেশে গ্রীষ্মের আগমন স্বাভাবিকের অনেক আগে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, গ্রীষ্মের দাবদাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। চলতি বছরেই মার্চে তাপমাত্রার পারদ বেড়ে গিয়ে ১২২ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে, এই পারদের বৃদ্ধি পাওয়া এর বিপর্যয় হিসেবে গণ্য হবে না। তা পরিণত হবে স্বাভাবিকে।
আরও পড়ুন: লকডাউন তুললেই করোনায় আক্রান্ত ২০ লাখ! চিনে প্রমাদ গুণছেন স্বয়ং চিকিৎসকরাই….
এই রিপোর্টে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, ২০২১ সালের অগাস্টের জলবায়ু পরিবর্তনের মূল্যায়নের বিষয়টিও। সেখানেও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ভারতীয় উপমহাদেশ আগামী কয়েক দশকে ঘন ঘন তাপপ্রবাহের শিকার হবে, বৃদ্ধি পাবে সাধারণ মানুষের হয়রানি।
২০২২ সালে শুধু হয়রানি হয়নি, ভারতে মৃত্যু হয়েছে হাজার হাজার মানুষের। সরকারিভাবে যে মাসে গ্রীষ্ম শুরু হয়, অর্থাৎ এপ্রিল মাস, সেই সময়ে দিল্লির পারদ ছিল ৪৬ ডিগ্রির ঘরে। শুধু দিল্লি নয়, দেশের বেশিরভাগ অংশই প্রকৃতির এই রোষের শিকার হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের এই রিপোর্ট বলছে, এই সবে শুরু। কার্বন নিঃসরণের হার না কমলে ২০৩৫ থেকে ২০৬৫ সালের মধ্যে ভারতজুড়ে তাপপ্রবাহের হার বাড়বে ২৫ গুণ। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাবে তার স্থায়িত্ব।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে বিপর্যয়গুলি আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে, তার একটি বিশাল দিক হলো অর্থনীতি। যা নিয়ে খুব আশ্চর্যজনকভাবেই অর্থনীতির কারবারিরাই আলোকপাত করেন না। যদি সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসের কথাই বলা হয়, তাহলে দেখা যাবে, পাকিস্তানের বন্যার কারণে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কয়েক হাজার কোটি ডলার। ভারতেও বিভিন্ন সময়ের ঘূর্ণিঝড়, তাপপ্রবাহ, বন্যা, দাবানলের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, এই হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সবথেকে বেশি আক্রান্ত হবে দেশের উৎপাদনশীলতা। দেশের শ্রমশক্তির ৭৫ শতাংশ মানুষ কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে এবং বেশিরভাগই কাজ করেন চূড়ান্ত তাপের মধ্যেই। এই হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি হতে থাকলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পেতে বাধ্য। বিশেষ করে ভারী শ্রমের যে-সমস্ত কাজ রয়েছে। দেশ সবথেকে বেশি ধাক্কা খাবে পরিকাঠামো তৈরি এবং তার উন্নয়নের কাজে। সেই সঙ্গে ধাক্কা খাবে কৃষিকার্য। রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে কাজ হারাবেন আট কোটিরও বেশি মানুষ, যার মধ্যে ভারতেরই প্রায় সাড়ে তিন কোটি শ্রমিক থাকতে পারেন।
প্রভাব পড়তে চলেছে দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য নিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তাতেও, কারণ প্রলম্বিত তাপপ্রবাহ দেশের হিমঘরের পরিকাঠামোকে ভেঙে দিতে পারে। সেই সঙ্গে কৃষিকাজ তো ব্যাহত হবেই।
ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টিং সংস্থা ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানি জানাচ্ছে, তাপপ্রবাহের কারণে যে হারে উৎপাদনকার্য ব্যাহত হবে তাতে দেশের জিডিপি হ্রাস পাবে প্রায় ৪.৫ শতাংশ, যা অঙ্কের হিসেবে দাঁড়ায় প্রায় দেড়শো থেকে আড়াইশো মার্কিন ডলার।
কিন্তু এই ধরনের রিপোর্ট তো বিজ্ঞানীরা প্রতি মাসেই প্রকাশ করছেন। কিছু লাভ হচ্ছে কি? হচ্ছে কি কোনও কাজের কাজ? উন্নয়নের দোহাই দিয়ে প্রকৃতি ধ্বংস হওয়াও বন্ধ হচ্ছে না, কমানো হচ্ছে না জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারও। নতুন কয়লাখনি চালু করার উদ্যোগ চলছে। এ কি দেশের মানুষকে বার্তা দেওয়া? যে দেশের মানুষকে এই তাপমাত্রা সহ্য করার ক্ষমতা তৈরি করে নিতে হবে? সরকার, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তাদের মতো মুনাফা লুটে নেবে? তাদের জন্য তো শীতাতপনিয়ন্ত্রণ রইলই। আজকাল রাজনৈতিক নেতারা ভাষণ দেওয়ার সময়েও মঞ্চের পিছনে সেই যন্ত্র দেখা যায়। সাধারণ মানুষের তো কাজই সহ্য করা। তারা সেটা করে নেবে।