দুর্ভিক্ষের সময় তৈরি গোলকধাঁধা! কেন একা কেউই বেরোতে পারেন না ভুলভুলাইয়া থেকে?
Myths of Bhool Bhulaiya: ভুল ভুলাইয়া এমনভাবে তৈরি যে আপনি যদি ৫০ মিটার দূরে কোনও দেশলাই জ্বালান তার শব্দ সুস্পষ্ট শুনতে পাবেন।
প্রাচীন গন্ধ পেতে হলে যেতে হবে উত্তরপ্রদেশ। কতদিন সেই গন্ধ রাজনৈতিক কারণে আর পাওয়া যাবে তা অবশ্য বলা মুশকিল, তবু রাজধানী লখনউ এখনও নবাবদের নির্মিত অনেক স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক বিস্ময়কে আঁকড়ে রেখেছে নিজের দেহে। নবাবি খানা, উর্দু ভাষার মিষ্টি সম্ভাষণে 'মুস্কুরাইয়ে, আপ লখনউমে হ্যায়' কতদিন ঠিক বলা বা শোনা যাবে জানা নেই। শুধু জানা আছে, ঐতিহ্যকে ভাঙতে গেলে ঐতিহ্যকে, তার ইতিহাসকে উল্টেপাল্টে দেখে নিতে হয়। এমনই এক ঐতিহ্য ভুল ভুলাইয়া। শহরের বড় ইমামবাড়ায় অবস্থিত ১,০০০ গলি আর ৪৮৯টি দরজার এক আজব গোলকধাঁধা৷
ইমামবাড়া হচ্ছে মহরম এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান পালনের জন্য শিয়াদের দ্বারা নির্মিত সমাবেশ স্থল। লখনউয়ের এই বড় ইমামবাড়াটি ১৭৮৪ সালে আওধের (বর্তমানে লখনউ) চতুর্থ নবাব আসাফ-উদ-দৌলার তৈরি। সেবার টানা দশ বছর ধরে চলেছিল ভয়াবহ খরা আর দুর্ভিক্ষ। আসাফ-উদ-দৌলা তখন আওধের নবাব। মদ্যপান করতে ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন বিভিন্ন উদ্ভট আগ্রহকে বাস্তব করে তুলতে। তবে খামখেলায়লি বা রগচটা বললে ভুল হবে, উদার নবাব হিসেবেই পরিচিত ছিলেন আসাফ। তাই দরিদ্র ও বেকারদের আয়ের জন্য বড়া ইমামবাড়া নির্মাণের দায়িত্ব নেন তিনি। ইমামবাড়া নির্মাণের জন্য নবাব প্রায় ২০০০০ শ্রমিক নিয়োগ করেছিলেন। দরিদ্রদের জীবিকা নির্বাহের জন্যই চালু করা হয়েছিল এই ইমামবাড়ার নির্মাণ। শ্রমিকরা দিনের বেলায় ইমামবাড়ার কাঠামোটি নির্মাণ করতেন এবং রাতে সেটি ভেঙে ফেলা হতো যাতে প্রত্যেকের জন্য পরের দিন জীবিকা অর্জনের জন্য যথেষ্ট কাজ থাকে।
আরও পড়ুন-দেবদেবী নয়, পুজো করা হয় ব্যাঙকে! রহস্য-মিথে ভরা ভারতের ২০০ বছরের প্রাচীন এই মন্দির
বড় ইমামবাড়া আসাফি ইমামবাড়া নামেও পরিচিত। এই ইমামবাড়া নির্মাণের জন্য নবাব স্থপতিদের কাছ থেকে দরপত্র ডাকেন। দরপত্রের দরাদরিতে জিতে যান হাফিজ কিফায়াত উল্লাহ। শাহজাহানাবাদের (বর্তমানে পুরনো দিল্লি) এই স্থপতি লখনউতে রুমি দরওয়াজার নকশাও তৈরি করেছিলেন। এই ইমামবাড়া গড়ার ক্ষেত্রে নবাবেব মূল আবদার ছিল একটিই, ১৭০ ফুট x ৫৫ ফুটের এই ইমামবাড়ার কেন্দ্রীয় হলঘরটিতে কোনও স্তম্ভ থাকুক, চাননি নবাব আসাফ-উদ-দৌলা।
তাই, ইমামবাড়াকে দাঁড় করয়ে রাখার জন্য ফাঁপা দেওয়াল, ফাঁপা ছাদ এবং বিভিন্ন উচ্চতার গম্বুজ তৈরি করা হয়েছিল। এই ফাঁপা কাঠামোই ধীরে ধীরে ভুল ভুলাইয়া নামক গোলকধাঁধা নির্মাণের দিকে পরিচালিত করে। বড় ইমামবাড়া নির্মাণে ধাতু বা কাঠ ব্যবহার করা হয়নি। এটি লাখোরি ইট (বাদশাহি ইট) দিয়ে তৈরি যা আসলে সমতল, পাতলা, লাল পোড়া মাটির ইট। শাহজাহানের রাজত্বকালে মুঘল স্থাপত্যের একটি জনপ্রিয় উপাদান ছিল এই লাখোরি ইট।
ভুল ভুলাইয়া এমন রহস্যময় কেন? ৪৫ টি সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে ভুল ভূলাইয়ার শুরুর জায়গায় পৌঁছতে পারবেন আপনি। এই ভুল ভুলাইয়া এমনভাবে তৈরি যে আপনি যদি ৫০ মিটার দূরে কোনও দেশলাই জ্বালান তার শব্দ সুস্পষ্ট শুনতে পাবেন। আড়াইশো বছর ছুঁতে চলা এই স্থাপত্যে বিবিধ গলি ছাড়াও একটি লুকনো সুড়ঙ্গ রয়েছে যা দিল্লির দিকে নিয়ে যায় এবং আরেকটি যায় আগ্রার দিকে। স্থানীয় গাইডরা বলেন, ভুল ভূলাইয়ার ভেতরে কিছু গোপন কুঠুরিও রয়েছে।
আরও পড়ুন- অশরীরীর কান্না, রহস্যময় গোলকধাঁধা! পুজোর ছুটিতে গা ছমছমে সফর সারুন নবাবদের শহরে
পুরো ভুলভুলাইয়াটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, এমনভাবে সেখানে জানলা স্থাপন করা হয়েছে যাতে দিনের সময় বায়ুচলাচল এবং আলোর কোনও অভাব না হয়। এসবই করা হয়েছিল ইমামবাড়ার কেন্দ্রীয় স্থলের কাঠামোর কথা মাথায় রেখে! গাইড না থাকলে এই ভুলভুলাইয়াতে ঢুকে বেরিয়ে আসা কার্যত অসম্ভব! বলা হয় যে, দিল্লি, ফৈজাবাদ এবং এলাহাবাদ পর্যন্ত যে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ ছিল এই ভুলভুলাইয়ার মধ্যে, পরে ব্রিটিশরা নাকি গুপ্তধন খুঁজে না পেয়ে সেই সুড়ঙ্গগুলি বন্ধ করে দেয়!
শোনা যায়, ব্রিটিশ সহ অনেকেই কোনও গাইড ছাড়াই এই গোলকধাঁধায় প্রবেশ করেছেন, আর কখনই ফিরে আসেননি। ১,০০০টিরও প্রবেশের স্থান রয়েছে, অথচ বেরোবার পথ মাত্র একটিই। বেশিরভাগ টানেলই এখন জনসাধারণের জন্য বন্ধ। ইমামবাড়ার ছাদ থেকে রুমি দরওয়াজা, আসিফি মসজিদ এবং হুসেনাবাদ ক্লক টাওয়ার দেখা যায়।