নুনের বাজার থেকে নাম হলো শ্যামবাজার! শোভাবাজারের শোভা আসলে কে?

Shovabazar Shyambazar Name History: বর্তমান শ্যামবাজার এলাকায় পুরনো কলকাতায় এক বিশাল নুনের বাজার ছিল। সেই সময়ে কিছু মানুষ সমুদ্রের তৈরি নুনকে শ্যাম বলত।

আঠারো শতকের কলকাতা। যদিও তখন কলকাতা নিজে শহরের পরিচয় পায়নি। সে ছিল কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি মাত্র। তার মধ্যে একটি বড় গ্রামের নাম ছিল সুতানুটি। সুতোর ব্যবসার জন্য বিখ্যাত জায়গাটি সুতো এবং নুটি থেকে নিজের এই নাম পেয়েছিল। কথিত আছে যে, এই সুতানুটির কাছাকাছি একটি ঘাটে জব চার্ণকের জাহাজ নোঙর ফেলেছিল। সেই জায়গায় একটা বিশাল গাছ ছিল। ওই বিশাল গাছের মাধ্যমে সহজেই এলাকাটা চিহ্নিত করা যেত। সেই গাছের কথা জব চার্ণকের লেখাতেও পাওয়া যায়। তাহলে সুতানুটির নাম হঠাৎ শোভাবাজার হয়ে গেল কীভাবে? শোভাবাজারের এই শোভা আসলে কে?

আঠারো শতকের সুতানুটিতে বসবাস করতেন এক ধনী ব্যবসায়ী। সুতানুটিতে আগত প্রথমদিকের ধনীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তাঁরই নাম ছিল শোভারাম বসাক। প্রচুর বিষয় সম্পত্তির মধ্যে তাঁর ছিল এক মস্ত বড় বাগান। সেই বাগানের চারপাশে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। কালক্রমে সেই এলাকায় গড়ে ওঠে এক বাজার। ব্যবসায়ী শোভারাম বসাকের নাম অনুসারে সুতানুটির পরিচয় বদলে হয়ে যায় শোভাবাজার। শোভাবাজারের নামের উৎপত্তি নিয়ে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলেও তার খুব কাছের একটি এলাকার নামের উৎপত্তির কারণ নিয়ে আজও কিছুটা সংশয় রয়েছে। বর্তমান উত্তর কলকাতার সেই বিখ্যাত এলাকার নাম শ্যামবাজার। শোভাবাজারের শোভা তো নাহয় আসলে শোভারাম বসাক কিন্তু শ্যামবাজারের শ্যাম কে? তিনি কি মানুষ নাকি শ্রীকৃষ্ণ, নাকি সম্পূর্ণ অন্য কোনও উৎস থেকে এই নামের উৎপত্তি হয়েছে?

আরও পড়ুন- ধর্মতলার নাম ধর্মতলা হলো কেন! মনোহর পুকুরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোন ইতিহাস?

কলকাতা বিশারদ প্রাণকৃষ্ণ দত্তের মতে, সুতানুটির কাছেই বসবাস করতেন এক ব্রাহ্মণ। তাঁর নাম ছিল শ্যামচরণ মুখোপাধ্যায়। তাঁর নাম থেকেই এলাকার একটি পুকুর এবং বাগানের নামকরণ হয়। কালক্রমে সেই পুকুর এবং বাজারের আশেপাশের এলাকার মানুষের কাছে শ্যামপুকুর এবং শ্যামবাজার নামে পরিচিতি পায়। তাহলে তো মিটেই গেল! শ্যামচরণ মুখোপাধ্যায় নামের ব্রাহ্মণের নাম থেকেই শ্যামবাজার নিজের নাম পেয়েছে। নাহ। আসল সমস্যা এইখানেই। শ্যামবাজারের নামের উৎপত্তির পিছনে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন উৎসের দিকে নির্দেশ করেছেন। যেমন প্রাণকৃষ্ণ লিখলেন যে, শ্যামবাজারের শ্যাম আসলে মানুষ শ্যামচরণ মুখোপাধ্যায় ঠিক তেমনই গৌরদাস বসাক জানালেন যে, শ্যামবাজারের শ্যাম আসলে মানুষ নন, কুলদেবতা।

গৌরদাস বসাকের মতে, শোভারাম বসাকের কুলদেবতা ছিলেন শ্যাম অর্থাৎ কৃষ্ণ। তাই সুতানুটির নিকটবর্তী একটি এলাকার মালিকানা পাওয়ার পরে শোভারাম বসাক সেই এলাকার একটি বাজারের নাম নিজের আরাধ্য দেবতার নাম অনুযায়ী রেখেছিলেন। এইভাবেই শ্যামবাজার এলাকা নিজের নাম পেয়েছিল। পরবর্তীকালে জেফনিয়া হলওয়েল শ্যামবাজারের নাম পরিবর্তন করে চার্লস বাজার রাখলে শোভারাম বসাক তাঁর সঙ্গে আইনি লড়াই করে শ্যামবাজার নামটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এই ঘটনা থেকে মনে করা যেতে পারে, শ্যামবাজারের নামের প্রতি হয়তো শোভারাম বসাকের কোনও ব্যক্তিগত টানই ছিল। তাহলে শ্যামবাজারের নাম শোভারাম বসাকের কুলদেবতার নাম থেকেই রাখা হয়েছে। উঁহু। সেখানেও একটা 'কিন্তু' রয়েছে। তবে পরবর্তী তত্ত্বের পিছনে কোনও বিশারদ নেই বরং রয়েছে এক জনশ্রুতি।

আরও পড়ুন- দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তা! হরিশ মুখার্জি রোডের নেপথ্যের মানুষকে চিনলই না বাঙালি

কথিত আছে, বর্তমান শ্যামবাজার এলাকায় পুরনো কলকাতায় এক বিশাল নুনের বাজার ছিল। সেই সময়ে কিছু মানুষ সমুদ্রের তৈরি নুনকে শ্যাম বলত। সেই কারণেই বিশাল নুনের বাজারের নাম হয়ে যায় শ্যামবাজার। সমুদ্রে তৈরি নুনকে 'শ্যাম' বলে খামোখা মানুষ ডাকবেনই বা কেন? জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই নুনের বাজার থেকেই সেইসব কসাইখানায় নুন সরবরাহ করা হতো যেসব কসাইখানা থেকে অন্যত্র মাংস রপ্তানি করা হতো। তাহলে আসলে শ্যামবাজারের শ্যাম কে? ব্রাহ্মণ, কুলদেবতা নাকি নুন! এই প্রশ্নের অমীমাংসিত উত্তর পাওয়া খুবই দুষ্কর। নিজস্ব ইতিহাসের যত্ন করা মানুষের অভ্যাসে নেই বললেই চলে। যারা আমাদের সেই ইতিহাসের সঙ্গে কিছুটা আলাপ করিয়েছেন বাঙালি তাঁদেরও খোঁজ রাখে না। গৌরদাস বসাকের কথাতেই আসা যাক। শ্যামবাজারের মতো কলকাতার একটা গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নামের একটি উৎস নির্দেশ করা এই মানুষটি আসলে কে? উনিশ শতকে বড়বাজারের বসাক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই মানুষটি পেশাগতভাবে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হলেও ঐতিহ্যগত প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি কলকাতার রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারমূলক কাজে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। এছাড়াও তাঁর এক বিশেষ পরিচয় রয়েছে। তিনি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মধুসূদন দত্তের আর্থিক সংকটের সময় তিনি মধুসূদনক সাহায্যও করেছিলেন।

 তাঁর বাড়ির কাছের একটি রাস্তা তাঁর নাম অনুযায়ী গৌরদাস বসাক লেন নামেই পরিচিত। ব্যাস এটুকুই, তিনি রয়ে গিয়েছেন বেশিরভাগ মানুষেরই অগোচরে। ঠিক তেমনই, পাঁচ মাথার মোড়ে থাকা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ঘোড়ায় চড়া মূর্তি দেখলে বাঙালি এক বাক্যে এলাকার নাম বলে দিতে পারলেও তার কুয়াশা ঢাকা নামের উৎসের খোঁজ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না তেমন। গল্পকাহিনি মাখা কলকাতা তাই থেকে যায় অনন্ত রহস্য হয়েই।

 

তথ্য ঋণ : ওয়ার্ড প্রেস, দ্যা স্টেটসম্যান, ব্লগস্পট, দ্য টেলিগ্রাফ, সেই সময় - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

More Articles