অঘটনের শুরুয়াত, দেশ বিদেশের প্রথম রেল দুর্ঘটনার ইতিবৃত্ত
First Train Accident of India: ১৮১৪ সালে প্রথম বার একটি লোকোমেটিভ তৈরি করলেন স্টিফেনসন। তবে সেটিও ছিল কয়লা নিয়ে যাওয়ার জন্যই।
পাথরে পাথর ঘষে যেদিন আগুন জ্বালাতে শিখেছিল মানুষ, সেদিন থেকেই পর পর দরজা খুলে যাচ্ছিল চোখের সামনে। ক্রমশ একের পর এক সীমাবদ্ধতাকে টপকে যাচ্ছিল মানুষ। একের পর এক শৃঙ্গ জয় যেন। যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে যে কোনও দিন। কিন্তু হায়! জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ার ফল তো তাকে ভুগতে হতই। যন্ত্রের সঙ্গেই যৌতুকে সে পেল যন্ত্রণা। চাকা বানাতে শেখার পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। অনেক সহজ হয়ে গেল পরিবহণ ব্যবস্থা। ঠেলাগাড়ি থেকে পশুতে টানা গাড়ি হয়ে আরও এগিয়ে চলল মানুষ।
প্রথম দুর্ঘটনা
প্রথম রেলের ভাবনা কিন্তু ভাবা হয়েছিল জার্মানিতে। কাঠের রেলগাড়ি তৈরিও হয়েছিল সেখানে। তা প্রায় ১৫৫০ সালের কথা। তবে প্রথমবার সফল রেলগাড়ি বানিয়ে মাত ছিল ইউরোপ। তৈরি করলেন জর্জ স্টিফেনসন নামে এক ব্রিটিশ। তার আগেই অবশ্য বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কার করে ফেলেছেন রিচার্ড ট্রেথভিক নামে এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার। সেটা আঠেরোশো'র একেবারে গোড়ার দিকের কথা। তাঁর তৈরি স্টিম লোকোমোটিভ তেমন সফল হয়নি। তবে তার অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল রেললাইন আবিষ্কারের তোড়জোর। ১৫৬০ সালের কাছাকাছি সময়ে কামব্রিয়ার জার্মান খনিশ্রমিকেরা ইংল্যান্ডে চালু করে ফেলে একটি ওয়াগনওয়ে। ১৬০০ সালের গোড়ার দিকে লিভারপুলের কাছে প্রেসকট এলাকায় তৈরি হয় আরও একটি ওয়াগনওয়ে। সম্ভবত তার মালিক ছিলেন ফিলিপ লেটন নামে এক ব্যক্তি। না, মানুষ যাতায়াতের জন্য নয়, প্রাথমিক ভাবে ওই রেলপথ পাতা হয়েছিল প্রেসকট হলের কাছে খোঁড়া খনি থেকে আধা মাইল দূরে একটি টার্মিনাস পর্যন্ত কয়লা নিয়ে যাওয়ার জন্য। কয়লা নিয়ে যাওয়ার শ্রম কমে গেল অনেকটাই। তবে ওই যে যন্ত্রের সঙ্গেই ফ্রিতে এল যন্ত্রণা। সভ্যতার আশীর্বাদ ট্রেন যে একদিন কারওর জীবন নিয়ে টানাটানি ফেলে দিতে পারে, তা কি ভেবেছিল কেউ! কিন্তু হল এমনটাই।
আরও পড়ুন- বাংলা থেকে বিশ্ব- ইতিহাসের ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা যা আজও ভুলতে পারেনি কেউ
১৬৫০ সালের কথা। ইংল্যান্ডের ডারহাম শহরে ট্রেন কেড়ে নিল দু'টি টাটকা প্রাণ। কাঠের কোল ওয়াগন চলে গেল ওই দুই কিশোরের উপর দিয়ে। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারাল তাঁরা। সেটাই ছিল প্রথম রেল দুর্ঘটনা। যদিও এই দুর্ঘটনাটিকে রেল দুর্ঘটনা হিসেবে আজও দেখতে চান না অনেকেই। না, সেই হিসেবে দেখতে গেলে আজকের করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা বা বছর কয়েক আগের গাইসল কিংবা জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার মতো বিশাল নয় বটে। তবে তার পরে প্রায় ১৬৩ বছর তেমন বড় কোনও দুর্ঘটনার কথা শোনা যায়নি। হবেও বা কী করে। সাধারণ মানুষের পরিবহণের জন্য তখন রেললাইন কোথায়!
১৮১৪ সালে প্রথম বার একটি লোকোমেটিভ তৈরি করলেন স্টিফেনসন। তবে সেটিও ছিল কয়লা নিয়ে যাওয়ার জন্যই। কিলিংওয়ার্থ ওয়াগলওয়ের জন্য অন্তত ১৬টি লোকোমেটিভ তৈরি করেছিলেন স্টিফেনসন। ১৮১৭ সালে ৬ চাকার একটি লোকোমেটিভ তৈরি করেন তিনি কিলিমারনক ও ট্রুন রেলওয়ের জন্য। তবে তা অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তুলে নেওয়া হয়। ১৮২০ নাগাদ হেটন কোলিয়ারি রেলওয়ের জন্য ৮ মাইলের রেললাইন তৈরির বরাত পেলেন স্টিফেনসন। ১৮২২ সালে প্রথমবার একা একা গড়াল ট্রেনের চাকা। অর্থাৎ কোনও পশু টেনে নিয়ে গেল না ট্রেনটিকে। ইতিমধ্যেই পার্লামেন্টে পাশ হয়ে গিয়েছে বিল। যার জোরে স্টকটন এবং ডারলিংটন রেলওয়ে তৈরির অনুমতি মিলল সহজেই। সেই বছরই মিডলটন রেলওয়েতে ঘটল আরও একটি দুর্ঘটনা। ইয়র্কশায়ার থেকে আসার পথে কয়লাবাহী ট্রেনে চাপা পড়ে মারা গেলেন ডেভিড ব্রুক নামে এক ব্যক্তি। এরপর ঘটতেই থাকল দুর্ঘটনা। কখনও ট্রেনে চাপা পড়ার ঘটনা তো কখনও বিস্ফোরণ বা অন্য কিছু। ট্রেন যত উন্নত হতে লাগল, বাড়তে থাকল দুর্ঘটনার পরিমাণও।
প্রথমবার ট্রেনের সঙ্গে ট্রেনের মুখোমুখি ধাক্কার ঘটনা ঘটল ১৮৩৭ সালে, আমেরিকায়। ভার্জিনিয়ার পোর্টসমাউথ ও রোয়ানোক রেলরোডে ঘটল দুর্ঘটনা। পূর্ব দিক থেকে লাম্বার ট্রেনের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা লাগল পোর্টসমাউথ থেকে আসা মর্নিং প্যাসেঞ্জার ট্রেনের। দুমড়ে মুচড়ে গেল বেশ কয়েকটি কামরা। স্টিম ইঞ্জিনটিতে কম করে হলেও সেদিন দু'শো জন যাত্রী তো ছিলেনই। তাঁদের মধ্যে অনেকেই মারাত্মক চোট পান। মৃত্যু হয় অন্তত তিন জনের।
ভারতে প্রথম
ভারতে তখন শাসন চালাচ্ছে ব্রিটিশ। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের হাত ধরে এদেশেও ট্রেন আসতে দেরি হল না। ভারতে প্রথম রেললাইন বসে ১৮৫৩ সালের এপ্রিলে। মুম্বই অর্থাৎ তখনকার বম্বের বোরি বন্দর থেকে শুরু হল যাত্রা। চারশো যাত্রী নিয়ে ১৪ কামরার ট্রেন পৌঁছল থানে পর্যন্ত। তার ঠিক পরের বছর হাওড়া থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন রওনা হল ১৪ কিলোমিটার দূরে হুগলির জন্য। ১৮৫৪ সালের ১৫ অগস্ট সেটা। পরিষেবা ঢুকে পড়ল রাজ্যেও। দক্ষিণে ট্রেন চালু হল আর কয়েক বছর পরেই। ১৯৫৬ সালের মাদ্রাজ রেলওয়ে কোম্পানি শুরু করল রেল পরিষেবা। চেন্নাইয়ের ব্যাসারপাডি থেকে ওয়ালাজাহ রোড পর্যন্ত ৬৩ মাইল রাস্তায় পাতা হল রেললাইন। অন্যদিকে, ইলাহাবাদ থেকে কানপুরেও শুরু হল রেল পরিষেবা। সেটা ১৮৫৯ সাল। ১৮৭৫ সালের অক্টোবরে হাথরাস থেকে মথুরা ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত চলতে লাগল ট্রেন। মানুষের যাতায়াতের নয়া বাহন হয়ে উঠল রেলগাড়ি। কু ঝিক ঝিক শব্দ করে নিমেষে গন্তব্যে পৌঁছে দিত স্বপ্নের সেই বাহন।
আরও পড়ুন- স্টিম ইঞ্জিন নয়, বরং বলদ দিয়েই শুরু হয়েছিল বাংলায় ট্রেন চলাচল
তবে স্বপ্নের সঙ্গে এল দুঃস্বপ্ন। ট্রেনের সঙ্গে এল দুর্ঘটনাও। তবে প্রথম কয়েক বছর বেশ নিরাপদেই চলেছে ট্রেন। তেমন কোনও বড় দুর্ঘটনা বা অঘটনের কথা শোনা যায়নি মোটেও। ভারতে প্রথম ট্রেন দুর্ঘটনাটি ঘটল ১৯০৭ সালের ২৪ অক্টোবর। অবশ্য এখনকার হিসেবে তাকে ভারত বললে ভুল হবে। তখনও ভারত অবিভক্ত। বুকের উপর দিয়ে টেনে দেওয়া হয়নি বিভাজনের কাঁটাতার। পাক পঞ্জাব প্রদেশ সংলগ্ন লাহৌরের কোট লাকপত স্টেশনের কাছে একটি মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা লাগল যাত্রীবাহী ট্রেনের। ঘটনায় মারা গেলেন ১১ জন। জখম হন অন্তত ২৭।
এখানেই শেষ নয়। তার ঠিক পরের বছর হরিয়ানার অম্বালার কাছে বরালা স্টেশনে দু'টি মেল ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সেই ঘটনাতেও মৃত্যু হয় ২২ জনের। জখম ২৪। ১৯২০ সালে দুন এক্সপ্রেসের সঙ্গে মালবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। মোরাদাবাদ স্টেশনের কাছে ঘটে ঘটনাটি।
একদিন আগেই ওড়িশার বালেশ্বরের কাছে ঘটে গিয়েছে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা। মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের একাধিক কামরা। মৃতের সংখ্যা দু'শো ছাড়িয়েছে ইতিমধ্যেই। লাফিয়ে বাড়ছে আহতের সংখ্যা। চলছে উদ্ধারকাজ। বিভিন্ন কামরা থেকে ভেসে আসছে জখমদের আর্তনাদ। ঠিক করে বলা যাচ্ছে না মৃতের সংখ্যাটা। আর এমন দুর্ঘটনা এ দেশে নতুন নয়। ১৯৮১ সালে বিহারে লাইনচ্যুত হয় ট্রেন। ওই দুর্ঘটনায় গিয়েছিল প্রায় পাঁচশোটি প্রাণ। জ্ঞানেশ্বরী থেকে গাইসল, বারবার একাধিক রেলদুর্ঘটনা ঘটেছে রাজ্য থেকে দেশ, দেশ থেকে বিশ্বে। এই এত এত দুর্ঘটনার পিছনে রয়েছে অবহেলা, কর্তব্যে গাফিলতি না অন্য কিছু, তা তদন্তের বিষয়। তবে সভ্যতা যত এগিয়েছে, বিজ্ঞান যত উন্নতি করেছে, তার সঙ্গে যে এই সব সাইড এফেক্টও জুটেছে কপালে, তাতে আর অবাক কী! রেলসুরক্ষার ব্যাপারে আদৌ কি এগোনো গিয়েছে কোথাও! প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।