হাজার বছর ধরে জাগ্রত, বাংলাদেশের যে হিন্দু মন্দিরগুলি এখনও নজর কাড়ে
কাঁটাতারের আগে যে বিশাল একক বঙ্গ, তার অঙ্গের ভূষণ নানা ছাঁদের ধর্মপীঠ। বিভিন্ন ধরনের মন্দিরের শরীর বিভিন্ন কারিগরী শিল্পের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে আজও। বাংলা ভাগ হওয়ার পর বঙ্গের এক বিপুল অংশ রয়ে গিয়েছে বাংলাদেশে। ফলত প্রাচীন হিন্দু মন্দির বাংলাদেশে কম নেই। হিন্দু জনসংখ্যার নিরিখেও বাংলাদেশ পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। এমনই কয়েকটি মন্দিরের কথা পাঠকের দরবারে পেশ করতে চাই , যা বাংলাদেশের মন্দির শিল্পরীতির ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছে।
ঢাকেশ্বরী মন্দির, ঢাকা
ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির। প্রাচীনতম মন্দিরের তকমাও জুটেছে তার। দ্বাদশ শতকে বল্লাল সেন এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা শহরের রক্ষাকর্ত্রী এই ঢাকেশ্বরী দেবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে অবস্থিত মন্দিরটি উজ্জ্বল হলুদ আর লালে সজ্জিত। মন্দিরের উত্তর পশ্চিমাংশে রয়েছে চারটি শিব মন্দির। ধাতুনির্মিত একটি বড় দূর্গা মূর্তি। ৮০০ বছর কেটে গেলেও মন্দিরের অবস্থা এখনও অত্যন্ত ভালো। বাংলাদেশের শারদোৎসবের কেন্দ্রবিন্দু এই মন্দির। এই কয়দিন হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন মন্দির প্রাঙ্গণে। ঢাকেশ্বরী মন্দির অঞ্চলের দুটি অংশ। একটি পুবে অবস্থিত অন্তর্মহল। এখানে মূল মন্দিরটি রয়েছে, নাটমন্দির। বহির্ভাগে বেশ কয়েকটি মন্দির, হোটেল এবং কিছু ঘরবাড়িও রয়েছে। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে একটি বড় দীঘির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এক প্রাচীন বট যেন মহকালের আখর গুনে চলেছে।
কান্তজীর মন্দির, দিনাজপুর
নামেই বোঝা যায় এটি কৃষ্ণ মন্দির। মন্দিরের নামে এলাকার নামও কান্তনগর। জনশ্রুতি অনুযায়ী, মহারাজা সুমিত ধর শান্ত জন্মেছিলেন এই মন্দিরেই। দিনাজপুর-তেতুলিয়া হাইওয়ের পশ্চিমে ধেপা নদীর ধারে এই কান্তনগর গ্রাম। মূল দিনাজপুর থেকে প্রায় ২০ কিমি উত্তরে অবস্থিত। আঠেরো শতকের আশেপাশে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সময় দিনাজপুরের জমিদার ছিলেন মহারাজা প্রাণনাথ রায়। ভিত্তিপ্রস্তরের খোদাই অনুসারে মহারাজা শেষজীবনে এই মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। ১৭২২ সালে মহারাজার মৃত্যু হলে তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁরই দত্তক নেওয়া পুত্র মহারাজা রমানাথ রায় মন্দিরের কাজ শেষ করেন ১৭৫২ নাগাদ। সে সময় মন্দিরের উচ্চতা ছিল প্রায় ৭০ ফুট। কিন্তু ১৮৯৭-এর প্রবল ভূমিকম্প্রে মন্দিরের সমস্ত চূড়াগুলি নষ্ট হয়ে যায়। মহারাজা গিরিজানাথ মন্দিরটি সংস্কার করেন বটে, কিন্তু মন্দিরের গম্বুজগুলি আর নির্মিত হয়নি। মন্দিরটির অন্যতম আকর্ষণ সমগ্র গায়ে প্রায় ১৫০০০-এর উপর টেরাকোটার পাত। রামায়ণ, মহাভারত থেকে শুরু করে পুরাণের গল্প–সমস্তই স্থান পেয়েছে সেখানে।
মাটি থেকে তিনধাপ উঁচু। চারিদিকের সবগুলি আর্চের মধ্যে দিয়েই বিগ্রহ দর্শন করা যায়। মন্দিরটি আয়তকার, তবে যে পাথরটির ওপর মন্দিরটি স্থাপন করা হয়েছে তা ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের বর্গাকার একটি পাথর। প্রতিটি প্রবেশদ্বারে একটি করে খিলান। এবং দুটি স্তম্ভ খিলানগুলিকে পৃথক করে রেখেছে। স্তম্ভের গায়ের নকশা কারুকাজ দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়। মন্দিরের একতলায় সাকুল্যে ২১টি, দোতলায় ২৭টি, তিনতলায় ১২টি খিলান রয়েছে।
চন্দ্রনাথ মন্দির, সীতাকুণ্ডা
সীতাকুণ্ডায় অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মপীঠ রয়েছে। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ৩৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দিরটি তাদের মধ্যে অন্যতম। অনেকে একে একান্ন পীঠের একটি বলেও গণ্য করে থাকেন। এটি সীতাকুণ্ডা মন্দির নামেও পরিচিত। শিবরাত্রির শিবচতুর্দশী তিথিতে এখানে একটি বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পুজো উপলক্ষ্যে সীতাকুণ্ডায় বিরাট মেলা বসে। শিবচতুর্দশীর মেলা নামে এই মেলা জগদ্বিখ্যাত।
মহেশখালির আদিনাথ মন্দির
বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে ১২ কিমি দূরে মহেশখালি দ্বীপে অবস্থিত এই মন্দিরটি অত্যন্ত বিখ্যাত। মন্দিরটি স্থানীয় লোকের মুখে শিব মন্দির নামেই পরিচিত। জনশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশের এই দ্বীপের জঙ্গলে এক চাষী একটি মহাদেবের মূর্তি কুড়িয়ে পান। তিনিই মন্দির নির্মাণ করে সেই মূর্তিটি মহেশমূর্তি রূপে প্রতিষ্ঠা করেন। শোনা যায় এই দেবতা অত্যন্ত জাগ্রত দেবতা।
রাজশাহীর পুঁথিয়া মন্দির চত্বর
রাজশাহীর ২৩ কিমি পুবে পুঁথিয়া অঞ্চল হিন্দু মন্দিরের প্রাচুর্যের জন্য বিখ্যাত। এইসব মন্দিরের সিংহভাগ এ অঞ্চলের জমিদার বংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। টেরাকোটার এত সুন্দর অবিশ্বাস্য কাজ এবং মনোরম স্থাপত্য শৈলীর মেলবন্ধন বাংলার একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতির ছাপ রেখেছে। মূলত ইন্দো-সেরাসেনিক স্থাপত্য শৈলীতে মন্দিরটি তৈরি। এই রীতির স্থাপত্য গুলির মধ্যে হিন্দু স্থাপত্যরীতি ও রেঁনেসা যুগের ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতির মিশ্রণ দেখা যায়। মন্দির চত্বরে একটি দীর্ঘ সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রাঙ্গণ রয়েছে। একপাশে সুবিশাল এক দীঘি। ইতিহাস বলছে এই অঞ্চলের আদি শাসক ছিলেন লস্করি খান। আকবরের শাসনকালে লস্করি খান বিদ্রোহ করলে সেনাপতি মানসিংহ, এই অঞ্চলের রাজত্ব তুলে দেন রাজা পীতামবরের হাতে। এই পীতাম্বরই পুঁথিয়ার জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় পুঁথিয়ার জমিদার বংশের জমিদারী ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারী। সম্পত্তির দিক দিয়ে তাঁরা ছিলেন সবথেকে ধনী জমিদার। দেশভাগের সময় পাকিস্তান সরকার জমিদারদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলে পুঁথিয়ার জমিদারেরা এপার বাংলায় পালিয়ে আসেন।
শ্রী শ্রী বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম, নারায়ণগঞ্জ
ঢাকার নিকটবর্তী নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত সোনারগাঁও উপজেলার বারদি অঞ্চলে এই আশ্রম অবস্থিত। বাবা লোকনাথের জীবনী অনুযায়ী, বারদিতে থাকাকালীন বাবা লোকানাথের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। সেই থেকে তাঁর জন্মতিথিতে এই মন্দিরটিতে এক বিরাট মেলার আয়োজন হয়। ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ-বিদেশ থেকে কাতারে কাতারে লোক আসে এই মেলায় যোগ দিতে।
কাল ভৈরবের মন্দির, ব্রাহ্মণবেড়িয়া
তিতাস নদীর নাম শুনেছেন অনেকেই। অদ্বৈত মল্ল বর্মণ রচিত উপন্যাসের সেই বিখ্যাত নদীর তীরে, ব্রাহ্মণবেড়িয়া জেলায় অবস্থিত কাল ভৈরবের মন্দির। ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক মন্দির হিসেবে এর খ্যাতি রয়েছে। মন্দিরের মূল আকর্ষণ কাল ভৈরবের ২৮ ফুট দীর্ঘ মূর্তি। ১৯০৫ নাগাদ এই বিশাল মূর্তি স্থাপিত হয়। প্রথমবার এ মূর্তি দর্শনে ভয় পাবেন অনেকেই। ভয়বহ এই বিগ্রহের বাঁদিকে রয়েছে কালিমূর্তি, ডান দিকে রয়েছে পার্বতীর মূর্তি।
তথ্যঋণ–
“Ancient Temples of Bangladesh: Remembering Their Past Glory.” Unb.Com.Bd.
“History of the 4 Oldest Temples of Bangladesh - Bproperty.” 2021. A Blog about Homes, Trends, Tips & Life | Bproperty (blog). January 14, 2021.
“Millennium-Old Hindu Temple Discovered in Bangladesh - The Hindu.” n.d.