ব্রিটিশ ভারতে এক টুকরো বরফ ছিল লাখ টাকা! দেশে বরফ ব্যবসার ইতিহাসে জড়িয়ে ছিল ঠাকুরবাড়িও

Ice Trading in India: ১৮৭৮ সালে কলকাতায় যাত্রা শুরু করে দ্যা বেঙ্গল আইস কোম্পানি। এটি ছিল এই অঞ্চলের প্রথম আধুনিক বরফ নির্মাণ কোম্পানি।

বরফ বিষয়টাই আজকের দিনে অত্যন্ত সহজলভ্য জিনিস। ডিপ ফ্রিজের দরজা খুলে সেখান থেকে অনায়াসে বের করে নেওয়া যায় বরফের কিউব। ব্যথায় আইসব্যাগ থেকে শুরু করে সুরার সঙ্গী, বরফের জুড়ি মেলা ভার। তবে জানেন কি, আজকের দিনে আমরা যে ধরনের বরফ ব্যবহার করি তার দাম ব্রিটিশ ভারতে ছিল প্রায় লাখ টাকার সমান! ভারতে বরফের প্রচলনের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে এক বৃহৎ ইতিহাস, যার পরতে পরতে রয়েছে নানান অজানা গল্প। ভারতের এই বৃহৎ বরফ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন খোদ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর!

১৬ ফুট লম্বা, সাদা গোলাকৃতি একটি ভবন। ছাদ গম্বুজাকৃতির। বৃহদাকৃতি এই ভবনটি অবস্থিত দক্ষিণ মুম্বইয়ের অ্যাপোলো সড়কের উপর, যার নাম বর্তমানে শহিদ ভগৎ সিং সড়ক। ১৮৪৩ সালে নির্মিত এই সাদা ভবন এককালে পরিচিত ছিল বম্বে আইস হাউস নামে যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় বম্বে বরফ ঘর। এই বরফ ঘরের বিপরীতেই অবস্থিত ছিল তৎকালীন সরকারি ডকইয়ার্ড। একসঙ্গে ১৫০ টন বরফ মজুদ করা যেত এই বম্বে বরফ ঘরে, যার হাত ধরেই শুরু হয়েছিল ঔপনিবেশিক ভারতে বরফের রমরমা ব্যবসা। ১৮৩০ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন শহরগুলিতে বরফ ছিল এক ধরনের বিলাসপণ্য। উত্তর পূর্ব আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হতো এই বরফ। উনিশ শতকে এই ব্যবসা এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, তা নিয়ে ‘দ্য নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি ইন্দো-আমেরিকান আইস ট্রেড’ নামের একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন তৎকালীন জনপ্রিয় ইংরেজ লেখক ডেভিড ডিকেনসন। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায়, ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পারস্যের ইঞ্জিনিয়াররা পর্বতের থেকে বরফ কেটে তা সংরক্ষণ করার এক ধরনের কৌশল আবিষ্কার করেন। পুরু দেয়ালের কনটেনারে পুরে মাটির নিচে রেখে প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষণ করা হতো এই বরফের খণ্ডগুলিকে।

অন্যদিকে, মুঘলরা ব্যবহার করতেন হিমালয়ের বরফ। কিন্তু, এই বরফের আইস ফিল্ড রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হতো প্রচুর খরচ এবং লাগত প্রচুর শ্রমিক। এছাড়া ছিল হুগলির বরফ। অগভীর গর্তে জল জমিয়ে এই বরফ তৈরি করা হলেও, এই বরফের গুণমান ভালো ছিল না। ফলে ব্রিটিশদের প্রয়োজন পড়ল এমন মানের বরফের, যা দামের দিক থেকে কম হলেও, গুণমানের দিক থেকে যথেষ্ট ভালো। ঠিক এখানেই আবির্ভাব ঘটল ফ্রেডরিক টিউডরের। তাঁর হাত ধরেই ভারতে এল আমেরিকান আইস। সেই প্রথম ভালো বরফের স্বাদ আস্বাদন করল ভারতবাসী। সবার সাধ্যের মধ্যে না থাকলেও, ভারতের ধনী ব্যাবসায়ী ও অভিজাতদের কাছে এই বরফ হয়ে উঠেছিল প্রতিদিনের প্রয়োজন। এভাবেই ধীরে ধীরে বরফ হয়ে উঠল ঔপনিবেশিক ভারতের জনপ্রিয় বিলাস পণ্য এবং ফ্রেডরিক টিউডর হয়ে উঠলেন বরফ রাজা।

আরও পড়ুন- ৭৭ বছর ধরে নতুন-পুরনো কলমের অসুখ সারাচ্ছে ধর্মতলার এই পেন হাসপাতাল

বরফরাজা টিউডর

সময়টা তখন ১৮৩০। আমেরিকায় বরফের ব্যবসা করে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে গিয়েছিলেন ফ্রেডরিক টিউডর। বরফ সম্পর্কিত একটি ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, ফ্রেডরিক জন্মেছিলেন বস্টোনিয়ার এক অত্যন্ত বড় এবং বনেদি পরিবারে। তাঁদের পরিবারের রীতিই ছিল ব্যবসা। কিন্তু ফ্রেডরিকের ভাগ্য কোনওভাবেই খুলছিল না। এমনকী বরফের ব্যবসা থেকে শুরুর দিকে খুব একটা লাভের মুখ দেখেননি তিনি। এরপর আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু রাজ্য এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে বরফ ব্যবসা করতে শুরু করেন ফ্রেডরিক। তবে সেখানেও তেমন কোনও লাভ হয়নি।

এরপরে ফ্রেডরিক শুরু করেন কফির ব্যবসা। ঋণ খেলাপি হওয়ায় কোনওভাবে ব্যাংকের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচেন ফ্রেডরিক। জেলে যাওয়া থেকে বাঁচতে এবার রীতিমতো মরিয়া হয়ে ওঠেন ফ্রেডরিক টিউডর। নেন একটা বড় ঝুঁকি। সেই সময় ভারতে বেশ ভালোভাবে প্রভাব বিস্তার করে নিয়েছে ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ভারতের অধিকাংশ জায়গায় তৈরি হয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশ। তাই ফ্রেডরিক ভাবেন ঔপনিবেশিক ভারতে বরফ চালান দেওয়ার। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ব্যাংকের ঋণের টাকা পরিশোধ করার তাগিদে কলকাতায় বরফ পরিবহনের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এই ব্যবসায় তাঁর অংশীদার হন স্যামুয়েল অস্টিন এবং উইলিয়াম রজার্স। পরবর্তীতে রজার্স ব্যবসার অংশীদার হিসেবে বরফের এজেন্ট হিসেবেও কাজ করতে শুরু করেন। লর্ড কর্নওয়ালিস নানা সুযোগ সুবিধা দেওয়ার পর ১৭৭৮ সালের পর থেকেই আমেরিকার বণিকরা ভারতে ব্যবসা করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত বরফ পরিবহনের ব্যবসা ভারতে ছিল না। সেই ব্যবসাই লাভের রাস্তা খুলে দিল ফ্রেডরিকের জন্য।

১৮৩৩ সালের কথা। সেই সময় সমুদ্রের পথে আটলান্টিক এবং ভারত মহাসাগর হয়ে ভারত পৌঁছতে মাস চারেক সময় লাগত। কিন্তু উনিশ শতকের শেষের দিকে বরফ সংগ্রহের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ায় সমুদ্রপথে বরফ ব্যবসার এক বিশাল সম্ভাবনা এবং জনপ্রিয়তা তৈরি হয়। আর এই সম্ভাবনাটি তৈরি করেন টিউডরের সহযোগী নাথানিয়েল জার্ভিস ওয়াইথ। তিনি দুই ব্লেড যুক্ত ঘোড়ায় টানা একটি বরফ কাটার যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যার ফলে স্বল্প সময়ে অনেক বেশি পরিমাণে বরফ বর্গাকারে কাটা সম্ভব হয়। এতে একদিকে যেমন সময় বাঁচে, তেমনই অন্যদিকে মানুষ এবং ঘোড়া দু’জনেই বেশি কাজ করতে পারে।

যাতে বরফ গলে না যায় তার জন্য বড় আকারের বরফগুলোকে শক্ত করে প্যাকেটজাত করার একটি পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। বরফ পরিবহন করার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করতে থাকেন ওয়াইথ। অন্যদিকে বরফের ব্যবসা কীভাবে ঔপনিবেশিক ভারতে একেবারে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, সেই নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে থাকেন ফ্রেডরিক। বরফ পরিবহনের জন্য ব্যবহার শুরু হয় দুই দেওয়াল বিশিষ্ট স্টোর হাউসের। এই স্টোর হাউসে ব্যবহার করা হতো করাতের গুঁড়ো এবং চামড়াজাত পণ্য।

১৮৩৩ সালের ১২ মে স্টোর হাউসের মধ্যে ১৮০ টন বরফ নিয়ে বোস্টন থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে টাসকানী নামের একটি জাহাজ। ৬ সেপ্টেম্বর কলকাতা বন্দরে প্রবেশ করে ওই বিশাল জাহাজ। চার মাস হয়ে গেলেও তখনও ওই জাহাজে ১০০ টন বরফ অক্ষত ছিল। কলকাতার বহু মানুষ সেদিন জড়ো হয়েছিলেন আমদানি করা বরফ দেখার জন্য। এতদিন পর্যন্ত যে সমস্ত বরফ কলকাতায় পাওয়া যেত তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল ওই বরফ। ওই বিশাল আকৃতির বরফ দেখে কার্যত অবাক হয়ে গিয়েছিল কলকাতাবাসী। উৎসুক দর্শকদের একজন দাবি করেছিলেন, আমদানি করা বরফ নাকি স্পর্শ করতে গিয়ে তাঁর হাত পুড়ে গিয়েছিল। একজন তো আবার জাহাজের ক্যাপ্টেনকে সরাসরি জিজ্ঞেসই করে বসেছিলেন, আমেরিকায় বরফ গাছে হয় কিনা?

বরফের রমরমা ব্যবসা

খুব কম সময়ের মধ্যেই ভারতে ফুলে ফেঁপে ওঠে আমেরিকার এই বরফের ব্যবসা। ওই সময় ভারতে যে সমস্ত বরফ পাওয়া যেত তার তুলনায় আমেরিকার বরফ ছিল অনেক বেশি অক্ষত এবং অনেক বেশি সুন্দর। আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্ব তীরে অবস্থিত ম্যাসাচুসেটসের বিভিন্ন হ্রদের মিষ্টি জল দিয়ে দারুণ বরফ তৈরি করা যেত। সেখানকার হোয়েনহ্যাম লেকের বরফের বিশুদ্ধতা দেখে একদা রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন মাইকেল ফ্যারাডের মতো বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানীরাও। সেই বরফ সেই সময় ইংল্যান্ডে পাঠানো হতো। মাইকেল ফ্যারাডে বলেন, ওই বরফে বাতাসের বুদবুদ ও সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড জাতীয় লবণের পরিমাণ বেশি থাকার কারণে সেই বরফ দ্রুত গলত না।

পরে ৩০ বছর ধরে কলকাতা এবং ভারতের বিভিন্ন প্রেসিডেন্সি শহরে নিজের বরফের ব্যবসা নিয়ে জাঁকিয়ে বসেন টিউডর। এই শহরগুলোতে ব্যবসা করে কল্পনাতীতভাবে লাভ করতে শুরু করেন টিউডর। কয়েক বছরের মধ্যেই কোটিপতি হয়ে ওঠেন তিনি। ওয়াল্ডেন পন্ড থেকে বরফ সংগ্রহের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন প্রখ্যাত মার্কিন কবি প্রাবন্ধিক এবং দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরো। ১৮৫৪ সালে তিনি লিখলেন, “নিউ অর্লিনস, চার্লসটন, মাদ্রাজ, বম্বে এবং কলকাতার ঘর্মাক্ত বাসিন্দারা আমার কুয়োর জল পান করেন।” যদিও এই পন্ড থেকে যে বরফ তৈরি হতো তা ছিল মূলত অভিজাত অ্যাংলো সমাজের জন্যই। এর বিনিময়ে ব্রিটিশদের থেকে তিনি একাধিক সুযোগ-সুবিধে আদায় করে নিতে শুরু করেন।

বরফ এজেন্ট উইলিয়াম রোজার্সকে কাস্টম হাউসের আনুষ্ঠানিকতা কিংবা নিয়ম নীতির জন্য বরফ নিয়ে বন্দরে আটকে থাকতে হতো না। তিনি সোজা আমদানি করা বরফ নিয়ে চলে যেতে পারতেন কলকাতার বিভিন্ন গুদামে। এছাড়াও, বরফ নামানোর অনুমতি পেয়েছিলেন রাত্রিবেলাও। রাত্রে সাধারণত বন্দরে জাহাজ থেকে জিনিস নামানো যেত না সেই সময় কিন্তু তিনি বরফের চালান রাত্রেই সোজা গুদামে তোলার অনুমতি পেয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি নিজের পছন্দের মতো জায়গাতেও জাহাজ নোঙর করার সুযোগ পেতেন। এছাড়াও পেয়েছিলেন শুল্কমুক্ত বিভিন্ন সুবিধা। এছাড়াও, পরের বছর বরফ ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে বরফ ঘর তৈরি করে তা টিউডরের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। নিজের অর্থায়নে তাঁর দ্বিতীয় সমুদ্র যাত্রা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হতে পারত। কিন্তু সেরকমটা আদতে হয়নি। এই যাত্রায় ৩৫০ ব্যারেল আপেলের সবটাই পচে গেলেও কলকাতার আমেরিকান আইস কমিটি এবং গভর্নর লর্ড বেন্টিংকের অপ্রত্যাশিত প্রধান্যতার কারণে সেই যাত্রায় টিউডর রক্ষা পেয়ে গিয়েছিলেন।

ধীরে ধীরে বরফ ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য বসাতে শুরু করেন টিউডর। একটা সময় এমন ছিল যখন ঔপনিবেশিক ভারতের সবথেকে বড় বরফ লেনদেনকারী হয়ে উঠেছিলেন ফ্রেডরিক টিউডর। বরফের পাশাপাশি নিউ ইংল্যান্ডের আপেল, স্প্যানিশ আঙ্গুর এবং আমেরিকার মাখন পরিবহনও বছর কয়েকের মধ্যেই লোভনীয় পণ্যে পরিণত হয়। সম্পূর্ণ সরকারি খরচে সম্প্রসারণ হয় বরফ ঘরের।

টিউডরের এই অভাবনীয় সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বম্বেতে বরফ বিক্রি শুরু করেন জাহাঙ্গীর নুসেরভাঞ্জি ওয়াদিয়া। আর ডিনার পার্টিতে আইসক্রিম সরবরাহ করতে শুরু করেন জামশেদজি জিজিভয়। তবে প্রথম পার্টিতে আইসক্রিম খেয়ে অতিথিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সর্দিতে আক্রান্ত হলে গুজরাতি পত্রিকা বম্বে সমাচার এই বিষয়টিকে উপযুক্ত মূল্য বলে উল্লেখ করে। বরফ ব্যবসায় বিনিয়োগ শুরু করেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। বরফ পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। ১৮৫৬ এবং ১৮৮৩ সালে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় যথাক্রমে ৩৫৩ এবং ৪৫০ টন বরফ পাঠানো হয়। প্রেসিডেন্সি শহরগুলোর মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এই বরফ সংরক্ষণ করা হতো। আর যেসব বছরে বরফ সরবরাহ কম হতো, ওই সময় বরফ সংরক্ষণের কাজ করা হতো জোর কদমে।

আরও পড়ুন- গরু পারাপারের সেতু থেকে আজকের টালা ব্রিজ! যে ইতিহাস অনেকের অজানা

বরফ ব্যবসার পতন

ঊনবিংশ শতাব্দীর তিনের দশক থেকে এই ইন্দো-আমেরিকান বরফ চালান ব্যবসার অগ্রগতি শুরু হলেও ছয়ের দশকে গিয়ে এই ব্যবসার পতন শুরু হয়। ১৮৭০ নাগাদ বরফ তৈরির আধুনিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার হয়। ১৮৬৪ সালে টিউডর মারা যান। তারপরে এই ব্যবসার হাত বদল হওয়া শুরু হয়। কিন্তু ততক্ষণে এই ব্যবসার যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গিয়েছিল। শিল্পায়ন এবং রেললাইনের আবিষ্কারের কারণে দূষণের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে সারা বিশ্বে। এর ফলে বরফের গুণগত মান কমতে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যে। পাশাপাশি, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে পৃথিবীর। ফলে জাহাজ পথে মার্কিন মুলক থেকে কলকাতায় বরফ নিয়ে আসা দেখতে শুরু করে ক্ষতির মুখ।

রেল লাইন তৈরি করার জন্য ওয়ালডন পন্ডের আশেপাশের অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়। এর ফলে কমতে শুরু করে বরফের মান। বরফ তৈরির যন্ত্র আবিষ্কার সহ নানা কারণে পুরনো পদ্ধতিতে বরফের ব্যবসা টালমাটাল হতে শুরু করে। ভারতেও উদ্ভব হয় বিভিন্ন বরফের কোম্পানির। ১৮৭৮ সালে কলকাতায় যাত্রা শুরু করে দ্যা বেঙ্গল আইস কোম্পানি। এটি ছিল এই অঞ্চলের প্রথম আধুনিক বরফ নির্মাণ কোম্পানি। রেলওয়ের বিস্তারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতের অন্যান্য জায়গাতেও বরফের ব্যবসার বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। ১৯০৪ সালে যেখানে ভারতের রেললাইনের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫, সেখানে ১৯২৫ সালে এই রেল লাইনের সংখ্যা ৬৬-তে পৌঁছায়। রেললাইনের বিস্তারের ফলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বরফ মজুদ করে রাখার প্রয়োজনীয়তা কমতে শুরু করে। ফলে নিজের পুরনো জৌলুস হারাতে শুরু করে কলকাতার নামিদামি বরফঘরগুলি।

১৮৮২ সালে কলকাতা আইস হাউস ধ্বংস করে দেওয়া হয়। ১৯২০ সালে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বম্বে বরফ ঘর। চেন্নাইয়ের ঘরটি এখনও পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলেও, এটি আর বরফ ঘর হিসেবে ব্যবহার হয় না। বাড়তি কিছু দরজা জানালা বসিয়ে এটিকে বসতবাড়ি রূপে ব্যবহার করা হচ্ছে এই মুহূর্তে। এই বরফ ঘরটিকে আগে ব্যবহার করা হতো দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আবাসস্থল হিসেবে। এমনকি স্বামী বিবেকানন্দ ভারত ভ্রমণের সময় এই বাড়িতেও কিছুদিন কাটিয়েছেন বলে শোনা যায়। শুধু তাই নয়, জগত বিখ্যাত লেখক তথা মোগলির স্রষ্টা স্যার রুডইয়ার্ড কিপলিংও নিজের লেখা ‘দ্য সেকেন্ড জঙ্গল বুকস’- এর ‘দি আন্ডারটেকারস’ নামের গল্পে এই বরফ ব্যবসার উল্লেখ করেছিলেন।

More Articles