ভারতের মোক্ষম চালে আন্দামানের দখল পায়নি পাকিস্তান! চমকে দেবে সেই ইতিহাস

Andaman-Nicobar: ত্রিমুখী টানাপোড়েনের মধ্যে কীভাবে আন্দামানের দখল নিল ভারত?

১৯৪৭। সদ্য স্বাধীন হয়েছে দেশ। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশগুলিকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করছে পাকিস্তান। ইতিমধ্যেই তাদের নজর যায় ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জে। মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত সেই দ্বীপটি হলো লাক্ষাদ্বীপ। মুসলমান জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে জিন্নাহ মনে করতেন, লাক্ষাদ্বীপ পাকিস্তানের অংশ হওয়া উচিত। যেমন ভাবা তেমন কাজ, মহম্মদ আলি জিন্নাহ পাকিস্তানি জাহাজ পাঠালেন লাক্ষাদ্বীপ দখল করতে। কিন্তু সেই জাহাজ গিয়ে দেখল, ততক্ষণে সেখানে ভারতের পতাকা উড়ছে। জিন্নাহ এরকম করতে পারেন ভেবে আগেভাগেই সর্দার প্যাটেল ভারতীয় সেনাকে লাক্ষাদ্বীপে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। লাক্ষাদ্বীপ হাত থেকে গেলেও জিন্নাহ বদ্ধপরিকর ছিলেন ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত আরেকটি দ্বীপপুঞ্জ, আন্দামান-নিকোবরের দখল নেওয়ার। ভারত আন্দামান-নিকোবরের দখল ছাড়তে বা পাকিস্তানের সঙ্গে বাঁটোয়ারা করতে কোনও মতেই রাজি ছিল না। আবার ব্রিটিশরা ভারত থেকে চলে গেলেও আন্দামান ছাড়তে রাজি নয়, কেননা আন্দামান ও নিকোবর তাদের অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের কলোনিগুলির সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। এই ত্রিমুখী টানাপোড়েনের মধ্যে কীভাবে আন্দামানের দখল নিল ভারত?

লাক্ষাদ্বীপের ভারতে অন্তর্ভুক্তির কৃতিত্ব যদি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের হয়, তাহলে আন্দামান ও নিকোবরের ভারতে অন্তর্ভুক্তির কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর। ইতিহাসের দিকে যদি ফিরে তাকানো যায়, তাহলে আমরা দেখব, আন্দামানকে প্রথম নৌসেনার ঘাঁটিতে রূপান্তরিত করেছিলেন চোল বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা রাজেন্দ্র চোল। তিনি আন্দামান এবং নিকোবরের নামকরণ করেন ‘মা নক্কভরম’। মার্কো পোলো নিজের লেখায় এই দ্বীপপুঞ্জকে ‘নেক্যুভেরন আইল্যান্ড’ বলে অভিহিত করেছেন। পরবর্তীকালে মারাঠা সরদার কাহ্নজি আংরে-ও আন্দামানকে নৌ-ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করেন। ১৭৫৫ সালে প্রথম ইউরোপিয়ানদের প্রবেশ ঘটে এই দ্বীপে। ড্যানিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই দ্বীপে এসে এই দ্বীপের নামকরণ করে ‘নিউ ডেনমার্ক’। পরবর্তীকালে ম্যালেরিয়ার প্রকোপের জন্য ড্যানিশরা এই দ্বীপ ছেড়ে পালিয়ে যান। ১৮৫৮ সালে এই দ্বীপ দখল করে ব্রিটিশরা এবং এই দ্বীপেই গড়ে ওঠে আন্দামান সেলুলার জেল। এর প্রায় ১০ বছর পর সরকারিভাবে ডেনমার্কের থেকে দ্বীপটি কিনে নেয় ব্রিটেন এবং এর কয়েকদিন পরেই ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয় আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, ১৯৪৩ সালে জাপানিরা আন্দামান আক্রমণ করেন এবং এখানেই আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করেন সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের পর এই দ্বীপের দখল নেয় ব্রিটেন। কিন্তু এক বছর পরেই যখন বাঁটোয়ারার সিদ্ধান্ত হয়, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে আন্দামান কার ভাগে যাবে।

আরও পড়ুন: জাতীয় সংগীত হওয়ার যোগ‍্য নয়! কেন এই দাবি উঠেছিল ‘জনগণমন’ নিয়ে

১৩ জুন, ১৯৪৭ সালের ব্রিটেনের পার্লামেন্ট ভারতের গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেনকে পরামর্শ দেয়, আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ধরে রাখার। এদিকে মাউন্টব্যাটেন ভারত ছেড়ে বেরতে চাইছিলেন। তিনি ইন্ডিপেন্ডেন্স কমিটিকে প্রস্তাব দেন, আন্দামান সরাসরি ব্রিটেনের অন্তর্গত না হলেও ভারত যেন ব্রিটেনকে লিজে দিয়ে দেয় আন্দামান এবং নিকোবর। এই নিয়ে দু'পক্ষের মধ্যে বেশ কিছু গোপন চিঠি চালাচালি হয়। কিন্তু এই খবরটি ফাঁস করে দেয় 'টাইমস অফ ইন্ডিয়া'। খবর ফাঁস হতেই মাউন্টব্যাটেন বুঝে যান আন্দামানের সমস্যা শীঘ্রই না মেটালে ক্ষমতা হস্তান্তরকরণের প্রক্রিয়ায় সমস্যা অবশ্যম্ভাবী। একদিকে পার্লামেন্টের চাপ অন্যদিকে ইন্ডিপেন্ডেন্স কমিটির আন্দামান না ছাড়ার জেদ, দুইয়ের মাঝে মাউন্টব্যাটেন একটি সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে চিঠি লিখে জানান, আপাতত আন্দামানের ক্ষমতা ভারতকে দিয়ে দেওয়া হোক। পরবর্তীকালে ভারতের সঙ্গে কথা বলে ব্রিটেন এবং ভারত উভয়পক্ষেরই স্বার্থ রক্ষা করে আন্দামান নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি এবং ইন্ডিপেন্ডেন্স কমিটির নেতা জওহরলাল নেহরু দু'জনেই এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান।

এই আলোচনার মাঝেই এন্ট্রি হয় মুসলিম লিগের। মহম্মদ আলি জিন্নাহ দাবি করে বসেন, যেভাবে ভারতের অন্যান্য জায়গার বাঁটোয়ারা হয়েছে, সেভাবেই আন্দামান ও নিকোবরেরও হবে। নিজের দাবির সপক্ষে তিনি তিনটি যুক্তি পেশ করেন। প্রথমত, পাকিস্তানের দু'টি অংশ- পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝখানে ভারত অবস্থান করছে। সুতরাং, যদি কখনও ভারত নিজের আকাশপথ ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকার করে, তখন সমুদ্রপথই একমাত্র উপায়। সেক্ষেত্রে তাদের কাছে আন্দামানের গুরুত্ব অপরিসীম।

দ্বিতীয়ত, আন্দামান কখনওই ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিকভাবে ভারতের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। এখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা আদিবাসী। তাই আন্দামানকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার কোনও মানে হয় না।

তৃতীয়ত, আন্দামানের জনসংখ্যার প্রায় ২৪ শতাংশ মুসলিম। জনসংখ্যার এত বড় একটি অংশ মুসলমান হওয়ায় আন্দামান ও নিকোবরকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করিয়ে দেওয়া উচিত।

ক্লিমেন্ট অ্যাটলি

এই যুক্তিগুলি সাজিয়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি, ব্রিটেনের পার্লামেন্টের বিরোধী দলনেতা উইনস্টন চার্চিল এবং ভারতের গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেনকে চিঠি লেখেন জিন্নাহ। প্রত্যেকেই জিন্নাহ-র কথায় রাজি হয়ে যান, কিন্তু মাউন্টব্যাটেন ঠিক করেন, নেহরুর সঙ্গে এই বিষয়ে পরামর্শ করার। জিন্নাহ-র যুক্তির পাল্টা তিনটি যুক্তি খাড়া করেন জওহরলাল নেহরু, সেগুলি আরও অকাট্য। প্রথমত, ভারত আকাশপথ বন্ধ করে দিলেও আন্দামানে না গিয়েও চট্টগ্রাম থেকে করাচি যাতায়াত করা যায়। জলপথে অনেকটা জায়গা ফাঁকা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, তিনি তুলে ধরেন রাজেন্দ্র চোল এবং মারাঠা সাম্রাজ্যের ইতিহাসের দিকটি। তৃতীয়ত, ১৯৪১ সালের জনগণনা অনুযায়ী আন্দামান ও নিকোবর-এর মোট ৩৪ হাজার মানুষের মধ্যে ১২,০০০ হিন্দু, ৮,০০০ মুসলমান এবং বাকিরা শিখ-জৈন-খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মের। জিন্নাহ এবার ব্যাকফুটে। তিনি আরেকটি চিঠিতে লেখেন যেহেতু হিন্দু আধিক্য নেই তাই আন্দামান ও নিকোবরের বাঁটোয়ারা হোক। জবাবে নেহরু লেখেন, হিন্দু আধিক্য নেই ঠিকই, কিন্তু অ-মুসলিম জনসংখ্যাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। উপরন্তু আন্দামানের একটি বৃহৎ অংশের মানুষ মাদ্রাজ, কেরল এবং বাংলা থেকে এসে এখানে বসবাস করছেন। এছাড়াও আন্দামানের ন্যায়তন্ত্র চালিত হয় কলকাতা হাই কোর্ট থেকে। সুতরাং, পাকিস্তানকে আন্দামান ও নিকোবর কোনও মতেই দেওয়া যাবে না।

পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর এই চিঠি পাঠিয়ে দেওয়া হয় ক্লিমেন্ট অ্যাটলির কাছে। কিন্তু এই চিঠি পড়ে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে দেখে মাউন্টব্যাটেন পরামর্শ দেন, আপাতত ইনডিপেনডেন্স অ্যাক্ট থেকে বাদ রাখা হোক আন্দামান এবং নিকোবরকে। পরবর্তীকালে ভারত এবং ব্রিটেন আলোচনা করে আন্দামান-সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। নেহরু রাজি হয়ে গেলেন। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়ে গেল ভারত। কিন্তু আন্দামান ও নিকোবর তখনও ভারতের অধীনে এলো না। এল ১৯৫৬ সালে। মাউন্টব্যাটেন ক্লিমেন্ট অ্যাটলি-কে বুঝিয়েছিলেন ভারতকেই দিয়ে দেওয়া হোক আন্দামান ও নিকোবর। নিজের সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর বন্ধুত্বের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, পরবর্তীকালে সামরিক কারণে ব্রিটেনের যদি আন্দামানের দরকার পড়ে, তাহলে ভারত না করবে না। যথারীতি মাউন্টব্যাটেনের কথা শুনে আন্দামান ও নিকোবরের অন্তর্ভুক্তি করিয়ে দেওয়া হলো ভারতের সঙ্গে। অন্তর্ভুক্তির পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সরাসরি জানিয়ে দেন, ভারতের জমি অন্য কোনও বিদেশি শক্তিকে তিনি সামরিক কারণে ব্যবহার করতে দেবেন না। ফলত ব্রিটেনের জওহরলাল নেহরুর প্রতি যে অগাধ আস্থা ছিল, তা কার্যত মাঠে মারা যায়।

More Articles