২,৫০০ টাকার দুর্গাপুজোর জাঁকজমক চোখ ধাঁধিয়ে দিত, সেই কলকাতা ধরা আছে প্রবাদে

বাঙালির দুর্গাপুজোর মধ্যে বনেদি এবং সার্বজনীন পুজো নিজেদের বিশেষত্ব নিয়ে সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। কলকাতা তার ব্যতিক্রম নয়, যেখানে মানুষ কয়েকটা দিন উৎসবের আনন্দে মেতে উঠবে বলে একটা গোটা বছর প্রতীক্ষা এবং প্রস্তুতির মধ্যে...

 

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় উৎসব বাঙালির দুর্গাপুজো। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের মতো কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় দুই ধরনের দুর্গাপুজো দেখা যায়। বাড়ির পুজো এবং সার্বজনীন পুজো। কলকাতায় পুজোর ইতিহাস শুরু হয় জমিদারবাড়ির পুজো থেকে, যদিও বর্তমানে বাড়ির এবং সার্বজনীন পুজো সমান জনপ্রিয়।

লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পূর্বসূরি ছিলেন। তিনি প্রথমে মজুমদার এবং পরে রায়চৌধুরী উপাধি পেয়েছিলেন। ১৬০৮ সালে তিনি আটটি, মতান্তরে ন'টি পরগনার জমিদারির সত্ব পেয়েছিলেন। লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় ১৬১০ সালে নিজের বাড়িতে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন। দক্ষিণ কলকাতা সংলগ্ন এই পুজোকে কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকার প্রথম বাড়ির দুর্গাপুজো হিসেবে ধরা যেতে পারে।

পুরনো কলকাতায় দুর্গাপুজো সংক্রান্ত একটা প্রবাদ ছিল। সেই প্রবাদ অনুযায়ী দেবী দুর্গা পুজোর দিনে ভোজন করতেন কুমোরটুলির অভয়চরণ মিত্রর বাড়িতে, গয়না পরতেন জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ-র বাড়িতে, আর গান, নাচ দেখতেন শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে। উত্তর কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব। পুজোর রাতগুলোতে কবিগানের আসর দেখার জন্য তাঁর বাড়িতে প্রচুর জনসমাগম হতো। এই কবিগানের আসরে অংশগ্রহণ করতেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, ভোলা ময়রার মতো জনপ্রিয় কবিয়ালরা।

আরও পড়ুন: বাঙালির দুর্গাপুজো শুরু হলো কীভাবে, কত খরচ হয়েছিল সেকালের পুজোয়?

১৭৫৭ সালের পর তার দেখাদেখি কলকাতা এবং সংলগ্ন এলাকায় বিভিন্ন জমিদারবাড়িতে দুর্গাপুজোর আয়োজন শুরু হয়। সাধারণ মানুষ বিভিন্ন জমিদারবাড়িতে আয়োজিত দুর্গাপুজোকে কেবলমাত্র পুজোয় সীমাবদ্ধ না রেখে জমিদার পরিবারগুলির মর্যাদার প্রতীক হিসেবে দেখতে শুরু করে। ১৮৪০ সালে জোড়াসাঁকোর গোকুলচন্দ্র দাঁ নিজের বাড়ির ঠাকুরদালানে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। তার ছেলে শিবকৃষ্ণ দাঁ-র সময় দাঁ-বাড়ির পুজোর কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিমার চালচিত্র তৈরি করতে সোনা, হিরে এবং পান্না ব্যবহার করা হতো। পুরনো নথি থেকে জানা যায় যে, সেই সময়ের এক বছরের পুজোর খরচ ছিল প্রায় ২,৫০০ টাকা। কথিত আছে, কুমোরটুলির অভয়চরণ মিত্রর বাড়ির পুজোর নৈবেদ্য হিসেবে কয়েক মণ চাল ব্যবহার করা হতো। এই জমিদারবাড়িগুলোর পুজোর জাঁকজমক ক্রমে কলকাতায় দুর্গাপুজো সংক্রান্ত প্রবাদ হিসেবে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল।

১৯০৯ সালে কলকাতায় বারোইয়ারি পুজোর সূচনা হয়। ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা এই পুজোর আয়োজন করেছিল। এই পুজো উপলক্ষে অরবিন্দ ঘোষ তাঁর 'ধর্ম' পত্রিকায় দুর্গাস্তোত্র প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে বারোইয়ারি পুজোর সূচনা হয়। ১৯১১ সালে শ্যামপুকুর আদি সার্বজনীন পুজোর সূচনা হয়। ১৯১৩ সালে শ্যামপুকুরের অনতিদূরে সিকদারবাগান সার্বজনীন দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। ১৯১৯ সালে উত্তর কলকাতায় নেবুবাগান বারোইয়ারি দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। এই সার্বজনীন দুর্গাপুজো বর্তমানে বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গাপুজো নামে পরিচিত। ১৯৩৮-১৯৩৯ সাল অবধি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এই পুজো কমিটির প্রধান ছিলেন। ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোর সূচনা হয়। বর্তমানে কলকাতা এবং কলকাতা-সংলগ্ন এলাকায় ২০০০-এর বেশি বারোইয়ারি দুর্গাপুজোর আয়োজন হয়।

বাঙালির দুর্গাপুজোর মধ্যে বনেদি এবং সার্বজনীন পুজো নিজেদের বিশেষত্ব নিয়ে সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। কলকাতা তার ব্যতিক্রম নয়, যেখানে মানুষ কয়েকটা দিন উৎসবের আনন্দে মেতে উঠবে বলে একটা গোটা বছর প্রতীক্ষা এবং প্রস্তুতির মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে দেয়। সময়ের সঙ্গে প্রতি বছর বাড়ির এবং সার্বজনীন পুজো ভিন্ন রূপে আমাদের চোখে ধরা দেয়।

More Articles