মুম্বইয়ের রঙ কোম্পানি বদলে দিল বাংলার দুর্গাপুজো! কীভাবে শুরু হল থিমের পুজো?
Theme Durga Puja Kolkata: ১৯৮৫ সালে পুজোয় এশিয়ান পেইন্টসের ট্যাগলাইন ছিল, ‘শুদ্ধ শুচি, সুস্থ রুচি’। এর অর্থ হল, প্যান্ডেল-প্রতিমা-আলোকসজ্জা সবকিছুর মধ্যেই থাকতে হবে শুদ্ধতা এবং সুস্থ রুচির পরিচয়
বাঙালি বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন দুর্গাপুজো তার মনে নিয়ে আসে নস্টালজিয়ার ছোঁয়া। শুধুমাত্র এই পাঁচটা দিনের অপেক্ষা করেই সারা বছর কাটিয়ে দিতে পারে বাঙালি। উৎসবের সময় নতুন করে সেজে ওঠে কল্লোলিনী তিলোত্তমা। বাঙালির কাছে পুজো মানেই দেদার পরিকল্পনা, অনেক গোছগাছ, হুল্লোড়। একদিকে যেমন আছে ঠাকুর দেখা, খাওয়াদাওয়া, হঠাৎ এক ঝলক কাউকে দেখে প্রেমে পড়ে যাওয়া তেমনই অন্যদিকে আছে কোথায় কী থিম হতে চলেছে তার লাগাতার খোঁজ নেওয়া। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আমার এক বন্ধু আমাকে একটি বিশেষ ক্যাটালগ দেখাত, পুজোর ক্যাটালগ! সেই ক্যাটালগে লেখা থাকতো সেই বছর কোন পুজোর থিম কী। বহুবার জিজ্ঞেস করলেও অবশ্য সেই ক্যাটালগের হদিশ দিত না বন্ধুটি। বাঙালির এই থিম পুজোর দিকে ঝোঁক কেন এত বাড়ল হঠাৎ?
ঐতিহাসিকদের মতে ১৬০৬ সালে বাংলায় প্রথম দুর্গাপুজো হয়। আগে পুজো জমিদার এবং উচ্চবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাই অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে (১৭৬০-৮০-র মধ্যে) গুপ্তিপাড়ার ১২ জন বন্ধু মিলে ঠিক করেছিলেন তাঁরা সমাজের সব স্তরের মানুষকে নিয়ে একটি দুর্গাপুজো করবেন। সেই ভাবনা থেকেই শুরু হয় বারোয়ারি পুজো। শুরু হয় বাংলায় প্রথম চাঁদা তুলে পুজোর ধারণা। ‘বারো জন ইয়ার’ বা বন্ধু মিলে এই পুজো শুরু করেন বলে তার নাম লোকমুখে হয়ে যায় বারো-ইয়ারি পুজো, সেখান থেকে অপভ্রংশ হয়ে বারোয়ারি। হাওড়ার গুপ্তিপাড়ায় অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে এই ‘বিপ্লব’ শুরু হলেও কলকাতায় কিন্তু সেই ঢেউ পৌঁছাতে লেগেছিল আরও দেড়শো বছর।
ইতিহাসবিদদের মতে, কলকাতায় প্রথম বারোয়ারি পুজো হয় ১৯১০ সালে। কলকাতার প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয় ভবানীপুরে, বলরাম বসু ঘাট রোডে। সেবার এই পুজোর আয়োজক ছিল ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা। বর্তমানে অবশ্য বারোয়ারি পুজোর অনেকাংশ দখল করে নিয়েছে থিম পুজো। দুর্গাপুজোর এই বিবর্তন সত্যিই অবাক করা। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল বনেদি পরিবারগুলির মধ্যে। প্রায় ২৬০ বছর আগে তা বারোয়ারি রূপ পায়। কলকাতায় অবশ্য ১১২ বছর আগে প্রথম বারোয়ারি পুজো হয়। বর্তমানে অবশ্য বারোয়ারি পুজোগুলি থিম পুজোর রূপ নিয়েছে। তবে এই যে থিম পুজো নিয়ে এখন এত হইচই, এর শুরু কোথায়? কলকাতার প্রথম থিম পুজো ছিল কোনটি?
আরও পড়ুন- মুসলিম কন্যাকে কুমারী রূপে পুজো করেছিলেন বিবেকানন্দ, কীভাবে বাংলায় শুরু হল কুমারী পুজো
ক্যালেন্ডারের পাতা বলছে, সালটা ১৯৮৫। বছরের গোড়ায় মুম্বইয়ের একটি রঙ কোম্পানির অফিসের মিটিং রুমে গুরুগম্ভীর বৈঠক চলছে। স্ট্র্যাটেজি বানানো হচ্ছে কীভাবে পূর্ব ভারতে নিজেদের ব্যবসা বাড়ানো যায়। সুদীর্ঘ মিটিংয়ের পর তারা একটি সিদ্ধান্ত নেয় যা চিরকালের মতো বদলাতে চলেছিল বাঙালির সংস্কৃতি। হয় তো সেই সময় ওই সংস্থাও জানত না যে, বাঙালির পুজোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাবে সেই রঙয়ের কোম্পানির নাম। কোম্পানিটি হল এশিয়ান পেইন্টস। বাংলায় এখন যে থিম পুজো হয় তার ভিত্তি কিন্তু স্থাপন করেছিল এশিয়ান পেইন্টস। দুর্গা পুজোরও যে থিম হতে পারে, প্যান্ডেল থেকে শুরু করে প্রতিমা, আলোকসজ্জা থেকে শুরু করে লাউডস্পিকারে থিম অনুযায়ী আবহসংগীত ব্যবহার করা যেতে পারে, বাঙালি তা জানতেই পারত না যদি না এশিয়ান পেইন্টস পূর্ব ভারতে তাদের ব্যবসা বড় করার কথা ভাবত।
আশির দশকে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র চাঁদা তুলে বারোয়ারি পুজোর তখন রমরমা। এদিক-ওদিক বিক্ষিপ্তভাবে কিছু নতুন ধরনের কাজ হলেও তা একেবারেই নগণ্য এবং মানুষের মন জয় করতে ব্যর্থ। তবে এবার শহর কলকাতাকে দিয়ে ‘আউট অফ দ্য বক্স’ কাজ করানোর সিদ্ধান্ত নিল এশিয়ান পেইন্টস। দুর্গাপুজোয় তারাই প্রথম চালু করল শারদ সম্মান। আজও দুর্গাপুজোয় এশিয়ান পেইন্টসের শারদ সম্মান পুরস্কারটিকেই অন্যতম সেরা পুরস্কারের স্থান দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালে পুজোয় এশিয়ান পেইন্টসের ট্যাগলাইন ছিল, ‘শুদ্ধ শুচি, সুস্থ রুচি’। এর অর্থ হল, প্যান্ডেল-প্রতিমা-আলোকসজ্জা সবকিছুর মধ্যেই থাকতে হবে শুদ্ধতা এবং সুস্থ রুচির পরিচয়, তবেই আপনার পুজোটি হয়ে উঠবে সেরা!
আরও পড়ুন- কীভাবে বাংলায় এল জনপ্রিয় ক্যাপ বন্দুক! অবাক করবে দুর্গাপুজোর এই খেলনার ইতিহাস
৩৭ বছর আগের এই ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপনের ক্যাম্পেইন আক্ষরিক অর্থেই বদলে দিয়েছিল বাঙালির পুজোর চালচিত্র। এই পুরস্কারের চক্করে পড়েই কলকাতার সার্বজনীন দুর্গোৎসব রাতারাতি পাল্টে গেল। গতানুগতিক পুজোর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে সৃজনশীল কিছু করার কথা চিন্তা করতে লাগল পুজোকমিটি গুলি। ফলত পুজোকমিটির লোকেদের ভিড় জমতে থাকল গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের বাইরে। তাদের ইচ্ছে আর্ট কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে নিজেদের পুজোর প্যান্ডেল-প্রতিমা-আলোকসজ্জা করাবেন। সেইসময় পুজো কমিটিগুলির লক্ষ্য একটাই, সুস্থ-সুন্দর কোনও ধারণা বা থিমকে নিজেদের পুজোর মধ্যে ফুটিয়ে তোলা। এহেন কাজের জন্য আর্ট কলেজের সৃজনশীল ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া ভালো আর কেই বা হতে পারে। রসিকতা করে বলা যেতে পারে, সে বছর দুর্গাপুজো খানিকটা আর্ট কলেজের বাৎসরিক এগজিবিশনের মতোই হয়েছিল। সে বছর দুর্গা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে নিত্য নতুন রূপে দেখা দিতে শুরু করলেন। মণ্ডপসজ্জা মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। বাঙালি এর আগে কখনও এমন জিনিস দেখেইনি। অতুলনীয় মণ্ডপসজ্জা, তার মধ্যে আবহে বাজছে মানানসই মিউজিক, সঙ্গে অপূর্ব সুন্দর প্রতিমা! মোট কথা, বিগত ৭৫ বছর ধরে বারোয়ারি পুজো দেখে আসা বাঙালি সেবার নতুন কিছুর স্বাদ পেল।
দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে এই মার্কেটিং স্ট্রাটেজি পূর্ব ভারতে এশিয়ান পেইন্টসকে পায়ের তলায় বেশ কিছুটা মাটি জোগালো। এই স্ট্রাটেজির ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। আজও পূর্ব ভারতের রঙয়ের বাজারে বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মার্কেট শেয়ার দখল করে রয়েছে এশিয়ান পেইন্টস। ওই ১৯৮৫-র পুজোর পর থেকেই পাল্টাতে শুরু করে বাঙালির রুচি। আগামী ছয়-সাত বছরের মধ্যে বারোয়ারি পুজোর পাশাপাশি উঠে এলো থিম পুজো। মোটামুটি ১৯৯৫ সালের পর থেকেই থিমপুজোর বাড়বাড়ন্ত দেখা যায়। বর্তমানে অধিকাংশ পুজোই থিমভিত্তিক। যদিও কিছু বারোয়ারি পুজো এখনো স্বমহিমায় টিকে রয়েছে।