এদেশেই মিলেছিল পারমাণবিক বোমার রসদ! ভারতের এই রাজ্যই ছিল ব্রিটিশদের পাখির চোখ

Travancore Thorium Politics: মজার বিষয় হল, যে থোরিয়ামের ভাণ্ডার নিয়ে এত ঝামেলা, ১৯৫০ সালে সেই থোরিয়াম উত্তোলনের জন্য আমেরিকাকে অনুমতি দিয়ে দেয় খোদ ভারত সরকার।

২০২৩ সালের ২১ জুলাই মুক্তি পেতে চলেছে ক্রিস্টোফার নোলানের বহু প্রতীক্ষিত সিনেমা ‘ওপেনহাইমার’। পরমাণু বোমার জনক রবার্ট জে ওপেনহাইমার পৃথিবীর প্রথম পরমাণু বোমা পরীক্ষা করেছিলেন ১৯৪৫ সালে। নিউক্লিয়ার শক্তির ক্ষমতা দেখে অভিভূত ওপেনহাইমার ভগবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণের বলা একটি শ্লোক উল্লেখ করে বলেছিলেন, “আমিই মৃত্যু, ব্রহ্মাণ্ডকে ধ্বংস করতে পারে যে”। ১৬ জুলাই ১৯৪৫, পৃথিবীতে প্রথম নিউক্লিয়ার বোমার পরীক্ষা হয় এবং এর ২০ দিনের মাথায় হিরোশিমায় নিউক্লিয়ার বোমা ফেলে আমেরিকা। তবে আমেরিকা, নিউক্লিয়ার বোমা এবং শ্রীকৃষ্ণের যোগসূত্র এখানেই শেষ নয়। আজ আপনাদের শোনাব একটি ঘটনার কথা, যখন পরমাণু শক্তিভাণ্ডার দখল করার জন্য আমেরিকা ভারতের এমন একটি রাজ্য করতে চেয়েছিল যার অধিকর্তা ছিলেন স্বয়ং বিষ্ণু।

ঘটনার সূত্রপাত আঠেরো শতকের মধ্যভাগে। ত্রিবাঙ্কুরে সামন্ত প্রথা উচ্ছেদ করে রাজা হয়েছেন মার্তণ্ড বর্মা। একদিকে সামন্তদের উচ্ছেদ করেছেন, আরেক দিকে রুখে দিয়েছেন ডাচ আক্রমণ। রাজা হয়েই রাজ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠার কারণে শ্রীঅনন্তপদ্মনাভস্বামী মন্দির পুনঃসংস্কার করেন তিনি। শুধু মন্দির পুনঃসংস্কারই নয়, নিজের সম্পূর্ণ রাজ্য শ্রীপদ্মনাভস্বামীর উদ্দেশ্যে দান করে দেন মার্তণ্ড। একইসঙ্গে পণ করেন, তিনি এবং তাঁর বংশধররা পদ্মনাভস্বামীর সেবক হয়ে রাজ্য শাসন করবেন। এরপর থেকে রাজ পরিবারের সকল পুরুষের নামের আগে ‘পদ্মনাভদাস’ এবং সকল মহিলার নামের আগে ‘পদ্মনাভসেবিনী’ উপাধি বসানো হয়। ১৯২৪ সালে এই বংশের শেষ রাজা বলরাম বর্মা ক্ষমতায় আসীন হন। ১৯৪৫ সালে ভারতের এই ছোট্ট রাজ্যটি বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে, কারণ ত্রিবাঙ্কুরে পাওয়া যাচ্ছিল মোনাজাইট। নাগরকইন এবং কোল্লামের মধ্যবর্তী এলাকায় ছিল মোনাজাইটের ভাণ্ডার। এর আগে মোনাজাইটের ব্যবহার মূলত করা হত শক্তি উৎপাদনের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরমাণু শক্তির গুরুত্ব বুঝতে পারে শক্তিশালী দেশগুলি। এই সময় জানা যায়, মোনাজাইট থেকে থোরিয়াম নিষ্কাশন করা যায়, যার মাধ্যমে ইউরেনিয়াম তৈরি করা যেতে পারে।

শ্রীঅনন্তপদ্মনাভস্বামী মন্দির

ফলত মোনাজাইটের গুরুত্ব বুঝতে পারে ব্রিটিশ সরকার। শুধু ব্রিটিশ সরকারই নয়, এর গুরুত্ব বুঝেছিল ত্রিবাঙ্কুরও। নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলার কয়েকদিন পর ত্রিবাঙ্কুরের দেওয়ান সি পি রামাস্বামী রাজা বলরাম বর্মাকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি মহারাজকে জানান, বিশ্বজুড়ে থোরিয়ামের চাহিদার জন্য অদূর ভবিষ্যতেই ত্রিবাঙ্কুরের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমেরিকা বিশ্বের সব নিউক্লিয়ার সাপ্লাইগুলিতে নিজের দখল কায়েম করতে সচেষ্ট হয়। ফলত ১৯৪৬ সালে ত্রিবাঙ্কুরের সঙ্গে তারা গোপনে দর কষাকষি শুরু করে। ১৯৪৬-এর মধ্যভাগেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভারতে ব্রিটিশদের দিন ঘনিয়ে এসেছে। এমতাবস্থায় ভারত স্বাধীন হলে ত্রিবাঙ্কুর যদি ভারতের সঙ্গে জুড়ে যায়, তাহলে সেখান থেকে মোনাজাইট তোলা কঠিন হবে আমেরিকার জন্য। আমেরিকা চেয়েছিল বেলজিয়াম বা থাইল্যান্ডের মতো আকারে ছোট হওয়া সত্ত্বেও ত্রিবাঙ্কুর যেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে। তাহলে মোনাজাইটের খনিগুলিতে একাধিপত্য স্থাপন করতে সুবিধা হবে আমেরিকার। এই একই পরিকল্পনা ছিল ব্রিটেনেরও।

সি পি রামাস্বামী

তবে এই সময় ভারতে শুরু হয়ে গিয়েছিল পরমাণু শক্তি নিয়ে যাবতীয় রিসার্চ। গবেষণার কাজে হোমি জাহাঙ্গির ভাবা প্রথমে ইউরেনিয়াম ব্যবহার করার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু পরমাণু বিজ্ঞানে থোরিয়াম ব্যবহারের কথা জানতে পেরেই তিনি ত্রিবাঙ্কুরের থোরিয়াম ব্যবহার করতে উদ্যত হন। সেবছর সিএসআইআরের তরফে জানানো হয় ত্রিবাঙ্কুরের মোনাজাইট খনিগুলি দেখতে তারা প্রতিনিধি দল পাঠাবে। পরবর্তী সময়ে ভারত সরকারের থেকে বেশি সুবিধা নেওয়ার আশায় ত্রিবাঙ্কুর এক বাক্যে রাজি হয়ে যায়। দেওয়ান রামাস্বামী ভারতের অন্তর্বর্তী সরকারকে জানিয়ে দেন, পরবর্তী অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত ত্রিবাঙ্কুরে মোনাজাইট উত্তোলন বন্ধ থাকবে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই জানা যায়, এই প্রতিশ্রুতি সম্পূর্ণ মিথ্যে ছিল! সম্পূর্ণ গোপনে তারা ব্রিটেনের সঙ্গে ৯০০ টন মোনাজাইট চুক্তি আগেই করে ফেলেছিল। এই ঘটনা সামনে আসতে জওহরলাল নেহেরু এতটাই ক্ষেপে যান যে সংসদে প্রস্তাব দেন ত্রিবাঙ্কুরে বোমা ফেলা হোক। তবে হোমি জাহাঙ্গির ভাবা ও ড. শান্তি স্বরূপ ভাটনাগর তাঁকে শান্ত করেন এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে দু'জনে ত্রিবাঙ্কুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এপ্রিল ১৯৪৭-এ হোমি ভাবা ত্রিবাঙ্কুরের রাজ পরিবারকে দিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করান। এই চুক্তির ফলে মনে হচ্ছিল ত্রিবাঙ্কুর এবং ভারত সরকারের যা মনোমালিন্য আছে তা মিটে যাবে।

হোমি জাহাঙ্গির ভাবা

তবে এবার এল গল্পের 'টুইস্ট'। প্রথমে ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করলেও ১১ জুলাই ১৯৪৭ সালে রামাস্বামী ঘোষণা করে দেন ত্রিবাঙ্কুর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখবে। ঘোষণার দিনই সেখানকার পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয় এবং ত্রিবাঙ্কুর কংগ্রেসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আমেরিকা এই সম্পূর্ণ ঘটনাবলীর উপর খুব মন দিয়ে নজর রাখছিল। ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ নীতি নিয়েছিল তারা। এইসব খবর সামনে আসতেই জওহরলাল নেহেরু ত্রিবাঙ্কুরের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, রেশন, বস্ত্র, জল সবকিছুর যোগান বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বাধ্য হয়ে ত্রিবাঙ্কুর সাহায্য চায় বার্মা, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, আমেরিকা, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশের। সাহায্য মেলেও। এদিকে ভারতে হিন্দু মহাসভার তরফ থেকে দামোদর সাভারকার ত্রিবাঙ্কুরের প্রভূত প্রশংসা করেন। এক প্রতিবেদনে তিনি লেখেন, যদি হায়দরাবাদ একটি মুসলিম রাজ্য হয়ে নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করতে পারে, তাহলে একটি হিন্দুরাষ্ট্র ত্রিবাঙ্কুর কেন পারবে না।

সি পি রামাস্বামী, জওহরলাল নেহরু, রাজা বলরাম বর্মা

আরও পড়ুন-লাস্য, যৌনতা আর ৫০ হাজার মৃত্যুর দায়! বিশ্বের ভয়াবহ এই গুপ্তচরের গল্প হার মানায় সিনেমাকেও

ত্রিবাঙ্কুর একটি ছোট রাজ্য ছিল। খনিজের কোনও অভাব ছিল না, বিদেশ থেকেও যথারীতি সাহায্য মিলছিল। শ্রীঅনন্তপদ্মনাভস্বামী মন্দিরের বিপুল রত্নভাণ্ডার, নিজস্ব বন্দর, সামনে সমুদ্র সবই ছিল। ফলত সেখানকার রাজারা চাইলে ত্রিবাঙ্কুর একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে দিব্যি থাকতে পারত। কিন্তু এতে বাধা হয়ে দাঁড়াল ত্রিবাঙ্কুরের আমজনতা। ত্রিবাঙ্কুরে জাতিভেদ প্রথা চরমে পৌঁছে ছিল। নিম্নবর্গীয় মানুষ এবং দলিতদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হতো সেখানে। আর এসবই হচ্ছিল সেখানকার রাজপরিবারের অনুমতিতেই। ফলে আমজনতার মধ্যে রোষ ছিল। ত্রিবাঙ্কুরের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজ্য জুড়ে আন্দোলন শুরু করে ত্রিবাঙ্কুর কংগ্রেস।

এর মধ্যেই দেওয়ান সি পি রামাস্বামী-সহ রাজ পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যের ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণ হয়। কেউ নিহত না হলেও, রাজা বলরাম বর্মা বুঝে গিয়েছিলেন পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেছে। এরপর ৩০ জুলাই ১৯৪৭, সরকারিভাবে ত্রিবাঙ্কুর ভারতের সঙ্গে জুড়ে যায়। স্বাধীনতার পর ত্রিবাঙ্কুরকে কোচিনের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় এবং তার রাজ্যপ্রমুখ করা হয় মহারাজা বলরাম বর্মাকে। ১৯৫৬ সালে কেরল রাজ্য গঠন হওয়ার পরে সেই পদের অবলুপ্তি হয়ে যায়। তবে মজার বিষয় হল, যে থোরিয়ামের ভাণ্ডার নিয়ে এত ঝামেলা, ১৯৫০ সালে সেই থোরিয়াম উত্তোলনের জন্য আমেরিকাকে অনুমতি দিয়ে দেয় খোদ ভারত সরকার। পরবর্তীকালে ব্রাজিল এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে থোরিয়ামের ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হওয়ায় ত্রিবাঙ্কুরের গুরুত্ব ক্রমশ কমে যায় আন্তর্জাতিক স্তরে।

More Articles