তিরঙ্গা নয়, তার নাম ছিল 'কলকাতা পতাকা', জাতীয় পতাকার যে ইতিহাস রয়ে গেছে আড়ালে

মহাকালের রথের চাকা যতবারই ঘুরেছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ততবারই পরিবর্তিত হয়েছে ভারতীয় জাতীয় পতাকার আদল।

স্বাধীনতা দিবস, যে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন ভারতের হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট এসেছিল ভারতের বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা, তবে তার আগে ভারতের মাটি সাক্ষী থেকেছে বহু আগুনঝরা বিপ্লবের। কিন্তু ১৯৪৭ সালের আগেও পালিত হতো ভারতের স্বাধীনতা। হ্যাঁ শুনতে অবাক লাগলেও ভারতের স্বাধীনতা দিবস কিন্তু পূর্বে পালিত হতো ২৬ জানুয়ারি। সালটা ১৯২৯। কংগ্রেসের মসনদে তখন জহরলাল নেহেরু। এই সময় তিনি ডাক দিলেন ভারতের বুকে পূর্ণ স্বরাজ প্রতিষ্ঠার। সেইমতো কংগ্রেসও ১৯৩০ সাল থেকে ২৬ জানুয়ারিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করত।

কিন্তু স্বাধীনতা দিবসের দিনটি হঠাৎ পরিবর্তিত হল কেন? আসলে রাজনীতির কূটকৌশলের মধ্যে লুকিয়ে আছে এই প্রশ্নের উত্তর। ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক পদানত ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের শেষ দিন ধার্য হয়েছিল ৩০ জুন, ১৯৪৮। কিন্তু ততদিনে ব্রিটিশদের দর্পচূর্ণ করা সম্ভব হয়েছে, বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার আশায় আপামর ভারতবাসী উদ্বেলিত। অন্যদিকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন তখন ক্ষমতা হস্তান্তরের সামগ্রিক প্রক্রিয়া সবে শুরু করেছেন। তিনি পড়লেন বিপদে, কারণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া যত শ্লথ হয়ে পড়বে, ততই ভারতবাসী ব্রিটিশদের ভারতছাড়া করতে উদগ্রীব হয়ে পড়বে। ফলে আবারও শুরু হবে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন, যাকে ততদিনে ভয় পেতে শুরু করেছে ব্রিটিশরা। এই কারণেই ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন এগিয়ে আনলেন মাউন্টব্যাটেন। সেইমতো ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা লাভ করল ভারত।

এ তো গেল ভারতের স্বাধীনতার গল্প, কিন্তু ভারতের জাতীয় পতাকার পিছনেও আছে এক অনন্য ইতিহাস। ভারতের জাতীয় পতাকার নকশা প্রস্তুত করেছিলেন পিঙ্গালি ভেঙ্কাইয়া। এক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছিল স্বরাজ পতাকা। তবে এই প্রথম নয়, এর আগেও বহুবার বদল ঘটেছে ভারতীয় জাতীয় পতাকার। মহাকালের রথের চাকা যতবারই ঘুরেছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ততবারই পরিবর্তিত হয়েছে ভারতীয় জাতীয় পতাকার আদল। এমনকী, ১৯০৪ সাল নাগাদ ভগিনী নিবেদিতা স্বয়ং জাতীয় পতাকার নকশা প্রণয়ন করেন। মহানগরী কলকাতার নামও একাধিকবার জড়িয়েছে ভারতীয় জাতীয় পতাকার সঙ্গে। সালটা ১৯০৬, ৭ অগাস্ট। সমগ্র কলকাতা কলকাতা সেদিন ভেঙে পড়েছে পার্শিবাগান অঞ্চলে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আপামর তিলোত্তমাবাসীকে সাক্ষী রেখে কলকাতার পার্শিবাগান অঞ্চলে উত্তোলিত হলো ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা। পরবর্তী সময়ে এই পতাকা পরিচিত হয় 'কলকাতা পতাকা' নামে। আরও পরে জানা যায় একটি পতাকার কথা, ১৯০৭ সালের ২২ জুলাই জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে ভিকাজি কামার হাতে একটি পতাকা উত্তোলিত হলো। যে পতাকার মূল মন্ত্র ছিল ধর্মনিরপেক্ষ ভারত। কারণ এই পতাকার মধ্যে ব্যবহৃত হতো সবুজ, গেরুয়া এবং লাল রং। সবুজ রং-এর মাধ্যমে ইসলাম এবং গেরুয়া রংয়ের মাধ্যমে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মকে বোঝানো হতো।

আরও পড়ুন: ব্রিটিশদের ভারতছাড়া করতে বাধ্য করেছিল সেই বিদ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতার বিষ পালটে দিল ইতিহাস

না, এখানেই শেষ নয়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পাশাপাশি হোমরুল আন্দোলনকে পাথেয় করে তৈরি হলো আবারও ভারতের জাতীয় পতাকা। এই নব জাতীয় পতাকার হাত ধরেই বোধহয় নতুন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন আন্দোলনকারীরা। সপ্তর্ষিমণ্ডলের চিহ্নস্বরূপ সাতটি তারা স্থানটিতে ওই পতাকায়। ১৯৩১ সালের করাচি অধিবেশন থেকে পাশ হয় ভারতের জাতীয় পতাকা-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৭ সালের ২৩ জুন গঠিত হয় একটি পতাকা কমিটি। এই কমিটি ১৯৪৭ সালের ১৪ জুলাই একটি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয় ভারতের জাতীয় পতাকা সম্পর্কে। এরপর এল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। নব সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রতিটি ঘরে ঘরে উত্তোলিত হলো ভারতের জাতীয় পতাকা। গেরুয়া, সাদা এবং সবুজ এই তিনটি রঙের পাশাপাশি নীল রঙের অশোকচক্র স্থান পেল ভারতের জাতীয় পতাকায়।

স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ উপলক্ষে এবার ভারতজুড়ে পালিত হচ্ছে 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব।' এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে ২০২১ সালের ১২ মার্চ থেকে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ডাকে গৃহীত হয়েছে 'হর ঘর তিরঙ্গা'-র মতো কর্মসূচিও। কিন্তু জানেন কি এই পতাকা উত্তোলনের জন্যও রয়েছে বেশ কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুন। স্বাধীনতার দিনে আরও একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক সেগুলিতে।

১. ভারতের যে-কোনও নাগরিক এখন রাতের বেলাতেও পতাকা উত্তোলন করতে পারেন। এর আগে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্তই পতাকা উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হতো।

২. কোনও অবস্থাতেই উল্টোদিকে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা যাবে না। অর্থাৎ, পতাকা উত্তোলনের সময় গেরুয়া রং থাকবে ওপরে এবং সবুজ রং থাকবে একেবারে নিচে।

৩. সাধারণ নাগরিকরা তাদের যানবাহনে কোনওভাবেই পতাকা ব্যবহার করতে পারবেন না। এই সম্মান রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতির মতো সম্মানীয় ব্যক্তিদের জন্যই বরাদ্দ।

৪. কখনওই দেশের পতাকাকে অর্ধ-উত্তোলিত করে রাখা উচিত নয়।

৫. জাতীয় পতাকার অনুপাত হবে ৩:২।

৬. কখনও কোনও বাণিজ্যিক স্বার্থে দেশের জাতীয় পতাকাকে ব্যবহার করা উচিত নয়।

ভারতের জাতীয় পতাকা ভারতের সম্মান, সহিষ্ণুতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সুতরাং পতাকা উত্তোলনের নিয়মভঙ্গ হলে আখেরে কালিমালিপ্ত হয় আমাদের দেশ।

More Articles