ঘোড়ার দড়ি ছিঁড়ে জন্ম নিল 'একাকী ঢেউ'! বিজ্ঞানের সব বোঝাপড়া তোলপাড় যে আবিষ্কারে...

Soliton Technologies: বিংশ শতাব্দীর শেষে, ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে সলিটন ব্যবহার করেই ১ টিবি ডেটা পাঠানো হয়েছিল।

ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে জন স্কট রাসেল নামে একজন তরুণ প্রকৌশলী একটা খালে নৌকার এক নকশা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন। সংকীর্ণ খালের ভিতরে তিনি নৌকাটির সঙ্গে দু'টি ঘোড়াকে দড়ি দিয়ে বেঁধে দেন নৌকাটিকে চালানোর জন্য। এভাবে চলতে চলতে পথমধ্যে হঠাৎ দড়িটি ছিঁড়ে গিয়ে নৌকাটি থেমে গেল। সেই একইসঙ্গে একটা মজার ব্যাপারও ঘটল। রাসেল লক্ষ্য করলেন, নৌকার সামনের জলরাশি থেকে এক অদ্ভুত ধরনের ঢেউ তীব্র গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সচরাচর যেরকম ঢেউয়ের সঙ্গে আমরা পরিচিত, মানে পুকুরে ঢিল মারলে জল ওঠা নামা করে আর কী, এ ঠিক তেমন নয়। এখানে জলের কোনও ওঠা নামা নেই। কিছুটা জলরাশি উঁচু হয়ে যেন সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে প্রায় ১০ কিমি প্রতি ঘণ্টা বেগে! তরুণ রাসেল ঘোড়ায় চড়ে সেই মজার ঢেউয়ের পিছনে ছুটে আবিষ্কার করলেন এক বিস্ময়কর বিষয়, যা কিনা অধুনা অ-সরলরৈখিক বিজ্ঞান গবেষণার এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র- 'সলিটন'। এই নামকরণ কী করে হলো আমরা একটু পরে জানব, তার আগে বোঝার চেষ্টা করি এ ঠিক কেমন ঢেউ?

একটা ঢেউ বা তরঙ্গ যখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন ক্রমাগত তার বিস্তার (মানে গোদা বাংলায় তীব্রতা বলেও আমরা ভাবতে পারি) কমতে থাকে। এই যে ঢেউয়ের ছড়িয়ে পড়া, বিজ্ঞানে তার পোশাকি নাম 'বিচ্ছুরণ' বা 'ডিসপার্সন'। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘোড়ার দড়ি কেটে যাওয়ার ফলে জলরাশির যে ঢেউ রাসেল প্রত্যক্ষ করলেন, তাতে বিচ্ছুরণের চিহ্ন মাত্র নেই। এর শক্তি বা তীব্রতা কিছু তো কমলই না, বরং এগিয়ে চলল শুরুর তীব্রতা নিয়েই। অদ্ভুত!

আরও পড়ুন- সময়ের উল্টোদিকেও রয়েছে ‘পদার্থ’? যে খোঁজ বদলে দিতে পারে আমাদের সব বোঝাপড়া

বিস্মিত রাসেল ঘোড়ায় চড়ে খালের ধার বরাবর মাইল দুয়েক চললেন এই আশ্চর্যজনক ঢেউয়ের পিছনে। কোনও কূল-কিনারা না পেয়ে তরুণ ইঞ্জিনিয়ার বাড়ি ফিরে চেষ্টা করতে লাগলেন ওই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির। বিজ্ঞানের উদ্ভব ও প্রসার তো এমন করেই। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে, রবার্ট হুকের তিরিশটি বসন্ত পার হয়েছিল কালজয়ী স্থিতিস্থাপকতার এক-লাইনের সূত্র দিতে, যা এখনকার সমস্ত বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের হাইস্কুল পর্যায়ের পাঠ্য। যাই হোক, রাসেল বাড়ি ফিরে ৩০ ফুট লম্বা এক চৌবাচ্চা বানালেন। সেখানেই ফের দেখা পেলেন এই আজব ঢেউয়ের। এর নাম দিলেন একাকী ঢেউ' বা 'সলিটারি ওয়েভ'। বড়ই অদ্ভুত নাম? তাঁর এতদিনের পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল তিনি প্রকাশ করলেন ১৮৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্সের ১৪ তম বৈঠকে। তদানীন্তন গবেষকরা তাঁর এই কাজের বিশেষ আমল দিলেন না। বিজ্ঞানীমহলে এমন হামেশাই হয়। যদিও তদানীন্তন বিখ্যাত দুই গণিতজ্ঞ জর্জ এরি ও স্টোক্স এর তত্ত্বগত ব্যাখা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্ত সফল হননি। রাসেল কিন্তু 'একাকী ঢেউ' বা 'সলিটারি ওয়েভের' জন্য বিখ্যাত নন!

তারপর থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাকি সময়, এমনকী বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বিজ্ঞানমহলে এই 'একাকী ঢেউ' নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামায়নি। ষাটের দশকের দিকে গবেষকরা একটু উন্নত কম্পিউটারের সাহায্যে অ-সরলরৈখিক মাধ্যমে তরঙ্গের প্রবাহ নিয়ে কাজ করাকালীন আবার সেই 'একাকী তরঙ্গ' বা 'সলিটারি ওয়েভের' সন্ধান পান। এবং এর নাম দেন 'সলিটন'। শুধু তাই নয় তাঁরা দেখলেন, আমাদের আশেপাশে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এই 'সলিটন'। আলোকবিদ্যা, ফ্লুইড-ডাইনামিক্স, প্লাজমা-পদার্থবিজ্ঞান, শক ওয়েভ, টর্নেডো, সব জায়গায় এর বিস্তৃতি। বস্তু জগতের কণা থেকে প্রোটিনের সংবেদনশীলতা, সুনামির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এমনকী বৃহস্পতির লাল দাগ, এককথায় এমন কোনও অসরলরৈখিক প্রাকৃতিক ক্ষেত্র নেই যেখানে সলিটনের প্রসঙ্গ ব্যতিরেকে বৈজ্ঞানিক আলোচনা সেরে ফেলা যায়। আর মজার বিষয়, আমাদের চারপাশের জগতের স্বীয়ভাগ ঘটনাই অসরলরৈখিক বা নন লিনিয়ার। আধুনিক অ-সরলরৈখিক গতি-বিজ্ঞানের গবেষণার এক অন্যতম ক্ষেত্র এই 'সলিটন'।

সলিটনের গতিবিধি বোঝার জন্য আমাদের কিছু অ-সরলরৈখিক পার্শ্বিয় অবকল-সমীকরণ সমাধান করতে হয়, বিভিন্ন অনুসঙ্গিক শর্ত মাথায় রেখে। বিজ্ঞানে তার এক গালভরা নাম আছে, কেডিভি সমীকরণ, করতোগ ও দেবরিস নামক দুই গণিতজ্ঞর নামানুসারে। সেই কঠিন অঙ্কের মধ্যে আমরা এখন যাচ্ছি না। আমরা তরঙ্গ-বিজ্ঞানের স্বাভাবিক জ্ঞান থেকে বিষয়টা বরং বোঝার চেষ্টা করি। আমরা জানি আলো এক প্রকারের তরঙ্গ। সূর্যর আলোকে প্রিজমের ভিতর দিয়ে পাঠালে সাতটা বর্ণে ভেঙে যায়- বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল- যাকে আমরা সবাই বেনিআসহকলা নামে চিনি। বর্ষাকালে বৃষ্টির পর যদি রোদ ওঠে তাহলে আকাশে আমরা এরকম রঙের খেলা দেখতে পাই, যার পোশাকি নাম রংধনু বা রামধনু। আসলে কী হয়? বৃষ্টির পর পরই বায়ুমণ্ডলে জলকণা থাকে, যেখান থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে সাতটা বর্ণে ভেঙে বেরিয়ে আসে ঠিক প্রিজমের মতো।

এই যে 'বেনিআসহকলায়' সাতটি ভিন্ন ভিন্ন রং, এদের প্রত্যেকেরই একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, এদের প্রত্যেকের তরঙ্গদৈর্ঘ্যই আলাদা। মানে একটা পূর্ণ-কম্পন হতে যে সময় লাগে, সেই সময়ে লাল আলো ও সবুজ আলো ভিন্ন ভিন্ন দূরত্ব অতিক্রম করবে। সোজা কথায় আলাদা-আলাদা তরঙ্গদৈর্ঘ্য মানে আলাদা আলাদা আলো! আর কোনও মাধ্যমের ভিতর দিয়ে আলো কত তাড়াতাড়ি যাবে সেটা নির্ভর করে মাধ্যমের একটা বিশেষ ধর্মের উপর, যার পোশাকি নাম 'প্রতিসরাঙ্ক'। এই প্রতিসরাঙ্ক আবার নির্ভর করে তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের উপর, তাই একটা মাধ্যমের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় কোন আলো কতটা বাঁকবে সেটা নির্ভর করে তার তরঙ্গদৈর্ঘ্যর সাংখ্যমানের উপর। সেজন্যই রামধনু বাঁকা দেখায়। একই কারণে একটা স্বচ্ছ জল ভর্তি কাঁচের গ্লাসে পেন্সিল ডোবালে, পেন্সিলের যে অংশটা জলের ভিতরে আছে, সেটুকু বাঁকা লাগে। অন্য মাধ্যমের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময়, ঠিক কোন দিক থেকে আলো ফেললে কতটা বাঁকবে এই নিয়ম আবিষ্কার করেন জার্মান বিজ্ঞানী স্নেল। আমরা ছোটবেলায় আলোর অধ্যায়ে ত্রিকোণমিতি মেশানো স্নেলের সূত্র পড়েছি। কিন্তু কেন বেঁকে যায় আলো? আরও বেশ কয়েকবছর পর এক ফরাসি ভদ্রলোক ফের্মা, তার এক সোজা সুন্দর ব্যাখা দেন। যার পোশাকি নাম 'ফের্মার নীতি'। সে সম্পর্কে অবশয় পরে আলোচনা করা যাবে।

আমরা এখন বরং দেখি, আলোকে যদি একটা মাধ্যমের ভিতর দিয়ে সোজা সামনের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে কী হবে? মাধ্যম একই থাকলেও তার ভিতরে এক এক রঙের আলোর প্রতিসরাঙ্ক এক এক রকম হওয়ায় আমরা দেখতে পাব প্রতিটা আলোই এক এক রকম গতিতে এগোচ্ছে।শুরুতে সবগুলো রং একসঙ্গে থাকলেও পরে তারা পৃথক হতে শুরু করে। যে আলোর তরঙ্গের সংকেত প্রথমে কম চওড়া ছিল সেটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তরঙ্গর স্বভাবই এমন এবং সচরাচর সব তরঙ্গের ক্ষেত্রেই এমনটা দেখতে পাওয়া যায়। এই স্বভাবটা আবার একাকী ঢেউ বা সলিটনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দেখতে পাননি, এ যেন এক অচেনা ঢেউ!

আরও পড়ুন- “চরকায় সুতো কেটে দেশের উন্নতি হবে না!” গান্ধীর সমালোচনাই কাল হয়েছিল মেঘনাদ সাহার?

আমরা আগেই জেনেছি প্রতিসরাঙ্ক তরঙ্গদৈর্ঘ্যর উপর নির্ভর করে। আবার এটি ঢেউয়ের বিস্তারের উপরেও নির্ভর করে। যদিও তার প্রভাব এতদিনের চেনা ঢেউয়ের বেলায় তেমন চোখে পড়েনি। কিন্ত সলিটারি ওয়েভের ক্ষেত্রে এই ধর্মটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। বিজ্ঞানীরা চিন্তাভাবনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, ঢেউ যদি অতিমাত্রায় শক্তিশালী হয়, তবে সেটি প্রতিসরাঙ্ককেও পরিবর্তন করতে পারে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তরঙ্গদৈর্ঘ্য একদিকে প্রতিসরাঙ্কের পরিবর্তন করে, অন্যদিকে তরঙ্গের বিস্তার প্রতিসরণের পরিবর্তন করে এবং পুরো ব্যাপারটা এমনভাবে ঘটে যে একটা পরিবর্তন অন্য পরিবর্তনকে মিটিয়ে দেয়। যার ফলে আমাদের চোখে আদতে কোনও পরিবর্তনই ধরা পড়ে না। সেই কারণে যে ঢেউটা কিছুদুর এগোতেই ভেঙে ছড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেই তরঙ্গই অনির্দিষ্টকাল অবিকৃত বিস্তার নিয়ে চলতে থাকে। অত্যাধুনিক কম্পিউটারে বিজ্ঞানীরা সিমুলেশনের মাধ্যমে এই অবস্থার সাক্ষাৎ পেলেন, যেটার ধারণা করেছিলেন তরুণ ইঞ্জিনিয়ার রাসেল, এক শতাব্দীরও বেশি আগে।

রাসেলের অনুধাবনকে সেই সময়ের বিজ্ঞানী মহল তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিলেও এখন পরিস্থিতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। সলিটন নিয়ে নিত্যনতুন গবেষণাই শুধু নয়, অ-সরলরৈখিক গতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন দুর্বোধ্য ঘটনাকে গবেষকরা সলিটন দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সলিটন যদিও ঢেউয়ের মতো, তাও এর মাঝে কণার ধর্মও বিদ্যমান। একটা সলিটন অন্য একটা সলিটনের সঙ্গে ঠোকাঠুকি লাগাতে পারে, এমনকী একটা সলিটন আরেকটার ভেতর দিয়ে চলে যেতে পারে পুরোপুরি অবিকৃত রূপে! এর একটা বিশেষ ধর্ম হচ্ছে, সলিটনের বিস্তার যত বেশি তার গতিবেগও তত বেশি। তাই যদি দুটো সলিটন একদিকে যেতে থাকে তাহলে যেটার বিস্তার অপেক্ষাকৃত বেশি, সেটা দ্রুত অপরটাকে টপকে যেতে পারে। এমতাবস্থায় তাদের অবস্থান যদি একই হয়, তাহলে গঠনমূলক ব্যতিচারের হিসেব অনুযায়ী ঢেউয়ের তীব্রতা বেশি হওয়া উচিত, কিন্তু সলিটনের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। বরং সম্মিলিত ঢেউটি হয় কম তীব্রতা বা বিস্তার বিশিষ্ট। সাধারণত তরঙ্গবিজ্ঞানে বিস্তারের নিরিখেই তীব্রতা পরিমাপ করা হয়।

শুধু কম্পিউটারে সিমুলেশনই নয়, ফাইবার অপটিক্সে এর ব্যবহার ব্যাপক। ডিজিটাল সিগনালকে সলিটন হিসেবে অপটিকাল ফাইবার বা আলোক তন্তুর মধ্যে দিয়ে অনেক দূরে পাঠানো হয়। সত্তরের দশকে বেল ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীরা প্রথম সলিটনের এমন প্রয়োগ কল্পনা করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর শেষে, ১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে সলিটন ব্যবহার করেই ১ টিবি ডেটা পাঠানো হয়েছিল। তার কয়েক বছর পর থেকে ইউরোপে সলিটনের মাধ্যমে সত্যিকারের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। গত দু'দশক ধরে সলিটারি ওয়েভ তথা সলিটন নিয়ে এত গবেষণা হয়েছে যে, যেকোনও পাঁচজন অ-সরলরৈখিক বিজ্ঞানের গবেষকদের মধ্যে অন্তত দুই বা তিনজনকে খুঁজে পাবেন যাঁরা সলিটন নিয়ে কাজ করেন। এর থেকে বড় প্রাপ্তি রাসেলের আর কীই বা হতে পারে।
 

More Articles