মদ না খেয়েই মাতাল! জানেন কোন কঠিন অসুখ বাসা বাঁধছে আপনার শরীরে
Auto Brewery Syndrome: ধরুন শরীর যদি নিজেই অ্যালকোহল তৈরি করে আপনাকে মদের নেশায় ডুবিয়ে দিত, তাহলে কেমন হতো?
সুরাপ্রেমীদের দিকে এই প্রশ্নটা ছুড়ে দেওয়া যাক, যদি মদ্যপান না করেই মদের নেশা হতো বা ধরুন শরীর যদি নিজেই অ্যালকোহল তৈরি করে আপনাকে মদের নেশায় ডুবিয়ে দিত, তাহলে কেমন হতো?
বিষয়টা শুনে যেমনই লাগুক, মোটেই সুবিধের হবে না। যার প্রথম কারণ, মদ না খেয়েও আপনার রক্তে হু হু করে বাড়ত অ্যালকোহলের পরিমাণ। সেটা এতটাই বাড়ত যে, দেশের আইন-কানুন যে পরিমাণ অ্যালকোহল আপনার রক্তে বা নিঃশ্বাসে থাকলে আপনাকে দোষী সাব্যস্ত করবে না, তার তুলনায় অনেকটা বেশি-ই হতো। যেমনটা হয়েছিল নিউ ইয়র্কের এক মাঝবয়সি মহিলার সঙ্গে। পুলিশ যখন তাঁকে পাকড়াও করেছে, তখন সেই মহিলার রক্তে অ্যালকোহলের পরিমাণ আইন যা মান্যতা দেয়, তার থেকে চারগুণ বেশি। কিন্তু মহিলা দাবি করেন, তিনি মদ্যপান করেননি। পরে দেখা যায়, মহিলা সত্যি-ই মদ্যপান করেননি। তিনি অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমে ভুগছেন। সেই রোগ, যেখানে শরীর নিজে থেকেই অ্যালকোহল উৎপাদন করে।
শরীরে কার্বোহাইড্রেট বা চিনিজাতীয় খাবার হজমের ফলে সামান্য পরিমাণ অ্যালকোহল স্বাভাবিক অবস্থায় তৈরি হয়। কিন্তু যদি অ্যালকোহল উৎপাদনের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটা বেশি হয়, তখনই অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমের মতো শারীরিক সমস্যা দেখা যায়।
আরও পড়ুন: কেন ঘুমের জন্য ওষুধের দরকার পড়ল মানুষের? অবাক করবে স্লিপিং পিল আবিষ্কারের ইতিহাস
অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমে ভোগার সম্ভাবনা বেশি কাদের?
অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোম নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের ক্ষেত্রেই দেখা যেতে পারে। কারও জন্মের সময় দেখেই দেখা যেতে পারে, অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোম। তবে অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোম জিনগত কি না, তা জোর দিয়ে বলা চলে না। অন্তত এখনও পর্যন্ত এই নিয়ে যা গবেষণা হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে। তবে উল্লিখিত শারীরিক সমস্যা না থাকলেও অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোম দেখা গেলেও যেতে পারে। যে শারীরিক সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম হলো ডায়াবেটিস, লিভারের সিরোসিস-সহ লিভারের অন্যান্য সমস্যা এবং স্থূলতা। তবে টাইপ-টু ডায়াবেটিস এবং লিভার সিরোসিস-সহ অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমে ভোগেন যারা, তাঁদের ক্ষেত্রে রক্তে অ্যালকোহলের পরিমাণ ২২.৩ mg/dL-এর কাছাকাছি পৌঁছেছে। যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই বেশি।
এর পাশাপাশি ক্রনস ডিজিজ থাকলে অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোম দেখা যেতে পারে। যদিও ক্রনস ডিজিজ জিনগত রোগ, কিন্তু এক্ষেত্রে জিনকে অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমের নেপথ্যে সরাসরি দায়ী করা যায় না।
এছাড়া শর্ট বাওয়েল সিন্ড্রোমে ভোগে যে-সমস্ত শিশু, তাদের মধ্যেও বাড়ে অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমে ভোগার সম্ভাবনা। শর্ট বাওয়েল সিন্ড্রোমে ভোগা তিন বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে একবার ফলের রস পান করে। যার মধ্যে অত্যধিক পরিমাণে চিনি আগে থেকেই মেশানো ছিলো। ফলস্বরূপ, মেয়েটির শরীরে তৈরি হয় অ্যালকোহল। এবং ওই একরত্তি মেয়েই তখন নেশার ঘোরে চলে যায় কেবল তার শারীরিক অবস্থার কারণে।
শর্ট বাওয়েল সিন্ড্রোম বাদ দিলেও দায়ী করা যায় একাধিক শারীরিক অবস্থাকে। যাঁরা সিউডোঅবস্ট্রাকশন এবং স্মল ইন্টেস্টিনাল ব্যাক্টিরিয়াল ওভারগ্রোথের মতো শারিরীক সমস্যায় ভোগেন, তাঁদের মধ্যেও বাড়ে অটো ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমে ভোগার সম্ভাবনা।
তবে অপুষ্টি, অত্যধিক অ্যান্টিবায়োটিক সেবন, ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিজি়জ়, দূর্বল ইমিউন সিস্টেম থাকলেও দেখা যেতে পারে অটো ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোম। কারণ এই অবস্থাগুলির কোনও একটি থাকলেই শরীরে অ্যালকোহল উৎপাদনকারী ফানজাইয়ের (ছত্রাক) পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
শরীরে কী করে তৈরি হয় অ্যালকোহল?
অত্যধিক পরিমাণে চিনি বা শর্করা-জাতীয় খাবার খেলে অন্ত্রে থাকা বিভিন্ন ফানজাই এবং ব্যাকটেরিয়া সেই চিনি বা শর্করা-জাতীয় খাবারকে ফার্মেন্ট করে- যাকে বাংলায় বলে গেঁজিয়ে তোলা। আর এর অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে চিনি বা শর্করা-জাতীয় খাবার থেকে তৈরি হয় ইথানল। যা আদতে অ্যালকোহলেরই একটি রূপ। আর শরীরে উৎপাদন হওয়া সেই অ্যালকোহলই মদ্যপান না করেও কাউকে নেশাচ্ছন্ন করে তোলার জন্য দায়ী।
তবে যে কোনও নয়, নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়া বা ফানজাই (ছত্রাক) চিনি বা শর্করা-জাতীয় খাবারকে গেঁজিয়ে তোলার জন্য দায়ী। এদের মধ্যে কোনও একটির শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বেড়ে গেলে এবং তারা রোগসৃষ্টিকারী (Pathogenic) রূপ ধারণ করলে তখনই হয় বিপত্তি। তখনই তারা শরীরে ঢোকা শর্করা ও চিনি-সমৃদ্ধ খাবারকে আরও বেশি করে গেঁজিয়ে তোলার সুযোগ পায়।
এই ফানজাইগুলির মধ্যে অন্যতম স্যাকারোমাইসিস সেরেভিসি, স্যাকারোমাইসিস বোল্ডারডি, এবম ক্যান্ডিডা-র বিভিন্ন প্রজাতি, যার মধ্যে ক্যান্ডিডা গ্ল্যাব্রাটা, ক্যান্ডিডা অ্যালবিক্যান্স, ক্যান্ডিডা কেফির, ক্যান্ডিডা প্যারাসিলোসিস। এদের মধ্যে বেশ কিছু ফানজাই আবার আদতেই ব্রিউয়িং, অর্থাৎ মদ বানাতে ব্যবহার করা হয়।
অন্যদিকে চিনি বা শর্করা-জাতীয় খাবারকে গেঁজিয়ে তোলার জন্যে দায়ী ব্যাকটেরিয়াগুলির মধ্যে অন্যতম ক্লেবসিয়েল্লা নিউমোনিয়া, এন্টেরোকক্কাস ফেশিয়াম, সাইট্রোব্যাক্টার ফ্রেয়ান্ডাই প্রভৃতি।
অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমে ঠিক কী কী লক্ষণ দেখা যায়?
অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমে স্বভাবতই রক্তে অ্যালকোহলের পরিমাণ হু হু করে বাড়ে, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও বমি হওয়া, ক্রমাগত ক্লান্তিতে ভোগা (ক্রনিক ফ্যাটিগ সিন্ড্রোম), ঘুম ঘুম পাওয়া, নিজের আশেপাশের অধিকাংশ বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যের অভাব বোধ করা, ইরিটেবল বাওয়াল সিন্ড্রোমের (পেটের সমস্যা ও বারবার মলত্যাগের ইচ্ছে) মতো সমস্যা দেখা যায়।
তবে অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমে ভুগলে প্রাথমিকভাবে উপরোক্ত বাহ্যিক লক্ষণগুলি দেখা না-ও যেতে পারে। অনেকেই সেক্ষেত্রে মনে করেন, স্নায়বিক সমস্যায় ভুগছেন ব্যক্তিটি।
অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমের সমাধান কী?
পরিবারে অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমের ইতিহাস থাকলে সতর্ক হতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া টাইপ-টু ডায়াবেটিস, লিভার সিরোসিস বা লিভারের অন্য যে কোনও সমস্যা, ক্রনস ডিজিজ, শর্ট বাওয়েল সিন্ড্রোম থাকলে সাবধান হতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। কমাতে হবে চিনি বা শর্করা-সমৃদ্ধ খাবারের পরিমাণ। সেক্ষেত্রে মদও নৈব নৈব চ।
অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমের পরীক্ষার জন্যে সিবিসি, মেটাবলিক প্যানেল, রক্ত পরীক্ষা, ড্রাগ স্ক্রিনিং, মল পরীক্ষা করা যেতে পারে। মল পরীক্ষার ফলাফলই জানিয়ে দেবে পেটে অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোমের জন্য দায়ী ছত্রাক এবং ব্যাকটেরিয়া হু হু করে বাড়ছে কি না। একই বিষয় জানা যেতে পারে এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে। এর পাশাপাশি খাবারের সঙ্গে শরীরে ঢোকা গ্লুকোজ কত দ্রুত হারে অ্যালকোহলে পরিণত হচ্ছে, বলে দেবে BAC ও BrAC টেস্টিং।
অটো-ব্রিউয়ারি সিন্ড্রোম ধরা পড়লে অ্যাজোল বা পলিয়েনস ছাড়াও বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যেতে পারে। তবে তা ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়া না নেওয়াই ভালো। এর পাশাপাশি পেটে উপকারী ও রোগসৃষ্টিকারী ব্যকটেরিয়ার সাম্য ফেরাতে প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট এবং প্রোবায়োটিক-সমৃদ্ধ খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এই সমস্তকিছুর আগে যে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তা হলো খাবারে শর্করা ও চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা, জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।