মহুয়া মৈত্রের 'চরিত্র' নিয়েই চর্চা স্রেফ! কোথায় গেল আদানির দুর্নীতির প্রশ্নগুলি?
Mahua Moitra : যে এথিক্স কমিটি মহুয়া মৈত্রের সাংসদ পদ বাতিলের সুপারিশ করেছে তা স্পিকারের কাছে পৌঁছনোর আগে আদানি অধিগৃহীত এনডিটিভির কাছে কি করে চলে যায়?
‘এথিক্স’ শব্দটির বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়- নীতি। ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে নির্বাচিত সাংসদেরা কী আচরণ করবেন, কোন শব্দ বলতে পারবেন, কোন প্রশ্নে বিরোধীরা সরকারপক্ষকে বিঁধতে পারবেন, কোন শব্দ একজন সাংসদ তাঁর সহ সাংসদদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবেন, তাও বলা আছে সংসদীয় ওই নীতিতে। এই নীতি রক্ষার জন্য রয়েছে এথিক্স কমিটি। সাধারণত দেখা যায়, এই এথিক্স কমিটির যিনি প্রধান হন, তিনি শাসকদলের দ্বারাই নির্বাচিত হয়ে থাকেন। সুতরাং এই প্রধান যে সরকারপক্ষের সুবিধা অসুবিধা দেখবেন, তা বলাই বাহুল্য। সেই এথিক্স কমিটি পাঁচশো পাতার একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার কাছে। তাঁদের প্রস্তাবে আছে, লোকসভার তৃণমূলের সাংসদ মহুয়া মৈত্র টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন তুলেছেন আদানি
সম্পর্কে। কী সেই প্রশ্ন?
মহুয়া মৈত্র সহ বিরোধী বেশ কিছু সাংসদ আদানিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে বলে প্রশ্ন তুলছিলেন সংসদের বেশ কিছু অধিবেশনে। সেখানে সরাসরি
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দিকে আঙুল উঠছিল, যা বিজেপি সম্পর্কে মানুষের কাছে মোটেই ভালো বার্তা নিয়ে যাচ্ছিল না। যে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে বলে থাকেন তিনিই ভারতকে দুর্নীতিমুক্ত করবেন, যিনি প্রায় সমস্ত নির্বাচনী সভায় বলে থাকেন তিনিই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একমাত্র মুখ, তাঁর সম্পর্কে যদি এমন বার্তা যায় যে তাঁর এবং আদানির মধ্যে একটা অবৈধ লেনদেনের সম্পর্ক আছে, তাহলে তাঁর এবং তাঁর দলের পক্ষে তা হজম করা কঠিন বৈকি। যদি একটু খেয়াল করা যায়, যে যে সাংসদেরা আদানি নামটি সংসদে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করেছেন, তাঁদেরকেই বহিষ্কার করার চেষ্টা করেছে প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং তাঁর দল বিজেপি। কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী, আম আদমি পার্টির সঞ্জয় সিং কিংবা রাঘব চাড্ডা কেউই বাদ যাননি। সুতরাং মহুয়া মৈত্রকে তাঁরা ছেড়ে
দেবেন, সে আশা করাই অন্যায়।
বিজেপির উদ্দেশ্য খুব পরিষ্কার। আদানি সংক্রান্ত কোনও প্রশ্ন যেন কোনও সাংসদ না করেন। মহুয়া মৈত্র তো এমন অভিযোগও করেছেন যে আদানির
সংস্থার পক্ষ থেকে এক দু'জন বিজেপি সাংসদ মারফত তাঁর কাছে এই বার্তা দেওয়া হয়েছিল, আগামী নির্বাচন অবধি তিনি যেন চুপ করে থাকেন এই বিষয়ে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন- আদানির বিরুদ্ধে প্রশ্ন, মাশুল দিচ্ছেন মহুয়া?
এবার বিজেপি এবং তাদের কুখ্যাত আইটি সেলের তরফ থেকে কীভাবে মহুয়া মৈত্রকে চুপ করানোর চেষ্টা হয়েছে, সেই সাম্প্রতিক ইতিহাসও দেখে নেওয়া জরুরি। নরেন্দ্র মোদি যতই ভবিষ্যতে মহিলা সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিল পাশ করুন না কেন, তিনি এবং তাঁর দল যে একজন স্পষ্টভাষী মহিলার স্পষ্ট ভাষণ সহ্য করতে অপারগ, তা বারংবার প্রমাণ করেছেন। মহুয়া মৈত্র সংসদে দাঁড়িয়ে, জার্মানির গণহত্যার সঙ্গে ভারতের তুলনা করেছেন এবং তাঁর সেই বক্তব্য দেশের বহু মানুষ সমর্থন করছেন। সেই সময় দেখা গেল, আইটি সেল এবং বিজেপির পোষা মিডিয়ার একদল সঞ্চালক প্রশ্ন তোলা শুরু করলেন, তাঁর ওই বক্তব্য মার্কিন লেখক মার্টিন লংম্যানের বক্তব্য থেকে চুরি করা। ২০১৭ সালের লংম্যানের সেই লেখাটিতে যে সব কথা আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করা লেখা, মহুয়া নাকি সেখানে ট্রাম্পের বদলে মোদি বসিয়ে একই বক্তব্য রেখেছেন। পরে লংম্যান নিজেই টুইট করে জানিয়েছিলেন, তাঁর সেই বক্তব্য ভারতে কোনও এক সাংসদের কারণে বিখ্যাত হলেও মহুয়ার সেই বক্তব্যের সঙ্গে তাঁর লেখার মিল নেই। অর্থাৎ চুরি করার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
তারপরে মহুয়া বিজেপির সাংসদ নিশিকান্ত দুবের জাল ডিগ্রি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এবং বলেন কেন নিশিকান্তকে সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হবে না? বিজেপি এবং তাদের আইটি সেল তক্কে তক্কেই ছিল কখন এমন একটা অভিযোগে মহুয়া মৈত্রকে ফাঁসানো যায়, যার ভিত্তিতে মহুয়াকে শুধু সংসদ থেকে বহিষ্কার করাই নয়, তাঁর রাজনৈতিক জীবনও শেষ করে দেওয়া যায়। মহুয়া মৈত্রের প্রাক্তন বন্ধু এবং ভারতীয় ব্যবসায়ী দর্শন হিরানন্দানি সেই কাজে বিজেপিকে সহায়তা করলেন। বেশ কিছুদিন ধরে, মহুয়া মৈত্রের কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল সেই সংক্রান্ত বিষয় এবং আরও বেশ কিছু বিষয় নিয়ে, কিছু সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মহুয়া মৈত্রের চরিত্র নিয়ে কিছু খবর করা যায় কিনা, সেই চেষ্টাও করছিলেন তাঁর প্রাক্তন বন্ধু। সেখানে তেমন কিছু সুবিধা না করতে পেরে, তারপর তিনি বিজেপির সাংসদ নিশিকান্ত দুবের কাছে পৌঁছে যান এবং তাঁদের ব্যক্তিগত ছবি এবং আরও কিছু তথ্য দেন বলে খবরে প্রকাশ। সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবি পৌঁছে যায়, বিজেপির আইটি সেলের মাথাদের কাছে, যাঁরা খুব ভালো করে জানেন কীভাবে একজন বিরোধী, বিশেষ করে মহিলা সাংসদের চরিত্র হনন করতে হয়। মুহূর্তে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, মহুয়া মৈত্রের ব্যক্তিগত সিগার খাওয়া এবং মদ্যপানরত কিছু ছবি।
বিজেপি খুব ভালো করে জানে, আমাদের সমাজে কোন কোন বিষয় এখনও নিষিদ্ধ এবং অলঙ্ঘনীয়, কোন কোন বিষয় ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেনে নেয় না এবং কোন কথা বললে বিশেষ করে ভারতীয় পুরুষরা মেনে নিতে পারে না। পাশাপাশি আরও একটি অভিযোগ করা হয় বিজেপির নিশিকান্ত দুবের পক্ষ থেকে। বলা হয়, ব্যবসায়ী দর্শন হিরানন্দানি, যিনি দীর্ঘদিন রিয়েল এস্টেটের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তিনি অভিযোগ করেছেন যে মহুয়া মৈত্র তাঁর থেকে টাকা নিয়ে আদানি সংক্রান্ত প্রশ্ন তুলেছেন সংসদে। এই কথা প্রকাশ্যে আসার পরে, মহুয়া মৈত্র সরাসরি আপত্তি করেন। মহুয়া বলেন, যদি তিনি টাকা নিয়ে থাকেন এবং মহার্ঘ বস্তু উপহার হিসেবে নিয়ে থাকেন তাহলে তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করা হোক। প্রথমে দর্শন হিরানন্দানি বলেন, তিনি ব্যবসায়ী মানুষ এবং রাজনীতির সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ নেই, সুতরাং তাঁকে যেন এই সব বিষয়ে না জড়ানো হয়। তার কিছুদিন পরেই সামাজিক মাধ্যমে তাঁর একটি হলফনামা প্রকাশ্যে আসে। সেখানে বলা হয়েছে, তিনি নিজে মহুয়া মৈত্রকে বিভিন্ন দামী উপহার থেকে শুরু করে টাকা অবধি দিয়েছেন সংসদে আদানি বিষয়ে প্রশ্ন করার জন্য। এমনভাবে সামনে আনা হয়, যাতে আদানি সংক্রান্ত প্রশ্নের থেকেও বড় হয়ে সামনে আসে মহুয়া মৈত্রের টাকা নেওয়ার বিষয়টি।
আরও পড়ুন- আদানির বিরুদ্ধে প্রশ্ন, মাশুল দিচ্ছেন মহুয়া?
আরও একটি বিষয়, এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন। এই দর্শন হিরানন্দানির নাম বেশ কয়েক বছর আগে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। পানামা পেপারসের তালিকায় এসেছিল নাম। এছাড়াও অর্থনৈতিক আরও কিছু দুর্নীতি নিয়েও তাঁর এবং হিরানন্দানি সংস্থার নাম জড়িয়েছে যা বিজেপির অজানা নয়। সেগুলোকে সামনে রেখেই যে তাঁকে ব্যবহার করে মহুয়া মৈত্রকে ফাঁসানো হচ্ছে না, তার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? এগুলো যে সবই মূল প্রশ্ন থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়, তা যে কোনও সচেতন মানুষ বুঝতে পারলেও, সাধারণ মানুষ যে এই ক্রোনোলজি সহজে বুঝতে পারবে না, তা বিজেপি খুব ভালো করে জানে। আর জানে বলেই, আদানির সঙ্গে মোদির যোগসাজশে আদানির আরও বিত্তশালী হওয়া বা আদানির বন্দর থেকে তিন হাজার কেজি ড্রাগস ধরা পড়ার পরেও কোনও তদন্ত না হওয়ার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মহুয়া মৈত্রের ব্যক্তিগত ছবি এবং তাঁর টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়টি।
অবশ্যই যদি মহুয়া মৈত্র যদি কোনও অন্যায় করে থাকেন তার তদন্ত হোক, সেটা মহুয়া নিজেও বলেছেন। কিন্তু তার পাশাপাশি আদানির তেরো হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়েও তদন্ত হোক। তিনি আরও বলেছেন, সিবিআই বা ইডি যে কেউ এই ঘটনার তদন্ত করতেই পারে কিন্তু তারা কি একবারও আদানির সম্পত্তি এবং কীভাবে তিনি এত দ্রুত এত বিত্তশালী হয়েছেন, সেই তদন্ত করবে? যে নীতি নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন করছে এথিক্স কমিটি, সেই নীতিমালা কি তাঁরা নিজেরা মেনে চলে? তা যদি চলত, তাহলে রমেশ বিধুরি যখন সংসদে দাঁড়িয়ে তাঁরই এক সহ সাংসদ দানিশ আলিকে উদ্দেশ্য করে অসংসদীয় শব্দ ব্যবহার করেন, তাহলে তাঁর সাংসদ পদ খারিজ হয় না কেন? যে এথিক্স কমিটি মহুয়া মৈত্রের সাংসদ পদ বাতিলের সুপারিশ করেছে তা স্পিকারের কাছে পৌঁছনোর আগে আদানি অধিগৃহীত এনডিটিভির কাছে কি করে চলে যায়? এর মধ্যেও যদি আদানির সঙ্গে মোদির প্রচারযন্ত্রের কোনও যোগসাজশ না দেখতে পাওয়া যায়, তাহলে তা শুধু সাধারণ মানুষের চোখের সমস্যা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বিরোধীরাও অনেকাংশে দায়ী।
আরও পড়ুন- মহুয়ার পাশে না থেকে বিজেপিকেই সুবিধা করে দিচ্ছেন মমতা?
বিরোধীরা যদি সহজ করে, আদানির দুর্নীতি প্রচারে নিয়ে আসতে পারতেন তাহলেই তার থেকে তাঁরা নির্বাচনী লাভ ওঠাতে পারতেন। কিন্তু কংগ্রেস থেকে শুরু করে বহু বিরোধী দল নিজেরাই সহজ করে বিষয়টা বুঝতেও পারেননি এবং যাঁরা বুঝেছেন তাঁরাও সরল করে মানুষের কাছে নিয়ে যেতে পারেননি। এখানেই বিজেপি এবং তাঁদের প্রচারযন্ত্র বারেবারে মাত দিয়ে দিচ্ছে বিরোধীদের। সাধারণ মানুষ দুর্নীতি বোঝে, সেই দুর্নীতি প্রমাণিত হলে যে কোনও
রাজনীতিবিদকে তাঁরা পরাজিত করতে পারেন। এর বহু উদাহরণ ভারতবর্ষের রাজনীতিতে আছে। তাঁরা এও বুঝতে পারছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি বিরোধী কথার কোনও দাম নেই, কারণ যে কোনও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত বিরোধী নেতা যদি বিজেপিতে যোগ দেন তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগের তদন্ত স্থগিত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁরা এখনও বিশ্বাস করেন না যে, প্রধানমন্ত্রী নিজে দুর্নীতিগ্রস্ত। ঠিক আমাদের রাজ্যে তৃণমূলের একাংশকে বেশ কিছু মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করলেও, মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করেন না।
বিরোধীদের কাজ ছিল সহজ করে আদানি এবং মোদির দুর্নীতিকে সামনে নিয়ে এসে প্রচার করা। অথচ তাঁরা লড়াইটাকে সংসদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। কোনও প্রচারমাধ্যমও তাই সেই কথা সামনে আনেনি। মহুয়া মৈত্র নিজে এই লড়াইটা সংসদে এবং সামাজিক মাধ্যমে করলেও, তিনি কিংবা তাঁর দল বিষয়টা নিয়ে মানুষের মাঝে যেতে পারেনি। তাই আজ মহুয়া মৈত্র এবং তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্রহনন মূল ইস্যু হয়ে যাচ্ছে, অথচ তাঁর সংসদে দাঁড়িয়ে প্রতিস্পর্ধী ভূমিকা গৌণ হয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের আগে দুর্নীতি বিরোধী এক সামাজিক আন্দোলন সামনে এসেছিল, সেই আন্দোলনের দৌলতেই নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আজ কিন্তু বিরোধীরা তেমন কিছু দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনকে সামাজিক আন্দোলনের চেহারা দিতে পারেননি, তাই মহুয়া
মৈত্রের চরিত্র নিয়ে কথা মুখ্য হয়ে গেছে, কিন্তু তাঁর তোলা আদানি সংক্রান্ত প্রশ্ন গৌণ হয়ে গেছে।