মহুয়ার পাশে না থেকে বিজেপিকেই সুবিধা করে দিচ্ছেন মমতা?

Mahua Moitra Adani Scam : বিজেপি বরাবরই রাজনৈতিক লড়াইকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করতে চেয়েছে। তাতে সবচেয়ে বেশি লাভ নরেন্দ্র মোদির।

কুণাল ঘোষ গ্রেফতার হলে, তার নিজের কর্মফল। মদন মিত্র নিজেরটা নিজে বুঝে নেবেন। তাপস পাল তো 'টলি ইন্ড্রাস্ট্রির' লোক। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রেফতার হলে মিছিল হবে। মুকুল রায় গ্রেফতার হতে হতে হলেন না কারণ তিনি নিজেরটা 'বুঝে' নিয়েছিলেন। নেত্রী মাথার উপর থেকে হাত তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ কর্তা রাজীব কুমারের বাড়িতে সিবিআই হানার চেষ্টা হলে ধর্নায় বসবেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার হলে দল হাত গুটিয়ে নেবে। ফোন ধরবেন না মুখ্যমন্ত্রী। আবার মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের গ্রেফতারির আগেই সাংবাদিক সম্মেলন করে এফআইআর করার হুমকি দেবেন সেই মুখ্যমন্ত্রীই। আর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথার উপর তৃণমূলনেত্রীর হাতই রয়েছে সবসময়।

সুতরাং মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে সংসদে প্রশ্ন করার অভিযোগ নিয়ে তৃণমূলের 'ধরি মাছ না ছুঁই পানি' জাতীয় প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। আদানির বিরুদ্ধে সংসদের মধ্যে গলা চড়িয়ে বিপাকে পড়বেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। চুপ করে থাকবেন তৃণমূল নেত্রী। দলের নেতারা গুটিগুটি পায়ে সংবাদমাধ্যমে এসে 'এটা ঠিক হয়নি' গোছের মন্তব্য করেই আবার আড়ালে চলে যাবেন। রাজ্যের মুখপাত্র বলে দেবেন, "দলের কোনও বক্তব্য নেই।" সর্বভারতীয় মুখপাত্র কোনও ক্যামেরার সামনে না এসে সংবাদসংস্থাকে ফোনে জানাবেন, যা করার মহুয়াই করবেন। আগে তদন্ত তার পরে দলের মন্তব্য।

এটাই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন- আদানির বিরুদ্ধে প্রশ্ন, মাশুল দিচ্ছেন মহুয়া?

এখন মহুয়া মৈত্র এক শিল্পপতির থেকে টাকা নিয়ে অন্য শিল্পপতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন করেছিলেন কিনা, তা তদন্ত সাপেক্ষ। কিন্তু এই অভিযোগকে লোকসভার নীতি-কমিটির এবং সংবাদমাধ্যমের সামনে এনে বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে যে কাজটি করেছেন তা হলো, একটি অবিশ্বাসের আবহাওয়া তৈরি করেছেন মহুয়াকে নিয়ে।

মহুয়া টাকা নিয়ে থাকলেও বা না থাকলেও সর্বসমক্ষে একটা সন্দেহ তৈরি করে দেওয়া গেছে। আদানি ও মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে প্রশ্নগুলি কোনও বিশেষ উদ্দেশে মহুয়া করেননি তো — এই প্রশ্ন জনমানসে তুলে দেওয়া গেছে। তৃণমূল জোর গলায় মহুয়ার পাশে না দাঁড়িয়ে এই অবিশ্বাসের প্রশ্নটিতে সিলমোহর লাগিয়েছে। তৃণমূল নেত্রীর নীরবতা প্রমাণ করছে আদানির সঙ্গে মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগের প্রেক্ষিতে মহুয়ার পাশে দল নেই।

দুর্নীতি প্রমাণ হোক বা না হোক, কিন্তু বিরোধী দলের নেতারা যে দুর্নীতিগ্রস্ত তা দিকে দিকে তুলে ধরতে চাইছে বিজেপি। তাই দুর্গাপুজোর উদ্বোধনে এসেও দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলেছেন বিজেপি নেতা ও দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কর্ণাটক হোক বা ছত্তিশগড় - কংগ্রেস নেতাদের বিরুদ্ধেও সেই দুর্নীতির অভিযোগ। দিল্লি হোক বা পশ্চিমবঙ্গ - আপ হোক বা তৃণমূল, অভিযোগ সেই একই।

এই অভিযোগ থেকে বাঁচতে যদি তৃণমূল সব নেতা-নেত্রীর ক্ষেত্রেই এক অবস্থান নিত তাহলেও না হয় বোঝা যেত যে তৃণমূল নেত্রী দুর্নীতিকে রেয়াত করেন না। কিন্তু কারও কারও পাশে দাঁড়িয়ে বা না দাঁড়িয়ে, কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বা না নিয়ে তৃণমূল নেত্রী দুর্নীতির অভিযোগের নাগপাশে জড়িয়ে গেছেন।

একদিকে যেমন কোনও কোনও তৃণমূল নেতার দুর্নীতি লোকের সামনে এতটাই উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে বা অনেকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতি নিয়ে এতটাই নিশ্চিত হয়ে যাচ্ছেন যে তৃণমূলের পক্ষে দুর্নীতির অভিযোগ সামাল দেওয়াই কঠিন। বিজেপির প্রতিহিংসা বা কেন্দ্র সরকারের তদন্তকারী সংস্থার মাধ্যমে বিরোধীদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত — এ সব বলেই যতটুকু যা করার করতে হচ্ছে। কিন্তু মহুয়ার বিষয়টি শিক্ষা বা রেশন দুর্নীতির থেকে একটু অন্যরকরমের।

মহুয়া মৈত্র যা করতে নেমেছেন — মোদি সরকারের ফ্য়াসিবাদী চরিত্র তুলে ধরতে চাইছেন বা কোনও বিশেষ শিল্প গোষ্ঠীর বিশেষ সরকারি সুবিধা নিয়ে সরব হতে চাইছেন — তাতে তাঁকে নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও যথেষ্ট সংযত থাকতে হতো। শিল্পপতি বন্ধু বলে তাঁকে দিয়ে নিজের সংসদের লগইন ব্যবহার করে প্রশ্ন লিখতে বলা ও নিজের টিমের সদস্যদের লগইন আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে প্রশ্ন লিখতে বলার মধ্যে তফাৎ অনেক। শিল্পপতি বন্ধু বলে তাঁর থেকে দামি উপহার নেওয়া কোনও অপরাধ না হলেও, তিনি যখন এই লড়াইতে রয়েছেন, তখন তাঁর বিরোধীরা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও যে কাটাছেঁড়া করবেন, ফাঁক খুঁজবেন তা মহুয়ার নিশ্চয়ই অজানা ছিল না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়া অবশ্যই মহুয়ার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এই লড়াইতে যে সেই বন্ধুকেই মহুয়া-বিরোধীরা ব্যবহার করতে পারে, তা নিয়েও সচেতন থাকা জরুরি ছিল তৃণমূল সাংসদের।

আরও পড়ুন- আদানির বিরুদ্ধে প্রশ্ন, মাশুল দিচ্ছেন মহুয়া?

এখন ঔদ্ধত্যের সঙ্গে সংসদের নীতি-কমিটির বৈঠক থেকে বেরিয়ে এলেও, যে অবিশ্বাসের দাগ মহুয়ার গায়ে লেগে গেছে, তা তুলতে মহুয়াকে বেগ পেতে হবে। প্রয়াত সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্তকেও টুজি ও কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে সংসদে ও সংসদের বাইরে লড়তে দেখেছি। দিস্তা দিস্তা নথি নিয়ে পড়াশোনা করতে দেখেছি। তিনিও নিশ্চয়ই তাঁর কোনও সূত্র মারফত সেই সব তথ্য সংগ্রহ করতেন। সেই আভাসও বার বার পেয়েছি। কিন্তু চেতলার ছোট্ট ফ্ল্যাট ও একটি ছোট চার চাকার গাড়ির মালিক গুরুদাস দাশগুপ্ত সাদামাটা জামার উপরের দু'টি বোতাম খোলা রেখেই সারাজীবন সংসদ বা সংবাদমাধ্যমে ইউপিএ সরকারের দুর্নীতি নিয়ে গলা চড়িয়ে কথা বলে গেছেন। নিজের গায়ে দুর্নীতির কালি লাগতে দেননি কখনও। তার অন্যতম মূল কারণ তাঁর সাধারণ জীবনযাপন।

মহুয়াও কৃষ্ণনগরের মাটিতে দাঁড়িয়ে কাজ করেন ঠিকই, কিন্তু কয়েনের উল্টো দিকের জীবনযাপনেই তিনি বিরোধীদের অভিযোগের শিকার হয়ে গেছেন। অন্যদিকে তাঁর দল পশ্চিমবঙ্গে আদানির বিনিয়োগের কথা চিন্তা করেই হোক বা অন্য কোনও কারণে, মহুয়াকে একা ফেলে দিয়েছে। তারা এই ইস্যু নিয়ে কোনও দিনই বিশেষ সরব হয়নি। আজও হচ্ছে না। এ লড়াই যেন মহুয়ার ব্যক্তিগত লড়াই।

আসলে বিজেপি বরাবরই রাজনৈতিক লড়াইকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করতে চেয়েছে। তাতে সবচেয়ে বেশি লাভ নরেন্দ্র মোদির। ফ্যাসিবাদ বা পুঁজিপতিদের সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতা বা সার্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুত্বের রাজনীতি ইস্যুগুলির বিরুদ্ধে বিরোধীদের লড়াই ফিকে হয়ে যায় এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক লড়াই হলে। তাই বার বার রাহুল গান্ধী হোক বা মহুয়া মৈত্র বা অরবিন্দ কেজরিওয়াল — এই ব্যক্তিরাই বড় হয়ে ওঠেন ইস্যুর থেকে।

তৃণমূল এই ধরনের ব্যাপারে নীরব থেকে সেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক লড়াইকেই উৎসাহিত করে। বিজেপি এটাই চায়। মহুয়া ব্যক্তিগতভাবে এবং তৃণমূল দলগতভাবে সেই ফাঁদেই পা দিল আরও একবার।

 

More Articles