ছবি জালের শাস্তি হয় না এ দেশে

Art forgery: রবীন্দ্রনাথের ছবি জাল হয়েছে। বহু বড় বড় শিল্পীদের নাম জড়িয়েছে এতে। যামিনী রায় থেকে শুরু করে অতিসম্প্রতি নন্দলালের ছবি জাল! কারও কোনও শাস্তি হয়নি।

সই জাল থেকে ওষুধ জাল। সমস্ত জালিয়াতিরই শাস্তি আছে। নেই শুধু ছবি জালের। ভারতের আইন ব্যবস্থায় চিত্রকলা জাল করা কোনও অপরাধ হিসেবে গণ্য হয় না। আসলে ছবি নকল করার শিক্ষা আমাদের শিল্প-শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা স্বীকৃত পদ্ধতি। আর তা করার একটা বিশেষ উদ্দেশ্যও রয়েছে। আসলে বিভিন্ন ধারার, ঘরানার বা বিভিন্ন আঙ্গিকের সঙ্গে পরিচয় করাতে সাহায্য করে এই শিক্ষা।

কিন্তু সেই বিষয়টারই অপব্যবহার হতে লাগলো পরবর্তীতে, বাড়তে লাগল ছবি জাল করার প্রবণতা। এ কাজে মুনাফা অনেক বেশি। আর এসব ক্ষেত্রে এই কাজের জন্য একটা প্রতিষ্ঠিত আড়াল হচ্ছে রেস্টোরেশন। অর্থাৎ, পুরনো ছবিকে পুনরুদ্ধার। এই অজুহাতে অজস্র দোকান খুলে বসে বহু অসৎ ব্যক্তি। মধ্য থেকে শুরু করে দক্ষিণ ও উত্তর কলকাতায় নানা গোপন ডেরা আছে। তাদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন নকল ছবি দেখিয়ে আমার মতামত জানতে চায়। আমি শুধু বলি, এ ছবিগুলি জাল। তারা স্বাভাবিক ভাবে জানতে চায়, কী দেখে এত নিশ্চিত ভাবে এই মন্তব্য করতে পারছি? আমি সতর্ক হয়ে যাই! জিজ্ঞেস করি, সেই কথা জানার জন্যই কি আমাকে এই গোপন আস্তানায় আনা!

আরও পড়ুন: দিনের আলোয় শিল্প ‘চুরি’! যেসব প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে দেবজ্যোতি মিশ্রের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ

যাই হোক, সম্প্রতি একটি সংগঠনের তরফে প্রস্তাব এসেছিল আমার কাছে। যেখানে বহু শিল্পী, কলা-সমালোচক প্রমুখরা একত্রিত হন, এই জাল ছবির রমরমার বিরুদ্ধে কিছু একটা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। আমি সেই প্রস্তাব অবশ্য এক কথায় নাকচ করি। প্রথমত যারা এই কাজে লিপ্ত, তাদের বেশিরভাগের মাথার উপর রাজনৈতিক ছত্রছায়া রয়েছে। পাশে রয়েছেন বহু প্রভাবশালীও। এমনকী সেই জমায়েতেরও অনেকেই আড়ালে, মুখোশ পরে এই কাজে প্রত্যক্ষ মদত দিয়ে থাকে। আর সেই কারণেই এই দলে আমি নাম লেখাতে চাই না। কার্যত আমি এখানে সম্পূর্ণ অসহায়। যারা এই কাজ করে আসছে বহু বছর ধরে, তাদের হাত অনেক লম্বা। এর পিছনে খাটে বহু কোটি কোটি টাকা। বহু কোটি টাকা লগ্নি হয় এ সব কাজে। বলাই বাহুল্য, তারা সকলেই রাঘব বোয়াল। এদের সঙ্গে লড়াই করে যুঝে ওঠা কঠিন, এবং একপ্রকার অসম্ভব বললেও ভুল হয় না। সব কিছুর পরেও এরা বহাল তবিয়তেই ঘুরে বেড়াবে।

রবীন্দ্রনাথের ছবি জাল হয়েছে। বহু বড় বড় শিল্পীদের নাম জড়িয়েছে এতে। যামিনী রায় থেকে শুরু করে অতিসম্প্রতি নন্দলালের ছবি জাল! কারও কোনও শাস্তি হয়নি। পুলিশ বা সরকার এইসব জাতীয় শিল্পীদের ছবি জাল করার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। জাল ছবির রাজধানী বলা হয় কলকাতাকে। এখানকার শিল্পীদের দক্ষতা এ ব্যাপারে কিঞ্চিত বেশি বলে সুনাম রয়েছে। ফলে তাঁদের চাহিদাও বেশি। এর থেকে বেরনোর যে উপায় নেই, তা কিন্তু নয়। বরং সেই রাস্তায় হাঁটার কথা সচেতন ভাবেই কখনও ভাবা হয়নি। এবং সম্ভবত হবেও না। কারণ যাঁরা এর বিরুদ্ধে মুখ বুজে থাকে, প্রতিবাদ করার পথে হাঁটে না, তাঁদের নিজ নিজ স্বার্থ রয়েছে। অর্থাৎ মুখ বন্ধ করার জন্য লেনদেন চলে মোটা অর্থের। তবে উপায়? এই পরিস্থিতি রোখার একমাত্র রাস্তা, সই জালের মামলা। ভারতীয় দন্ডবিধি অনুযায়ী কিন্তু সই জাল করা একটা বড় অপরাধ, যাকে বলে ক্রিমিনাল অফেন্স। অথচ তেমন মামলা কখনও দায়ের হয় না। এমনকী ছবি জাল প্রমাণিত হবার পরেও কারও শাস্তি হয় না। সবাই বেকসুর খালাস হয়ে যায়। কারা কারা এই কাজে লিপ্ত তার তালিকা আছে, কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তা-ই কিছু বলারও জায়গা নেই। আর সেই ফাঁক দিয়েই জাল ছবির কারবার দিন দিন বাড়ছে, এবং ভবিষ্যতে হয়তো আরও বাড়বে।

এ ধরনের কাজ কলকাতাতেই শুধু হয়, তা কিন্তু নয়। বিদেশে এই কাজ খুবই দক্ষতার সঙ্গে করা হয়। তাদের ইতিহাস-ভূগোলের জ্ঞান অত্যন্ত টনটনে। তারা আঙ্গিক নিয়ে গবেষণা করে। যাঁর কাজ নকল করা হবে, তাকে নিয়ে রীতিমতো গবেষণা করা হয়। তারপর কাজে হাত দেয়। কিন্তু এখানে সেসবের বালাই নেই। কারণ কলকাতার জাল আঁকার কারবারিরা জানে, যাঁরা ক্রেতা তারা বেশিরভাগই গন্ড মূর্খ। আসল-নকল বোঝার মতো জ্ঞান বা ক্ষমতা তাঁদের নেই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এ বিষয়টি আমি। একসময় আমার কাছে পরীক্ষার জন্য এমন বেশ কয়েকটি কাজ এসেছিল। বলাই বাহুল্য, খুবই নিম্ন মানের নকল ছিল সেগুলি।

সেই সব চিত্রকর্মগুলির আসল শিল্পী হলেন— যোগেন চৌধুরী, সুহাস রায় ও গনেশ পাইন। এক অবাঙালি তরুণী কাজগুলি আনার আগে আমাকে বেশ কয়েকবার ফোন করেন। আমি বেশ অবাকই হই, কারণ আমি তো আর স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ নই। ফলে এ ব্যাপারে আমার কোনও এক্তিয়ারও নেই। কিন্তু সেই তরুণী আমাকে জানান, তিনি বহু জায়গা থেকে তথ্য নিয়েছেন আমার সমন্ধে এবং তার পরেই তাঁর ধারণা হয়েছে এ ব্যাপারে আমি যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য। ফলে আমি যদি বলি জাল, তা হলে তা নিশ্চিত ভাবেই জাল। আমার কাছে তেমন কোনও পরীক্ষাগার নেই, আছে শুধু অভিজ্ঞতা। এত বছর এত কাজ এবং মূল কাজ দেখেছি, সেটুকুই সম্বল। তাছাড়া আমি কোনও মাফিয়া বৃত্তে জড়িত নই, এটা প্রতিষ্ঠিত। ওই তরুণী ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, কার্যত কাজ দেখার আগেই তাঁকে বলি, এ সমস্ত কাজই জাল। তিনি তো অবাক। তখনও কাজগুলি তাঁর ব্যাগে। জিজ্ঞেস করলেন কেন এবং কীভাবে বলছি। আমি যোগ করলাম, যে সমস্ত শিল্পীদের কাজের কথা হচ্ছে, তাঁদের বাজার মূল্য কিছুটা জানি। লক্ষ লক্ষ টাকার ওই ছবি কেউ সাধারণ খবরের কাগজে মুড়ে ঘুরে বেড়ায় না। এটুকু সম্মান তাঁরা দাবি করেন। ছবি খুলতে দেখা গেল খুবই নিম্নমানের নকল সেগুলি। তার বিবরণ বেশ দীর্ঘ।

আরও পড়ুন: এঁকেছিলেন সংবিধানেরও ছবি! সহজ পাঠের আড়ালে অজানা নন্দলাল বসু…

খুবই সাধারণ কাগজে নকল করা। রঙের মানও খুব খারাপ। শিল্পীর দক্ষতাও যে একেবারে নিচের তলার বলাই বাহুল্য। আমার কাছে ঘটনাচক্রে যথেষ্ট প্রমাণ ছিল ওই ছবিগুলিকে জাল বলার জন্য। মহিলা এর পর কাঁদতে শুরু করেন। বারবার তাঁর কাছে ফোন আসে, ফলাফল জানতে চাওয়া হয় ওপার থেকে। আমি পরে জেনেছিলাম, এসব ক্ষেত্রে আগাম কিছু টাকা নেওয়ার রেওয়াজ আছে। ধরা যাক, কোনও কাজের দাম এক লক্ষ টাকা,সেক্ষেত্রে দশ হাজার জমা দিতে হবে। সেদিন অন্তত পঞ্চাশ হাজার রোজগার হতে পারত। কিন্তু আমি কোনো টাকাই নিইনি। আমার বেশ মায়া লাগছিল তরুণীর জন্য। জানালেন, এক মাসি কাজগুলো তাঁকে বিক্রি করেছেন। বেশ ভালো মূল্যে। যেমন ভাবে এসেছিলেন, তেমন ভাবেই ফিরে যান তরুণী। ব্যাগে সাধারণ খবরের কাগজে মুড়ে সেভাবেই ফিরে যায় একগুচ্ছ জাল ছবি। অন্য কোথাও গিয়ে পসার জমিয়ে বসে। চলতে থাকে নকল ছবির কারবার।

More Articles