‘চারশো পেলেই পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের!’ ভোটবাজারে পদ্ম-নেতাদের মুখে কেন বারবার 'কাশ্মীর'-জিগির?
Lok Sabha Elections 2024: দু'দিন আগেই ভোটে জিতে পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখলের কথা শোনা গিয়েছে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের গলায়। এবার সেই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার গলায়।
ভোটের বাজার বলে কথা। আর সেই ভোট বাজারের আসল কথাই হল প্রচার। সেই প্রচারের ময়দানে ছেড়ে কথা বলছেন না কেউই। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের গোড়ায় একের পর এক জনসভা থেকে সংখ্যালঘুকে আক্রমণ করে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। আর সেই মোদিই ভোটের চার দফা পেরিয়ে মুসলমানদের সঙ্গে বন্ধুত্বের গল্প সাজিয়ে বসেছেন জনসভার মাঝে। সাধে কি বলে ভোট বড়ো বালাই! দুদিন আগেই ভোটে জিতে পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখলের কথা শোনা গিয়েছে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের গলায়। এবার সেই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার গলায়। ঝাড়খণ্ডের রামগড়ে বিজেপির সভায় তিনি জানিয়ে দিলেন, লোকসভা ভোটে বিজেপি চারশো আসনে জিতলেই পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখল করে ভারতে যুক্ত করা হবে।
লোকসভা ভোট শুরুর আগে থেকেই চারশো আসন পাওয়ার দাবি করে আসছে বিজেপি। তবে ভোট যত এগিয়েছে সেই সুর যেন একটু ক্ষীণ হয়েছে। এই ক'দিনে মোদি-শাহ-সহ একাধিক বিজেপি নেতা প্রাণপন চেষ্টা করে গিয়েছেন, যে কোনও ভাবে যাতে হিন্দু ভোট যাতে বিজেপির ঝুলিতে আসে। ভোটের আগেই সিএএ আইন কার্যকর করার মতো পদক্ষেপে খুশি হয়নি দেশের বহু অংশের মানুষই। এই পরিস্থিতিতে হিন্দু ভোটই যে বিজেপির প্রধান জোরের জায়গা, তা ভালোই মালুম করতে পেরেছিল দলের শীর্ষনেতৃত্ব। গোড়া থেকেই সেই হিন্দু ভোটের কথা মাথায় রেখেই গত কয়েকবছর ধরে একাধিক কর্মসূচী পালন করে এসেছে গেরুয়া শিবির। তার মধ্যে যেমন রামমন্দির প্রতিষ্ঠা ছিল, তেমনই ছিল জ্ঞানবাপী মসজিদে শিবলিঙ্গ খোঁজা বা তাজমহলের ভিতর থেকে 'তেজো মহালয়া' প্রসঙ্গ খুঁচিয়ে তোলার কাজ।
আরও পড়ুন: ‘মুসলিম বন্ধুদের মধ্যেই বড় হয়েছি!’ মনোনয়ন জমা দিয়েই কেন পাল্টি মোদির?
দিন কয়েক আগে এই হিমন্ত বিশ্বশর্মাই বলেছেন, ভোটে জিতলে মথুরায় কৃষ্ণ জন্মভূমিতে তৈরি হবে মন্দির। জ্ঞানবাপী গুঁড়িয়ে দিয়ে গড়ে উঠবে বাবা বিশ্বনাথের মন্দির। পর্যাপ্ত আসন দিলেই যে মোঘলদের সমস্ত কীর্তি গুঁড়িয়ে দেবে বিজেপি, সেই আশ্বাস ভালোমতোই দিয়ে রেখেছেন হিমন্ত। তাঁর যুক্তি, ৩০০ আসন পেয়ে অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি হয়েছে, ৪০০ আসন পেলে বাকি মন্দির তৈরি করা নিশ্চিত বলেই মনে করেছেন হিমন্ত। তবে শুধু মন্দিরের টোপ দিয়ে চিঁড়ে ভিজবে না বুঝেই কি এবার পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্গত করার আশ্বাস খুঁড়োর কলে ঝোলাচ্ছেন হিমন্তরা, উঠেছে প্রশ্ন। এতদিন বিজেপির পাখির চোখ ছিল হিন্দু ভোট। যাতে একটিও হিন্দু ভোট ফাঁক গলে অন্য পকেটে না ঢুকে পড়তে পারে, তার জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি পদ্মশিবির। ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্রমাগত কোণঠাসা করে গিয়েছেন দেশের বিশেষ ধর্মের বিশেষ শ্রেণির মানুষদের। কংগ্রেসকে তোপ দাগার অছিলায় কখনও সংখ্যালঘুদের বলেছেন 'ঘুসপেটিয়া', তো কখনও তাঁদের সন্তান সংখ্যা নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করেছেন। ছেড়ে কথা বলেননি অমিত শাহও। অনুপ্রবেশকারী প্রসঙ্গে যখন-তখন মুসলিমদের কাঠগড়ায় তুলেছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তবে ভোটের চার দফা পেরিয়ে এসে শুধু যে হিন্দু ভোটে তরী তীরে পৌঁছবে না, তা কি ভালো মতোই বুঝতে পেরেছে গেরুয়া শিবির? সেই জন্যই মোদির মুখে শোনা গিয়েছে মুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা। কীভাবে গোধরা কাণ্ডের পর থেকে তাঁকে ইচ্ছা করে মুসলিমবিদ্বেষী বানানো হয়েছে, তা নিয়ে তেলঙ্গানার সভায় গিয়ে নানা কথা বলতে শোনা গিয়েছে মোদিকে। বেশি সন্তান বোঝাতে যে তিনি মুসলিমদের আদৌ বোঝাননি, তা বোঝাতে একগুচ্ছ বাক্যখরচ করেছেন মোদি। হবে না-ই বা কেন? তাঁর নিজের কেন্দ্র বারাণসীতেই তো ১৪ শতাংশ মুসলিম ভোট। সেই ভোটবাক্সে হাত গলাতে না পারলে চারশো আসন পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হওয়া যে কঠিন, তা কি ভালোমতোই বুঝতে পেরেছে বিজেপি? তাই মন্দির গড়া থেকে একনিমেষে পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখলের দাবিতে লাফ দিয়েছেন হিমন্তের মতো নেতারাও।
চতুর্থ দফার ভোটে জম্মু-কাশ্মীরের শ্রীনগর কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ ছিল। অপ্রত্যাশিত ভাবেই বত্রিশ বছর পর শান্তিপূর্ণ ও অবাধ ভোট দেখেছে কাশ্মীর। এমনকী কোনও চরমপন্থী সংগঠন ভোট বয়কটের ডাকও দেয়নি। যা জম্মু-কাশ্মীরের ভোটের ইতিহাসে কার্যত রেকর্ড। ২০১৯ সালে কাশ্মীর থেকে তুলে নেওয়া হয় তাদের বিশেষ মর্যাদা। রদ হয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ, যার বলে জম্মুকাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা খর্ব করা হয়। তার পরে পরে কাশ্মীর অশান্ত হয়ে পড়লেও ক্রমে শান্তি ফিরেছে উপত্যকায়। দীর্ঘদিন ধরেই বিজেপি দাবি করে এসেছে, কাশ্মীরে শান্তি ফিরেছে। বিজেপির কৌশল যে সফল হয়েছে, তার প্রমাণ চলতি লোকসভার ভোট। এতদিনের রেকর্ড ভেঙে প্রথম দফার জম্মু-কাশ্মীর ভোটে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। রেকর্ড সংখ্যক ভোট পড়েছে এবার শ্রীনগরে। যা বিজেপিকে অতিরিক্ত কিছুটা প্রত্যয় জুগিয়েছেই।
এদিকে, ঘটনাচক্রে চলতি মাসের গোড়া থেকেই পাক অধিকৃত কাশ্মীরের রাজধানী মুজফ্ফরাবাদ-সহ সামাহনি, সেহানসা, মিরপুর, রাওয়ালকোট, হাত্তিয়ান বালা, খুইরাট্টা, তত্তপানির মতো এলাকায় ইসলামাবাদ বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। চড়া রাজস্ব, মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ সঙ্কটের মুখে অধিকৃত কাশ্মীরের বাসিন্দাদের অসন্তোষ অনেক দিন ধরেই জমা হচ্ছিল। সূত্রের দাবি, ওই অঞ্চলে উৎপন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে। তা নিয়ে ক্ষুব্ধ অধিকৃত কাশ্মীরের বাসিন্দারা প্রতিবাদে পথে নামেন। খোলাখুলি পাকিস্তান বিরোধী স্লোগান দেন। বিক্ষোভকারীদের উপর পাক পুলিশ ও আধাসেনা গুলি চালালে কয়েক জনের মৃত্যুও হয়। একদিকে যখন অশান্তিতে দীর্ণ পাক অধিকৃত কাশ্মীর, সেখানে ভারতের কাশ্মীরে ৩২ বছর বাদে অবাধে ভোট দিচ্ছে মানুষ। আর তার পুরো কৃতিত্বটাই পকেটে পুরতে চাইছে বিজেপি। এই পরিস্থিতিতে পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের মানচিত্রের অন্তর্গত করার মতো প্রতিশ্রুতি যে ভোটের বাজারে ভালোই প্রভাব ফেলতে পারে তা ভালোই বুঝেছে গেরুয়া শিবির।
একই সঙ্গে পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে কংগ্রেসকে এক হাত নেওয়াটাও অন্যতম উদ্দেশ্য বিজেপির। হিমন্ত বিশ্বশর্মা গত মঙ্গলবার পূর্ব দিল্লির বিজেপি প্রার্থী হর্ষ মালহোত্রার সমর্থনে একটি প্রচারসভা করেন। সেখানেও তিনি বলেন, "যখন কংগ্রেসের সরকার ছিল তখন বলা হত কাশ্মীর ভারতেও রয়েছে, কাশ্মীর পাকিস্তানেও রয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে সংসদে কোনওরকম আলোচনা হত না যে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর ভারতেরই অংশ। তবে গত কয়েকদিন ধরে অধিকৃত কাশ্মীরের বাসিন্দারা পাক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন। ওখান মানুষ ভারতের পতাকা হাতে আন্দোলন করছেন। এটা সবে শুরু। মোদিজিকে ৪০০ আসনে জয়ী করুন পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতেই চলে আসবে।"
আরও পড়ুন: গত কয়েক দশকে প্রথম বার! লোকসভা ভোট ঘিরে যে ছকভাঙা ছবি দেখল কাশ্মীর
আসলে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের অশান্তির ছবি মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরে এ দেশে বিজেপি সরকারের শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্ভাবনাকেই তুলে ধরতে চাইছেন বিজেপি নেতারা। একই সঙ্গে এ দেশের সংখ্যালঘুরাও তাতে খানিকটা হলে আশার ছবি দেখতে পারে, সেই চেষ্টারও খামতি নেই। কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব আজকের নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এই ভূখণ্ডের দাবিতে তপ্ত দুই দেশ। ফলে কাশ্মীর নিয়ে ভারতীয়দের আবেগও কিছু কম নয়। ভোট এলে আগে মোদিদের অস্ত্র হত পুলওয়ামা বা সার্জিকাল স্ট্রাইকের মতো ইস্যু। যা দিয়ে জাতীয়তাবাদের জিগির উস্কে লাভের গুড় ঘরে তুলত বিজেপি। এবার সেই জাতীয়তাবাদ জাগানোর হাতিয়ার নয়া অস্ত্র পাক অধিকৃত কাশ্মীর নয় তো? ভাবাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের। ভোটের মাঝে সেই জাতীয়তাবাদের হাওয়া আদতে কতটা কাজে আসবে বিজেপির? চারশো আসন দখলের লড়াইয়ে হিন্দু ভোটের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের সমর্থনও কি যাবে পদ্মশিবিরের ঝুলিতে, অন্তত পাক অধিকৃত কাশ্মীর দখলের আশ্বাসের মতো জাতীয়তাবাদী অস্ত্র বাজারে ছাড়ার পর? এ সমস্ত প্রশ্নের উত্তরই বোধহয় দেবে জুনের চার।