সকলের ‘বিকাশ‘ আদতে মিথ! মোদি জমানায় লাভের গুড় হাতে পেল ঠিক কারা?
Modi Government: মুখে 'সবকা সাথ সবকা বিকাশে'র কথা বারবার বলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু সে কথা আসলে কতটা ঠিক? মোদি জমানায় কতটা বিকশিত হয়েছে সমাজের সব শ্রেণির মানুষজন?
চলতি লোকসভা ভোটে জিততে পারলে তৃতীয় দফায় সিংহাসনে বসবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ২০২৪ লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে বছরভর নানা কর্মসূচী, পরিকল্পনা সাজিয়েছিল বিজেপি। বলাই বাহুল্য, তার বড় একটা নিশানা ছিল হিন্দু ভোট। বছরভরের প্রস্তুতি এতটাই আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল গেরুয়াশিবিরকে, যে ভোটমুখী বাজেটেও দেখা গিয়েছিল সেই প্রত্যয়ের ছাপ। তবে রাজনীতি আসলে নাগরদোলার পাক। দিনে, রাতে, পলে পলে তার রং বদলায়। ফলে সেই রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে মুহূর্তে মুহূর্তে কৌশল বদল করা জরুরি। সদ্য বারাণসী লোকসভা কেন্দ্রের জন্য মনোনয়ন জমা দিয়েছেন মোদি। সামনে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পত্তির হলফনামা। যেখানে দেখা গেছে তাঁর নামে নিজস্ব বাড়ি নেই, গাড়ি নেই। যদিও সম্পত্তির পরিমাণ নেহাৎ কম নয়। মুখে 'সবকা সাথ সবকা বিকাশে'র কথা বারবার বলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু সে কথা আসলে কতটা ঠিক? মোদি জমানায় কতটা বিকশিত হয়েছে সমাজের সব শ্রেণির মানুষজন? নাকি লাভের গুড় পকেটে পুরেছে বিশেষ কিছু ব্যক্তি, সংস্থাই? মোদির শাসনে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে কারা?
গত দশ বছরে দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্য, প্রতিটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রতি জেলায় মোড়ে মোড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে বিজেপির পার্টি অফিস। পার্টি অফিস তৈরি করতে শুধু লোকবলই যথেষ্ট নয়, অর্থবল লাগে। আর সেই টাকা কোথা থেকে আসে, তা কোনও রকেট-বিজ্ঞান নয়। ভোটের মুখে মুখেই বিজেপির ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্পকে বেআইনি ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। একে একে সামনে আসতে থাকে ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত তথ্য। ওই বন্ড প্রকল্পের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংস্থা কোন দলকে কত টাকা দিয়েছে, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে সকলের সামনে।
আরও পড়ুন: ‘চারশো পেলেই পাক অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের!’ ভোটবাজারে পদ্ম-নেতাদের মুখে কেন বারবার ‘কাশ্মীর’-জিগির?
এই মোদিই ক্ষমতায় এসে নোটবন্দি ঘোষণা করে দেশের কালো টাকা ফেরানোর কথা বলেছিলেন। অথচ আসলে তেমন কিছুই ঘটেনি বাস্তবে। নোটবাতিলের ফলে সমস্যা ভোগ করেছেন শুধু এ দেশের গরিব, খেটে খাওয়া, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা। তার পর জিএসটি এবং করোনাকালীন সময়ে লকডাউন। মোদির অধিকাংশ বড় সিদ্ধান্তই আসলে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের তেমন উপকার ঘটাতে পারেনি। কিন্তু লাভবান হয়েছেন বড় বড় শিল্পপতি-বাণিজ্যপতিরা। তাঁরা আরও বেশি ফুলেফেঁপে উঠেছেন। মোদির সঙ্গে তাঁদের সৌহ্রাদ্য বেড়েছে আরও। রাষ্ট্রের 'প্রধান সেবক' বলে দাবি করে আসা মোদি ও তাঁর সরকার আদতে কাদের সেবায় ব্রতী ছিল বছরভর? এখন মোদিজি যতই আদানি-অম্বানি ঘনিষ্ঠতার কথা এড়াতে চান না কেন, এককালে মোদির সঙ্গে এই শিল্পপতিদের হলায়-গলায় ভাব, কারওরই চোখ এড়ায়নি।
একাধিক টেন্ডার পাইয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে একের পর এক সরকারি সেক্টর অবলীলায় আদানিদের হাতে তুলে দিয়েছেন মোদি। সে নিয়ে কম চর্চা হয়নি। আদানি এন্টারপ্রাইস থেকে শুরু করে রিল্যায়েন্স ইন্ডাস্ট্রি, প্রভূত উপকৃত হয়েছে মোদি সরকারের থেকে। শুধু এরাই বা কেন, জেট এয়ারওয়েজের মালিক মুরারি লাল জালান, নন্দাল ফাইন্যান্স অ্যান্ড লিজিং, মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং, নিরমা, সোলার ইন্ডাস্ট্রিস ইন্ডিয়া লিমিটেড, রহেজা কর্প থেকে শুরু করে রামদেবের সংস্থা রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলি, গত দশ বছরে এদের ভাগ্য এবং ব্যবসার চাকা ঘুরেছে মোদি সরকারের কল্যাণে। এরা সকলেই উপকৃত হয়েছে বিজেপি জমানায় এবং উল্টোদিকে এদের থেকে উপকৃত হয়েছে বিজেপি সরকারও। উপরের তালিকায় থাকা বহু নামই কিন্তু ইলেক্টোরাল বন্ড নথিতেও জ্বলজ্বল করেছে। ফলে এই যে আদান-প্রদানের বন্ধুত্ব, সেই সমীকরণ বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। কোনও না কোনও ভাবে মোদি সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও নীতির দ্বারা লাভবান হয়েছে এরা সকলেই।
২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর শোনা গিয়েছিল, সরকার চায় পাঁচ থেকে ছ'টি সেক্টরে চ্যাম্পিয়ন তৈরি করতে। যাদের কাছ থেকে লাভবান হবে ভারতের রাজনৈতিক অর্থনীতিও। ২০১৮ সালে এক ইনভেসমেন্ট ব্যাঙ্কার তথ্য দিয়ে দেখিয়েছিলেন, কোন কোন সংস্থার মাথায় মোদি সরকারের আশীর্বাদী হাত পড়েছে। সেই তালিকায় দেখা যাচ্ছে, অ্যাভিয়েশনে রয়েছে স্পাইসজেট, স্টিল সেক্টরে রয়েছে জেএসডব্লিউ, টেলিকমে রিল্যায়েন্স, ইউটিলিটিতে আদানি, কনস্ট্রাকশনে দিলীপ বিল্ডকন, ব্যাঙ্কিংয়ে কোটাক, মাইনিংয়ে বেদান্তের মতো সংস্থা।
সরকারি বদান্যতা পাওয়া এ সমস্ত সংস্থা যে শুধু ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেই সুযোগসুবিধা পেয়েছে, তা-ই নয়। রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে স্বেচ্ছাচারিতারও বহু সুযোগ পেয়েছে তারা। বহু শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীই সুযোগ পেয়েছে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার। সরকারি বদন্যতায় পাওয়া সহজ ঋণের অপব্যবহারও কম হয়নি। যার ফলাফল ভুগেছে দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। রিপোর্ট বলছে, দেশে ঋণখেলাপী ব্যবসায়ীর সংখ্যা এই মুহূর্তে কিছু কম নেই। তবে সেসব নিয়ে নীরব দেশের সরকার।
আরও পড়ুন:‘মুসলিম বন্ধুদের মধ্যেই বড় হয়েছি!’ মনোনয়ন জমা দিয়েই কেন পাল্টি মোদির?
দেশের মানুষের যে বিকাশের দাবি এই দশ বছরে মোদি করে এসেছেন, তার সিংহভাগ যে এ দেশের ধনকুবেরদের জন্য, তা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। মোদি একদিকে বলেছেন, তাঁর জমানায় দেশের গরিবি কমেছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। অন্যদিকে ভোটের আগে বিজেপি সরকার ঘোষণা করে দিয়েছে রেশন প্রকল্পের কথা। মোদি আত্মনির্ভর হওয়ার কথা তো বলছেন, কিন্তু দেশের তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থানের জন্য তেমন কোনও ভাবনাচিন্তা নেই গেরুয়া সরকারের। দেশকে ধর্মের ভিত্তিতে ভেঙে মানুষের মন দারিদ্র, কর্মসংস্থান, শিল্প থেকে ঘুরিয়ে রাখাই যেন মূল লক্ষ্য হয়ে গিয়েছে আজকের সরকারের। বিভিন্ন ভোটমুখী জনসভায় গিয়ে বারবার হিন্দু-মুসলিম, সিএএ-এনআরসি করে দেশের মানুষকে ব্যস্ত রাখতে চাইছেন মোদি। আর তার মাঝখানে লাভের গুড় খেয়ে যাচ্ছে মোদি-ঘনিষ্ঠ একদল ধনকুবের। পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক বছরে ধনীর ধন বেড়েছে। এবং গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে। এ দেশে ধনের সমবণ্টণ হয়নি কোনওদিনই। আর সেই অসাম্য মোদি জমানায় যেন আকাশ-পাতাল বৈষম্যে পরিণত হয়েছে। মোদির হাতের তলায় বিকাশ আসলে হয়েছে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবানদেরই। বাকি দেশ যে অন্ধকারে ছিল, সেই অন্ধকারে বেড়েছে বই কমেনি। তেমনটাই মনে করছে অভিজ্ঞমহলের বড় অংশ।