আজীবন জাল নন্দলাল, জাল রামকিঙ্কর হয়েই রয়ে গেলেন অনেকে

Fake Paintings: যিনি জাল করছেন তিনি কিন্তু একদিকে তুখোড় দক্ষ। তবে ভাবনার দিকে চরম ব্যর্থ তিনি।

প্রথমেই একটা বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। ছবি নকল করা আর জাল করা কিন্তু আলাদা। নকল করা বিষয়টি শিল্পচর্চার মধ্যেই পড়ে। ধরা যাক, অজন্তার একটা ছবি ছাত্রছাত্রীদের নকল করতে দেওয়া হলো, কপি করতে দেওয়া হলো। সেই সময়কার মাস্টারমশাইরা, মানে নন্দলাল বসু, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তারা এই 'কপি' করাকেই বলতেন ছবি নকল করা। সেই ছবি নকল করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বড় বড় বাড়িতে এমনও প্রচলন ছিল যে তাঁরা তাঁদের ভালোবাসার মানুষদের ছবি নকল করতেন। অবনীন্দ্রনাথের ছবি তখন ভারতবর্ষ, প্রবাসী বিভিন্ন পত্রিকায় বেরোচ্ছে, সেই ছবি দেখে দেখে নকল করলেন কেউ, ট্রেসিং করলেন কেউ। এটার একটা আলাদা মাত্রা আছে। এটা ছবি চর্চার সঙ্গেই গভীরভাবে যুক্ত। কিন্তু যখন দেখা গেল, যার ছবি নকল করা হলো, তাঁর সইও জাল করে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন ছবির 'অথরিটি'-কে প্রশ্ন করা হয়। শিল্পীর অধিকারকে মুছে দেওয়া হয়। নন্দলালের ছবি নকল করে নীচে সই নকল করে বসিয়ে দিলাম যেন ওটা নন্দলালেরই ছবি। তখন সেটা হলো জাল ছবি। এর নেপথ্যে অন্য মানসিকতা কাজ করে। নন্দলালের নামে চালালে, নন্দলালের প্রকৃত ছবির যে মূল্য সেই টাকাই পাওয়া যাবে বিক্রি করে। এমন অনেক জাল ছবি আসে, যেখানে ছবি শিল্পীদের কুশলতা এত বেশি, তারা জাল করতে এত দক্ষ যে আমরাও ভুল করে ফেলি। জাল ছবি ধরা পড়ে না। যিনি জাল করছেন তিনি কিন্তু একদিকে তুখোড় দক্ষ। তবে ভাবনার দিকে চরম ব্যর্থ তিনি। ব্যর্থতাকে ঢাকতে এই কাজ করেন টাকার লোভে, বলা ভালো তাঁদের দিয়ে করানো হয়। এমন অনেক শিল্পী আছেন যারা এত অবলীলায় রামকিঙ্কর বা বিনোদবিহারী বা নন্দলাল আঁকতে পারেন যে অভিজ্ঞ চোখেও ধাঁধাঁ লেগে যায়। তবে হ্যাঁ, কোথাও না কোথাও ছোট্ট ভুল করেই ফেলেন তারা কারণ পর্যাপ্ত গবেষণা করে না আঁকলে এই ভুল হবেই।

কিছুদিন আগেই কলকাতায় চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে নন্দলালের জাল ছবি দেখেছিলাম। দেখে কী জন্য সন্দেহ হলো আমাদের? ওখানে একাধিক ছবি ছিল বরোদার কীর্তি মন্দিরের দেওয়ালের ম্যুরালের খসড়ার নকল। প্রশ্ন ওঠে, ওই ম্যুরালের খসড়া কোথায় কোথায় থাকতে পারে? সবটাই আছে ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মর্ডান আর্টে। যদি সেখানেও না থাকত তাহলে বরোদার রাজ পরিবারে থাকবেই। কারণ বরোদার রাজ পরিবারই আহ্বান জানিয়েছিল নন্দলালকে এই ম্যুরাল করতে। সেখানে নাও থাকলে নন্দলালের পরিবারে তো আছেই। তাহলে খসড়া ঠাকুর পরিবারে কীভাবে এল? যারা দাবি করছেন, সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের কাছে এই ছবি ছিল, তারা কোন ভিত্তিতে বলছেন? অবনীন্দ্রনাথের ছোট ভাই হলেন সমরেন্দ্র। এই ছবি অবনীন্দ্রনাথ রাখলেও রাখতেও পারতেন। সমরেন্দ্র কেন করবেন? বলা হলো সমরন্দ্রের নাতনি নাকি এই ছবি দিয়েছেন। নাতনির ঠিকুজি-কুষ্টি মেলাতে গিয়ে দেখা গেল নাতনির নাম কোথাও মিলছে না। নাতনি বলছেন তাঁর নাম সোমা চ্যাটার্জি, বাবার নাম মানীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানীন্দ্রনাথের বাবা হচ্ছেন সমরেন্দ্রনাথ। মানীন্দ্রনাথ কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের ছেলে। ঠাকুরবাড়িতে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত অপ্রকাশিত ছবিতে নিজের ছবি, অন্যের ছবি সুপারইম্পোজ করে বসিয়ে তিনি ঘটনাটিকে সত্যি প্রমাণ করতে চাইলেন। এখানে ঠাকুরবাড়িকে টেনে আনা হলো জাল ছবির বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরির কারণে।

আরও পড়ুন- রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়া যিশুর যন্ত্রণাকে এঁকেছিলেন নন্দলাল, যামিনীরা

আগে যারা নকল করতেন তারা পরিচিত ছবিকে নকল করতেন, ফলে খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে যেত। এখন যারা নকল করছেন তারা পরিচিত ছবিকে নকল করছেন না আর, তারা সেই স্টাইল ও শৈলী নকল করে নতুন ছবি আঁকছেন। ফলে অনেকেই ভেবে নিচ্ছেন এ তো সত্যিকারের আঁকা। এই করতে গিয়ে অনেক জাল শিল্পী এমন সাল লিখে ফেলছেন নিজের অজান্তে বা নাম লিখে ফেলছেন যাতে ধরা পড়ে যাচ্ছেন। যেমন, বেইজ লিখতে B লিখছেন অথচ রামকিঙ্কর আজীবন বেইজে V লিখতেন।

এই জাল ছবির এমন রমরমা তৈরির কারণ হচ্ছে, শেষ ২০ বছরে বিখ্যাত শিল্পীদের ছবির দাম আকাশছোঁয়া। কোনও গ্যালারিতে নন্দলালের পোস্টকার্ড বিক্রি করলে তার দাম ১ লক্ষ হবে। সেটাই নিলামে গেলে ওই ছবির দাম ৩ থেকে ৮ লাখ টাকা ওঠে। স্বভাবতই নকল করে বাজারে চালিয়ে দেওয়া গেলে লাভবান হবেই ব্যবসায়ী। ছবি নকল লাভজনক ব্যবসা। এবং এই জাল ছবিকে ধরবার জন্য দেশে এখনও আমাদের দেশে তেমন আইন নেই। যিনি কিনলেন তিনি প্রতারিত হলেন ঠিকই কিন্তু প্রতারককে ধরা যাচ্ছে না কারণ অধিকাংশ ছবি নগদে বিক্রি হচ্ছে। অধিকাংশ ছবি বিক্রির টাকা ব্যাঙ্কে ঢোকে না। আর অধিকাংশ ছবিই জাল শিল্পীরা পারিবারিক সংগ্রহ বলে চালিয়ে দেন, ফলে কেউ প্রশ্ন করে না।

বিদেশের অনেক গ্যালারি ভ্যান গঘের কর্পোরেট কপি বিক্রি করে। সেটা কিন্তু অপরাধ না। সায়েন্টিফিক ফ্যাক্সিমিলি কপি আছে। এমন ছবি যে সেখানে রবার দিয়ে পেনসিলের দাগও তোলা যাবে। এটা জাল ছবি বলা যাবে না। বরং এতে ছবি সংগ্রহের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। সিমা গালারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রিন্ট কপি বিক্রি করে গণেশ পাইনের, তাতে সইও আছে। লিমিটেড কপি থাকে। এগুলো জাল নয়। কিন্তু নিজে ছবি এঁকে রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বা বিনোদবিহারীর নামে চালানোর চেষ্টা দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা। আমাদের এই সচেতনতা নেই বলেই জাল ছবির বাজার বাড়ছে। ছবি নকল করা শৈল্পিক অধিকার কিন্তু জাল করা শৈল্পিল প্রতারণা। এতে দক্ষ শিল্পীদের হতাশা মিশে আছে, কান্না মিশে আছে। ভাবনার দক্ষতা না থাকায় শিল্পী জাল করতে পারলেও ভুল করেই ফেলেন।

আরও পড়ুন- বিশ্বজুড়ে ‘ভাইরাল’ চে গেভারার এই ছবিটিই! কীভাবে তোলা হয়েছিল এই ছবি?

চিত্রকূট আর্ট গ্যারালির কর্ণধাররা ছবির প্রকৃত পৃষ্ঠপোষকতা এবং কদর করতেন, বাংলার শিল্পসমাজ এদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে অবশ্যই। কিন্তু এই সম্মান, এই উজ্জ্বল মানদণ্ড এখন ভূলুণ্ঠিত। শিল্পসমাজ ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে চিত্রকূটের দিকে। যার হাতে রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারীরা তৈরি হয়েছেন সেই আচার্য নন্দলালের নামে কতগুলি কদর্য ছবিকে চালানোর চেষ্টা যারা করলেন তাঁদের আর শ্রদ্ধা করা যায় না।

জাল ছবি বিক্রির বিবিধ প্রক্রিয়া আছে। ধরা যাক, হেমেন মজুমদারের 'সিক্ত বসনা' হয়তো খুঁজছেন কেউ। তিনি খোঁজ পেলেন অমুক লোকের কাছে ছবিটি আছে। ফোনও করলেন। যার কাছে ছবিটি আছে তিনি বললেন, এ ছবি তিনি বিক্রি করবেন না, এ তাঁদের পূর্বপুরুষের সংগ্রহ। বেশ কয়েকবার ফোনের পর তিনি হয়তো বললেন, "৫ লাখ টাকা দিলেও দেব না।" অর্থাৎ একটা টাকার অঙ্ক উল্লেখ করে দিলেন। যিনি কিনতে চাইছেন তিনি দেখা গেল একদিন নেশার বশে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে চলে গেলেন ছবিটি দেখতে। এবার ওই ভদ্রলোক নাটুকে নিমরাজি হয়েও ছবি বিক্রি করে দিলেন। পরে দেখা গেল হেমেন মজুমদারের সই করতেন dar, আর ছবিতে সই আছে der। ১৫ লাখে জাল ছবি কিনলেন ওই ভদ্রলোক।

এখন আবার একদল এমন সংগ্রাহক আছেন যাঁরা নকল কিনে সেটা আবার আরেকজনকে বেচে দেন। আগে যারা ঠকতেন তারা ঠকাটাকেই ব্যবসা করে দিয়েছেন। টাকা রোজগারই জাল ছবির মূল নিয়ন্ত্রা।

চিত্রকূটের গ্যালারিতে নন্দলালের একটি ছবি ছিল, যেখানে অর্জুনের সঙ্গে কৃষ্ণ কথা বলছেন। নন্দলালের আসল ছবিতে তখনও যুদ্ধ শুরু হয়নি কুরুক্ষেত্রের, অর্জুনের মনে প্রশ্ন আছে, দ্বিধা আছে। সেই ছবিতে অর্জুন ও কৃষ্ণের পিছনে শূন্য জমি, কিছু ফুল দেখা যাচ্ছে। কিন্তু জাল ছবিতে দেখা যাচ্ছে রথের চাকা, ভাঙা তির পড়ে আছে। এটা জাল করা শিল্পীর মস্তিষ্কের ব্যর্থতা। যামিনী রায় যে একই চোখ আঁকতেন তা তো নয়। এক এক মাসে, এক এক বছরে চোখ আঁকার ধরন ভিন্ন হয়েছে। পটলচেরা চোখ কখনও মুখের বাইরে, কখনও ভেতরেই আছে। যে সময়কালে চোখ ভেতরে থাকার কথা তখন যদি বাইরে চলে যায় তাহলে মুশকিল, জাল করতেও বুদ্ধি লাগে।

আরও পড়ুন- দিনের আলোয় শিল্প ‘চুরি’! যেসব প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে দেবজ্যোতি মিশ্রের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ

শিল্প এবং বিজ্ঞান তো হাত ধরে চলে। গর্ভমেন্ট অফ আর্ট কলেজে একটা এক্সিবিশন হয়েছিল। সেখানে রবীন্দ্রনাথের জাল ছবি একবার বিজ্ঞান ধরিয়ে দিয়েছিল। কাগজ ছিল রবীন্দ্রনাথের সময়েরই, সেই সময়ের রং ব্যবহার হয়েছে, রঙ যেভাবে তৈরি তাও পুরনো আমলের কৌশলে, নিবও পুরনো, সইও যথেষ্ট এক। তবু বিজ্ঞান বলে দিল কাগজ পুরনো, রং পুরনো হলেও কাগজের সঙ্গে রঙের বিক্রিয়া রবীন্দ্রনাথের সময়ের না, মেরেকেটে বছর দশেক আগের।

এই মুহূর্তে জাল ছবিকে চেনার ক্ষেত্রে আমাদের সম্পদ ছবি গোয়েন্দা শমীন্দ্রনাথ মজুমদার। ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের অধ্যাপক তিনি। জাল ছবি নিমেষে ফেলতে পারেন। তিনি আবার এক অদ্ভুত সমীকরণে কাজ করেন। তিনি দেখেন কী কী কারণে ছবিটা আসল মনে হচ্ছে। বিপরীতার্থ বিন্দুতে ছবিকে রেখে সদর্থক একটি জায়গায় পৌঁছনোর চেষ্টা করেন। আর শিবকুমার (কলাভবনের অধ্যপক ছিলেন,) সুশোভন অধিকারীদের (কলাভবন কিউরেটর) চোখ এ বিষয়ে নির্ভুল। তাঁরা কোনও ছবিকে সন্দেহ করলে সেটাই ছিল আমাদের কাছে বেদবাক্য। অভিজ্ঞতাই আসল সম্পদ। আসলে যে শিল্পীরা এই জালচক্রে আছেন তারা বড় অসহায়। তাঁদের নামও হয় না, তারা প্রকাশ্যেও আসেন না। বরং নকল ধরা পড়লে শিল্পীদের জরিমানা হয়ে যেতে পারে। তারা আজীবন জাল নন্দলাল, জাল রবীন্দ্রনাথ, জাল পিকাসো হয়েই থেকে গেলেন। মাঝে মাঝে মায়াই হয়।

More Articles