বন্দুকের জয়গান গেয়েছে যে, বন্দুক আজ তাকেই তাক করছে
Gun Civilization: বন্দুকের নল একদিকে যেমন ক্ষমতার উৎস সেই ক্ষমতা আরেকদিক থেকে নির্বুদ্ধিতারও উৎস।
রাম না থাকলে রামরাজ্য যেমন থাকে না, তেমনই বোঝা মুশকিল ১৭৯১ থেকে ২০২৪ এ পৌঁছে গেলে ১৭৯১-এর আক্ষরিক আইন নিয়ম এসব মানুষ কেন মেনে চলবে বা চলতে চাইবে। আজ আমেরিকাতে যেসব জিনিস নিয়ে লাফালাফি বা হামবড়াই ১৭৯১-এ তার কিছুই ছিল না। ইন্টারনেট থেকে হলিউড, টাইম স্কোয়ার থেকে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি সবারই বয়স বেশ কম আমেরিকার মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী থেকে। মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী বলে, A well regulated Malesia being necessary to the security of a free state, the right of the people to keep an bare arms, shall not be infringed. অর্থাৎ, একটি সুনিয়ন্ত্রিত মিলিশিয়া রাষ্ট্র নিরাপত্তার জন্য যেমন প্রয়োজনীয় এই প্রেক্ষিতে জনগণের অস্ত্র রাখার এবং বহন করার অধিকার লঙ্ঘন কখনই করা হবে না। সদ্য ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির পর নবজাতক রাষ্ট্রের পিতারা সতর্ক থাকছেন দ্বিতীয় সংশোধনীতে দু'টি বিষয়ের ওপর। এক, বন্দুকের নল যেহেতু ক্ষমতার উৎস তাই সরকারের কাছে যেন সেই ক্ষমতার একচেটিয়া অধিকার না থাকে। দুই, ১৭৯১ তে স্বল্প জনঘনত্বের মার্কিন দেশে বড় বড় ভূ-স্বামীদের রমরমা। অনেক রাজনীতিকেরাও ছিলেন ভূ-স্বামী। তাদের দাসদাসী সম্বলিত জীবনকে কীভাবে সামরিক ভাবে সুরক্ষিত করা যায় তার চিন্তা থেকেও তৈরি হয়েছে দ্বিতীয় সংশোধনী।
১৭৯১ থেকে ২০২৪ মিসিসিপি, কলোরাডো, মিসৌরির মধ্যে দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয় সংশোধনী আর ব্যক্তিগত বন্দুকের অধিকার আমেরিকাতে আজ সর্বগ্রাসী। ৩৫ কোটি আমেরিকাবাসীর ব্যক্তিগত অধিকারে আজ ৪২ কোটি বন্দুক। তার মধ্যে ঐতিহাসিক ছররা পিস্তল যেমন আছে তেমনই আছে মেশিন গান। আর তেমনই এক মেশিন গান কান ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত সপ্তাহে পেনসিলভেনিয়াতে। প্রশ্ন এখানেই আসে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর এই আক্রমণ কেন? এবং এই আক্রমণ রোখা গেল না কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যে বিষয় নিয়ে আমরা খুবই কম কথা বলি তা হল, ভারতের রেল দুর্ঘটনা যেমন নিত্য নৈমিত্তিক আমেরিকাতে মাস শুটিং বা গুলি করে গণ-নিধনও এক নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। মার্কিন রাজনীতিকরা প্রতি সপ্তাহেই কোন না কোন গণ নিধন বা মাস শুটিং বা কোন না কোন শুটিং নিয়ে মিডিয়ার মুখোমুখি হন এবং তাদের চিন্তা এবং প্রার্থনা (thoughts and prayers) তারা আমাদেরকে উপহার দিয়ে চলেছেন।
বন্দুক আমেরিকার সাধারণ মানুষের কাছে একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং দ্বিধাবিভক্ত মানুষের বিষয়। অধিকাংশ মানুষ যখন একদিকে যেমন বন্দুকের অপব্যবহার নিয়ে চিন্তিত এবং বিরোধী তেমনই এক বড় শতাংশের মানুষ ঐতিহাসিকভাবে তাদের পারিবারিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে বন্দুকের প্রতি তাদের যে অধিকার তা ছেড়ে দিতে একেবারেই রাজি নন। এই রাজনৈতিক বিভেদ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে ২০১৬-র পর থেকে যখন ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির শুরু এবং ডেমোক্র্যাটদের হারানোর জন্য ট্রাম্প এবং তার অনুগামীরা সমস্ত রক্ষণশীল এবং অতি রক্ষণশীল রাজনৈতিক শক্তির সাথে হাত মিলিয়েছেন এবং সেখানে দাঁড়িয়ে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হল এন। আর। এ বা ন্যাশানাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন। চার্চ বন্দুক এবং সাদা মানুষের ব্যক্তি স্বতন্ত্রের পরিচয়। এই বিষয়গুলো নিয়েই দক্ষিণপন্থী আমেরিকান রাজনীতি আন্দোলিত আর সেই রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল হোতা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চারশো ফুট দূর থেকে ২০ বছর বয়সী এক আপাত নিরীহ তরুণ পরপর আটবার গুলি চালিয়ে হত্যা করবার চেষ্টা করবে তা বোধহয় কেউই ভাবেননি। কিন্তু যে কোন ক্রিয়ারই যেমন বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি এই হামলা যেন সেই প্রতিক্রিয়ারই অঙ্গ।
দুঃখের বিষয় এটাই যে, এই সমস্ত কিছুর পরেও স্যান্ডি হুক থেকে পার্ক সিটি অসমর্থ প্রতিবন্ধী থেকে নার্সারি স্কুলের বাচ্চা বন্দুকবাজদের বন্দুকের নল থেকে পরিত্রান কারুরই নেই বর্তমান আমেরিকান রাজনীতির প্রেক্ষিতে। তার মূল কারণ বর্তমান আমেরিকান রাজনীতিতে দুটি স্পষ্ট ভাগ। একদিকে যেমন প্রগতিশীল ক্যালিফোর্নিয়া, নিউ ইয়র্ক ইত্যাদি অন্যদিকে রক্ষণশীল টেক্সাস, লুইসিয়ানা, কানসাস ইত্যাদি। এই দুই রাজ্যভিত্তিক ভাগাভাগির মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সুপ্রিম কোর্ট যাতে বর্তমানে ৬ঃ৩ গরিষ্ঠতায় রক্ষণশীল বিচারকরা প্রাধান্য পেয়ে চলেছেন এবং তারা দ্বিতীয় সংশোধনী কেন সংবিধানের কোনও সংশোধনীকেই তারা আঁচড় অবধি কাটতে দেবেন না। কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে ১৭৯১ তে লেখা সংবিধানের আক্ষরিক অর্থই মেনে চলা মার্কিন জনগণের কর্তব্য এবং ধ্রুব। এই সমস্ত পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে টিভি প্রাইম টাইমের বাকতাল্লা ছাড়া অনর্গল চিন্তা এবং প্রার্থনা ছাড়া অন্য কোনও কিছুই কোনও বন্দুক হামলায় আক্রান্ত আহত নিহত মানুষের পরিজনের জন্য বর্তমান আমেরিকাতে প্রাপ্য নয়। ট্রাম্প, বাইডেন, ওবামা, বুশ, কামলা হ্যারিস, জেডি ভ্যান্স কারোরই সামর্থ্য নেই দ্বিতীয় সংশোধনীর গায়ে আঁচ অবধি আসতে দেবে। কারণ, বন্দুকের নল একদিকে যেমন ক্ষমতার উৎস সেই ক্ষমতা আরেকদিক থেকে নির্বুদ্ধিতারও উৎস।