নিরাপদে থাকা মানুষকে সিরিয়ার উদ্বাস্তু শিশুদের কথা শোনাতে হাঁটছে ছোট্ট আমাল

Amal The Syrian Doll: আমাল রক্তমাংসের মানুষ নয়। সে ১০ বছর বয়সি ১২ ফুটের এক পুতুল কন্যে। সিরিয়ার এই মেয়ে ২০২১ সালের জুলাই মাস থেকে ছুটে বেড়িয়েছে ১৭টি দেশের ১৬৬টি শহর বা বিখ্যাত সব জায়গায়।

নাম আমাল। বয়স মাত্র ১০। সিরিয়ার হাজার হাজার হতভাগ্য উদ্বাস্তু শিশুর মতো সেও একজন। এই বয়সে তো তার পড়াশোনা করার কথা, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলো করে জীবনের নানা আনন্দ, প্রকৃতির নানা রঙ উপভোগ করার কথা। বাবা-মা আত্মীয় স্বজনের ভালোবাসায় একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠার কথা। অথচ নিজের বাড়িতে থাকা হয়ে ওঠেনি তার। পালাতে হয়েছে প্রিয় খেলার জায়গা, মাঠ-ঘাট, অলিগলি ছেড়ে অন্য কোথাও – যেখানে একটু বেঁচে থাকা যাবে। কারণ সে রিফিউজি, উদ্বাস্তু, শরণার্থী। এই পরিচয় নিয়েই সে ঘুরে বেড়াচ্ছে গোটা পৃথিবীজুড়ে। ঘুরে বেড়াচ্ছে একটিই কথা বলতে, যেন নিরাপদে থাকা মানুষ তাঁর মতো যুদ্ধ, হিংসা, নিপীড়নের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো শিশুদের কথা না ভুলে যায়। এই সমস্ত ভিটেমাটিহীন শিশুদের প্রতিনিধি হয়ে, তাঁদের চোখের জল জমে জমে কঠিন হয়ে ওঠা বেদনার পাথর বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাল। আর্জি জানাচ্ছে, পৃথিবীর আর কোনও শিশুকে যেন এভাবে ঘরের খোঁজে দোরে দোরে ঘুরে বেড়াতে না হয়।

তবে আমাল রক্তমাংসের মানুষ নয়। সে ১০ বছর বয়সি ১২ ফুটের এক পুতুল কন্যে। সিরিয়ার এই মেয়ে ২০২১ সালের জুলাই মাস থেকে ছুটে বেড়িয়েছে ১৭টি দেশের ১৬৬টি শহর বা বিখ্যাত সব জায়গায়। সেই সমস্ত জায়গায় গিয়ে সে জানিয়ে আসছে যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে নির্মম কোপে পড়া অসহায় শিশুদের কথা। এসব কথা শোনাতে সে অংশ নিয়েছে ৪৭৫টি অনুষ্ঠানে। যদিও কথা বলতে পারে না আমাল। তবুও যেখানে সে গেছে, নির্বাক হলেও তাঁর উপস্থিতি হাজার হাজার মানুষের মধ্যে এমন প্রভাব ফেলেছে যা লক্ষ কথা বলেও সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন- চক্ষু চিকিৎসক থেকে স্বৈরশাসক! অবাক করবে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের উত্থান

প্রতিদিন কত কী ঘটে যাহা-তাহা! কোথাও কেউ ৫০০০ কোটি টাকা খরচ করে ছেলের বিয়ে দিচ্ছে, কোথাও আবার কোনও কোনও যুদ্ধউন্মাদ মিসাইলের পর মিসাইল ছুড়ে ধ্বংস করে ফেলছে একের পর এক শহর। একদিকে মানুষ খেয়ে-দেয়ে, নেচে-গেয়ে ফুর্তির ফোয়ারা ছুটিয়েও আনন্দ শেষ করে উঠতে পারছে না। অন্যদিকে ধ্বংসস্তূপ, মানুষের খাবার নেই, জল নেই, থাকার ঘর নেই, চিকিৎসা নেই। আছে শুধু শরীর আর বেঁচে থাকার আকুতি। এসব দিনরাত দেখতে দেখতেই এই প্রলোভনমুখী বিশ্বে আমরা ভুলতেই বসেছিলাম সিরিয়ার কথা। আয়লান কুর্দিকে মনে আছে? যার পরিবার গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তুরস্কে। সেখান থেকে সপরিবারে গ্রিস যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে মারা যায় তার মা সহ আরও অনেকে। বাবার হাত ফসকে জলে পড়ে মারা যায় সে ও তার পাঁচ বছরের দাদা গালিব। সিরিয়ার শিশু আয়লানের নিষ্প্রাণ শরীর তুরস্কের একটি সৈকতে ভেসে এসে নাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্ব বিবেককে। সেটা ২০১৫ সালের কথা। বাবার কান্নাকে তুলে ধরে সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছিল হাজার হাজার শোকগাথা। ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ছেয়ে গিয়েছিল গৃহযুদ্ধ কবলিত সিরিয়ার কথা, গোটা বিশ্ব জুড়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা শরণার্থী সমস্যার কথা।

স্বাভাবিকভাবেই আয়লানের কথা চলে গিয়েছিল স্মৃতির অনেক পিছনের সারিতে। প্রেসিডেন্টের স্বৈরশাসন, বিদ্রোহীদের লড়াই আর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ নরক হয়ে যাওয়া সিরিয়ার কথা পৃথিবীর ফের মনে পড়ল বাশার-আল-আসাদের দেশ ছেড়ে পালাবার পর। রাষ্ট্রসঙ্ঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সিরিয়া ছেড়ে অন্য দেশে পালিয়েছেন ৬ মিলিয়ন বা ৬০ লক্ষ মানুষ। জন্মভূমির দুর্বিষহ পরিবেশ ছেড়ে শুধু বাঁচার জন্য, খেতে পাওয়ার জন্য জীবন বাজি রেখে যারা পালিয়েছেন বা পালাতে পেরেছেন- তাদের অনেকেরই কপালে জুটেছে আরও নরক যন্ত্রণা। কেউ কোনওরকমে বেঁচে গেছেন। আর কাউকে ছোবল মেরেছে সাক্ষাৎ মৃত্যু। পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো আর জীবন-মৃত্যুর এই বাজিখেলায় মাখামাখি হয়ে গেছে সিরিয়ার শৈশব-কৈশোরগুলি। তাঁদের কথাই বিশ্বের দোরে দোরে বলবার জন্য দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট আমাল।

লিটল আমাল বা পুতুল আমালকে তৈরি করেছে হ্যান্ডস্প্রিং পাপেট কোম্পানি, ডিজাইনও তাদের। আমালের উচ্চতা ১২ ফুট বা প্রায় সাড়ে ৩ মিটার। আসলে সে একটি পুতুলের খাঁচা যাকে ভেতর ও বাইরে থেকে চালনা করা হয়। পুতুলের ভেতরে থাকে একজন মানুষ আর বাইরে থেকে দু'পাশে দু'জন লিভার বা লাঠির সাহায্যে তার দুই হাত ও ঘোরা-ফেরাকে চালনা করে। আমালের মুখ জুড়ে বিষাদ
আর কষ্ট। তার চুল রুক্ষ, অবিন্যস্ত, পায়ে মোটা জুতো। পোশাকে নেই পরিপাট্য। বাস্তুচ্যুত মানুষ, বিশেষ করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশুদের জন্য পুতুল আমাল সমবেদনা এবং মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক প্রতীক হয়ে উঠেছে। আমাল ক্রমেই এই যুগের সবচেয়ে প্রভাব ফেলা আন্দোলনগুলির মধ্যে একটি হয়ে উঠছে। তবে এই পথহাঁটা এক অভূতপূর্ব মানবতার বার্তা দিলেও এর পিছনে কাজ করছে পাপেটের মাধ্যমে বার্তা দেওয়ার উদ্যোগও। তাতে ইতিমধ্যেই ‘দ্য ওয়াক’ ২০২১ সালের 'টাইম আউট পাবলিক আর্ট অ্যাওয়ার্ড' জিতে নিয়েছে আমাল।

বিশ্ব জুড়ে আমালের এই ছুটে বেড়ানোর পেছনে যাঁরা আছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম দ্য ওয়াকের শৈল্পিক পরিচালক আমির নিজার জুয়াবি। তাঁর বক্তব্য, “শরণার্থীদের খাবার এবং কম্বল দরকার, পাশাপাশি তাঁদের মর্যাদা এবং একটি কণ্ঠও দরকার। দ্য ওয়াকের উদ্দেশ্য শুধু উদ্বাস্তুদের ভয়াবহ পরিস্থিতিটাই নয়, তাঁদের সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরা। ছোট আমাল সাড়ে তিন মিটার লম্বা কারণ আমরা চাই বিশ্ব
তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে যথেষ্ট উদার হোক। আমরা চাই আমাল আমাদেরকে বড় করে ভাবতে এবং আরও বড় কাজ করতে অনুপ্রাণিত করুক।”

আরও পড়ুন- স্নান-খাওয়ার জলটুকুও নেই! দূষিত সমুদ্রের জলেই বাঁচছে গাজার শরণার্থী শিশুরা

তথ্য বলছে পৃথিবীর সমস্ত শরণার্থীর অর্ধেকই শিশু। সমস্ত স্কুলবয়সি উদ্বাস্তু শিশুদের অর্ধেক তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ হারিয়েছে। আজ হাজার হাজার শিশু যারা যুদ্ধ এবং নিপীড়ন থেকে কোনওভাবে পালাতে পেরেছে তাদের জরুরি সহায়তার প্রয়োজন।এই শিশুদের সাহায্য করার জন্য চালু করা হয়েছে ‘দ্য আমাল ফান্ড’। হাঁটতে শুরু করে বিশ্বে উদ্বাস্তু এবং বাস্তুচ্যুত শিশুদের জরুরি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য আমাল ১,০০০,০০০ ডলার সংগ্রহ করেছে। The Amal Fund-এর সূচনা থেকে এই ফান্ড ১১টি দেশের ২৩টি সংস্থার সাহায্য ৩৩,০৬৬ জনকে পাঠিয়েছে যার মধ্যে ১৬,৭৮২ জনই শিশু।

২০২৫ সালেও দেশে দেশে ঘুরবে আমাল। বিদ্রোহীরা একনায়ক প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও সিরিয়ায়
যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি বলেই সতর্ক করেছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশেষ দূত গেইর পেডারসেন। সেখানকার মানবিক সঙ্কট কবে মিটবে কেউ জানে না। তাই পথ চলাও থামছে না আমালের। ইতিমধ্যেই ২৬০০ মাইলের বেশি পথ অতিক্রম করে ফেলেছে সে। ২০২১ সাল থেকে সে তুরস্ক, গ্রিস, ইউক্রেন, ইতালি, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আয়ারল্যান্ড সহ বহু দেশ ঘুরে ফেলেছে। গেছে সুইজারল্যান্ড,জার্মানি, ইংল্যান্ড সহ আরও অনেক দেশ, বিখ্যাত সব শহরেও। ২০২৫ সালে তার গন্তব্য চিলি ও আরও অন্য অনেক দেশ। জানুয়ারিতেই চিলির Fundación Internacional Teatro a Mil ফেস্টিভ্যালে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু শিশুর প্রতিনিধি হয়ে শরণার্থী জীবনের গল্প শোনাবে সে। আধুনিক এই পৃথিবীতেই মানবতার এই ভয়াবহ বাস্তবতায় অবাক হবে ভালো থাকা মানুষ। কিন্তু আমালের চলা থামবে না। বিষণ্ণতা আর বেদনা ভরা মুখ নিয়ে আর এক দেশের পথে পা বাড়াবে সে।

More Articles