ধূ ধূ মরুভূমিতে শস্য-শ্যামল কৃষিক্ষেত! যেভাবে অসাধ্যসাধন করেছিলেন রাজা গঙ্গা সিং!
Raja Ganga Singh: রাজা গঙ্গা সিং ঠিক করলেন, পঞ্জাবের সাতলেজ বা শতদ্রু নদী থেকে জল আনানো হবে বিকানেরে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন দেড়শ কিলোমিটার লম্বা একটি খালের
রাজস্থান অর্থাৎ রাজাদের স্থান। রাজস্থানের বিকানের থেকে আপনি যদি শ্রীগঙ্গানগর বা হনুমানগড়ের দিকে যান তাহলে আপনার সঙ্গে সঙ্গে চলবে একটি সুবিশাল মরুভূমি। থরের এই মরু অঞ্চলে কিছু বিশেষ পোকামাকড়, সাপ এবং ক্যাকটাস ছাড়া অন্য প্রাণীর বেঁচে থাকা মুশকিল। গরমকালে আপনি এই মরুভূমিতে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তবে আপনি যদি আরও ১০০ কিলোমিটার এগিয়ে যান তাহলে দেখবেন এক চমৎকার। খেজুর-বাবলা পেরিয়ে আপনার চোখের সামনে ফুটে উঠবে সুবিশাল শস্য-শ্যামলা ধানক্ষেত। আপনার দেখে মনে হবে আপনি হয়তো কোনও জাদুবলে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসেছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, জায়গাটি রাজস্থানেই। এই শস্য-শ্যামলা ধানক্ষেতের পিছনে রয়েছে এক রাজার দূরদর্শিতা। উত্তর ভারতে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘রেগিস্তান মে ফুল খিলানা’। খুব কঠিন বা প্রায় অসম্ভব কোনও কাজের ক্ষেত্রে এই প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়। আজকে আপনাদের যে রাজার গল্প শোনাব সেই রাজা ‘রেগিস্তানে’ ক্ষেতের পর ক্ষেত ধান চাষ করে দিয়ে গেছেন।
যে শ্রীগঙ্গানগরের কথা বলছি, ইতিহাসবিদদের মতে এটি হরপ্পা সভ্যতার অন্তর্গত ছিল। শোনা যায়, এখান দিয়েই বয়ে গিয়েছিল সরস্বতী নদী যা জল জোগাত এই অঞ্চলটিকে। জলের প্রাচুর্য থাকায় ভালোই চাষাবাদ হত এই অঞ্চলে। তবে সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাওয়ার পর, মরুভূমি গ্রাস করে অঞ্চলটিকে। একদা শস্য-শ্যামলা শ্রীগঙ্গানগর হয়ে যায় প্রাণহীন মরুপ্রান্তর। তবে এই অঞ্চলের ভাগ্য বদলে দেন এক রাজা, বিকানেরের রাজা গঙ্গা সিং। ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ পত্তন হয় বিকানের সাম্রাজ্যের। সেই সময় যোধপুরের মহারাজ রাও যোধার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় রাজপাট ছেড়ে বেরিয়ে আসেন বড় রাজকুমার রাও বিকা। তিনি নিজের জন্য একটি শহর বানান এবং তার নাম দেন বিকানের। সেখানেই নিজের রাজধানী স্থাপন করেন তিনি। এরপর কয়েকশো বছর তাঁরই বংশধররা শাসন করেন বিকানের। ১৮০৫ সালে হনুমানগড়কেও বিকানের সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসা হয়। সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়িক কেন্দ্র ছিল বিকানের। মুলতান থেকে দিল্লি, এই সুবিশাল পথে বিকানেরের মতো এত বড় বাজার আর কোথাও ছিল না। তবে ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে বিকানের। সেই সঙ্গেই তাঁদের সেই রাজকীয় জৌলুসও হারিয়ে যায়।
আরও পড়ুন- যাযাবর, অচ্ছুৎ, ‘আধা-বেশ্যা’! যেভাবে বাঁচে রাজস্থানের কালবেলিয়ারা
এমতাবস্থায় ১৮৮৮ সালে বিকানেরের রাজা হন ১৮ বছর বয়সী তরুণ গঙ্গা সিং। ঘটনাচক্রে সেই বছরই গোটা পশ্চিম ভারতে এক ভয়ানক খরা দেখা দেয়। তার প্রকোপ এতটাই ভয়ানক যে বিকানেরের প্রায় কুড়ি শতাংশ মানুষ মারা যান সেবার। এত ভয়াবহতা দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন গঙ্গা সিং। ঠিক করেন, এমন কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আর কখনও এমন দুরাবস্থায় পড়তে না হয় মানুষকে। বলতে বা ভাবতে যতটা সহজ লাগছে বাস্তবে ততটাই কঠিন ছিল কাজ। বিকানেরের অধিকাংশ আনাজ আসত বাইরের রাজ্য থেকে। অধিকাংশ জমিই অনুর্বর। এহেন একটি রাজ্যের মানুষের পেট তখনই ভরা যাবে যদি তাঁরা নিজেরাই নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করতে পারেন। তবে চাষবাস করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জলের। মরুভূমির মধ্যে জল পাওয়া দুষ্কর। রাজা গঙ্গা সিং ঠিক করলেন, পঞ্জাবের সাতলেজ বা শতদ্রু নদী থেকে জল আনানো হবে বিকানেরে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন দেড়শ কিলোমিটার লম্বা একটি খালের। একই সঙ্গে পাঞ্জাবের ভাগলপুর রাজবংশের থেকেও অনুমতি দরকার। তবে গঙ্গা সিংয়ের এই প্রস্তাব শুনে প্রথমেই তা নাকচ করে দেয় ভাগলপুর। কোনও রাজ্যই অন্য রাজ্যকে সেই সময় জল দিতে চাইত না। অপরপক্ষে, ১৮৮৫ সালে এরকম ধরনেরই একটি খাল বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তা সম্পূর্ণ বিফল হয়। এত বাধা সত্ত্বেও দমে যাননি রাজা গঙ্গা সিং।
১৯০৩ সালে দেশে-বিদেশের বিভিন্ন বড় বড় ইঞ্জিনিয়ারদের ডেকে সার্ভের কাজ শুরু করে দেন গঙ্গা সিং। একই সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনা সভায় পঞ্জাব সরকার এবং ভাগলপুর রাজ পরিবারের পক্ষ নিয়ে কথা বলা শুরু করেন তিনি। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এল সেই সুবর্ণ সুযোগ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিকানেরের সেনারা লড়েছিল ইংরেজদের হয়ে। ইংরেজরা খুব খুশি ছিলেন রাজা গঙ্গা সিংয়ের উপর। তিনি ইংরেজদের তৈরি ইম্পেরিয়াল ওয়ার ক্যাবিনেটের অংশও ছিলেন। ১৯১৯ সালে স্বাক্ষরিত ভার্সাইয়ের চুক্তিতে সই করা অন্যতম ভারতীয় রাজাও ছিলেন তিনি। চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইংরেজরা রাজা গঙ্গা সিংকে খাল বানানোর অনুমতি দিয়ে দেয়। পঞ্জাব সরকার, ভাগলপুর রাজবংশ এবং বিকানের রাজবংশের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঠিক হল, পঞ্জাবের ফিরোজপুর থেকে রাজস্থানের বিকানের পর্যন্ত ১৫৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি খাল বানানো হবে। খালের পাশাপাশি মাল আনা নেওয়ার সুবিধার জন্য ওই পথ বরাবর একটি রেললাইনও নির্মাণ করা হয়।
১৯২৫ সালে এই প্রকল্পটি শুরু হয়। সেই সময় এই খালটি নির্মাণ করতে খরচা হয়েছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা! দু'বছর সময় লেগেছিল সবটা তৈরি হতে। ২১ নভেম্বর, ১৯২৭ উদ্বোধন করা হয় খালটির। যেহেতু মহারাজা গঙ্গা সিংয়ের উদ্যোগেই এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল, তাই খালটির নাম দেয়া হয় ‘গঙ্গা নহর’ বা Ganga Canal। আগে যেখানে ধূ ধূ মরুভূমি ছিল, সেখানে কয়েক বছরে গজিয়ে উঠল শস্য-শ্যামলা ধানক্ষেত। এরপর ১৯৩১ সালে এই গঙ্গা নহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটি আস্ত শহর যার নাম শ্রীগঙ্গানগর। রেললাইন তো ছিলই, এবার তার সঙ্গে তৈরি হল স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল। পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন অংশ থেকে চাষিরা এসে বাসস্থান গড়ে তুললেন শ্রীগঙ্গানগরে। জনমানবহীন মরুপ্রান্তর পরিণত হল জমজমাট জনবসতিতে।
আরও পড়ুন- তিনি না থাকলে জানাই হত না সমুদ্র তলদেশকে! প্রথম মহিলা ভূতত্ত্ববিদের লড়াই আজও অন্তরালে
মহারাজার ইচ্ছে ছিল যেভাবে বিকানের জল পেল ঠিক সেভাবেই যেন রাজস্থানের অন্যান্য অংশেও পৌঁছে যায় জল। সেই লক্ষ্যে ১৯১৯ সালেই তিনি বানিয়েছিলেন ভাকরা-নাঙ্গাল প্রকল্পের ব্লু প্রিন্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করতে পারেননি। এরপর বহুবার চেষ্টা করেও বিফল হন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছিল মহারাজা গঙ্গা সিংয়ের স্বপ্নের ভাকরা-নাঙ্গাল প্রকল্প। ১৯৬৩ সালে তৈরি হয় এটি। দুর্ভাগ্যবশত, তা দেখে যেতে পারেননি মহারাজা গঙ্গা সিং। ১৯৪৩ সালেই গলার ক্যান্সারের কারণে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন তিনি। শোনা যায়, মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তেও তিনি তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, “ভাকরা-নাঙ্গালের ফাইলটা নিয়ে এসো।”