'মেয়েছেলে' চাকরি করছে মানেই বসের সঙ্গে শুতে যাচ্ছে?

Male Gaze at Women: এশিয়ার যে সমস্ত দেশে মেয়েরা উচ্চশিক্ষিত, চাকুরে এবং স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে, সেই দেশগুলোতে পুরুষেরা তত বেশি নারীবিদ্বেষী হয়ে উঠেছে।

কফি খাওয়ার সহজ উপায়

ধরা যাক, আপনার কফি খেতে ভালো লাগে। আপনি প্রায়দিনই কফি খান। ধরুন, কোনও একদিন আপনার কফি খেতে ইচ্ছে হলো না। কফি বিক্রেতা বললেন, “আপনি প্রায়দিনই কফি খান। আজ আপনি কফি খাবেন না বললে কী করে হবে? কফি আপনাকে খেতেই হবে!”

কিংবা ধরুন আপনি বললেন, “বাহ! এই কফিশপে কফিটা তো ভালোই বানায়। আবার কাল একবার আসা যাক।" কিন্তু কোনও কারণে পরের দিন আপনার কফি খেতে ইচ্ছে হলো না। সে যে কারণেই হোক কিন্তু সেই ক্যাফের ঠ্যাঁটা কফি বিক্রেতা এসে আপনাকে বললেন, “আপনি কফি খাবেন না মানে? গতকালই তো বলেছিলেন আজ কফি খাবেন। আজ কফি খাব না বললে কী করে হবে? কফি আপনাকে খেতেই হবে।" আপনি আমতা আমতা করে বললেন, “আরে, সে তো আমি গতকাল বলেছিলাম। আজ আমার ইচ্ছে তো না-ই হতে পারে।" কফি বিক্রেতা দ্বিগুণ ঝাঁঝিয়ে বললেন, “খাবেন না মানে? আপনি কাল কফি খাবেন বলেছিলেন যখন, আজ কফি খেতেই হবে।"

আচ্ছা ধরা যাক, আপনি একটি ক্যাফেটেরিয়াতে কফি খেতেন এক সময়ে। কিংবা দীর্ঘদিন আগে কোনও এক বর্ষার সন্ধ্যায় কফি খেয়েছিলেন আয়েশ করে। যে কারণেই হোক, সেখানে আর আপনি কফি খান না। দীর্ঘদিন বাদে এসে, সেই কফি বিক্রেতা আপনাকে কফি খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে লাগলেন। আপনি প্রত্যাখ্যান করলেন সসম্মানে। কিন্তু কফিওয়ালা নাছোড়। প্রত্যাখ্যান শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, “আপনার সঙ্গে আমাদের কফিশপের সম্পর্ক কি নতুন?” হুমকি দিলেন, “আগেও তো কফি খেয়েছেন এখানে এসে! কফি আপনাকে খেতেই হবে। নইলে আমি রাষ্ট্র করে দেব যে, আপনি আমার ব্যবসা নষ্ট করেছেন।”

এবার বলুন তো, আপনার কেমন লাগবে? আপনার মনে হবে না, আপনার পছন্দ-অপছন্দকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হচ্ছে না? আপনার তো অধিকার রয়েছে, “আজ কফি খাব না”, “আমি কফি খাব না”, কিংবা “আপনার কফিশপে কফি খাব না” এই কথাগুলো বলার। সত্যি বলতে এরকম কোনও বেয়াড়া দাবি কোনও কফিবিক্রেতাই করেন না। সেক্ষেত্রে ব্যবসায় বিশাল লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তর্কের খাতিরেই বলছি, ধরুন এরকমই কোনও ঘটনা আপনার সঙ্গে ঘটল। সেক্ষেত্রে আপনার কফি না খাবার ইচ্ছে একটি শব্দে প্রকাশ করলেই, অর্থাৎ 'না' বললেই কফিবিক্রেতার আপনার কফি খাবার অসম্মতিকে সম্মান দেওয়া উচিত, আর একটি কথাও না বাড়িয়ে।
সম্মতি বিষয়টি এতটাই সাধারণ। এতটাই সোজাসাপ্টা। যৌনমিলনের ক্ষেত্রেও তাই। অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও আপনি কাউকে স্পর্শ করলে তা কিন্তু যৌন হয়রানি বলেই গণ্য হবে। যৌন হয়রানি যে কেবল শরীর স্পর্শ করলেই হবে, এমনটা নয়। কাউকে দূর থেকে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি দেখানো, পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আপত্তিকর কথা ছুঁড়ে দিয়ে চলে যাওয়া, লোলুপ চাহনি দিয়ে তাকানো, তাঁর শরীরের দিকে তাকিয়ে তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলাও যৌন হয়রানির সমার্থক। একজন ব্যক্তিকে যৌন ইঙ্গিত দেওয়া, তাঁর অনুমতি ছাড়া কিংবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও যৌন বার্তা পাঠানোও যৌন হয়রানি ছাড়া অন্য কিছু নয়। সেই বার্তার মাধ্যম শব্দ, ছবি, ভিডিও এবং অডিও যাই হোক না কেন, সমস্যা এবং অপরাধ একই থাকবে।

কোনও মহিলা অনিচ্ছুক থাকা সত্ত্বেও আপনি তাঁর ব্যক্তিগত অঙ্গে হাত বা শরীরের যে কোনও অঙ্গ স্পর্শ করালে তা শ্লীলতাহানি। কারও অসম্মতিতে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে আপনি যদি শারীরিকভাবে লিপ্ত হন, তাকে বলে ধর্ষণ। ধর্ষণ মানে কেবল জোরপূর্বক কারও যোনিতে লিঙ্গ প্রবেশ করানো নয়। একজন ব্যক্তির অনিচ্ছায়, তাঁর অসম্মতিতে তাঁর পায়ু ও মুখে যৌনাঙ্গ, আঙুল, এমনকী যে কোনও বস্তু প্রবেশ করালেও তা ধর্ষণ বলেই গণ্য হবে। খেয়াল রাখবেন এখানে 'অসম্মতি', 'অনিচ্ছা' এবং 'ইচ্ছের বিরুদ্ধ' শব্দগুলির স্পষ্ট ব্যবহার রয়েছে।

একজন মহিলা যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, যাই করুন না কেন, আপনি ধরে নিতে পারেন না যে তিনি যৌনমিলনে সম্মতি জানাচ্ছেন। আর তা নিজের মতো আন্দাজ করে নিয়ে আপনি তাঁর শরীর স্পর্শ করতে পারেন না। একজন মহিলা বা পুরুষ যদি সরাসরি 'না' বলেন বা তিনি যদি যৌন মিলনে অসম্মতি প্রকাশ করেন, সরে আসুন। তিনি যদি 'হ্যাঁ' বলেন, পারস্পরিক সম্মান বজায় রেখে এগিয়ে যান। মনে রাখবেন, অপরদিকের মহিলা বা পুরুষটি আপনার আহ্বানে সাড়া না দিলে, বা অসম্মতি জানালে তিনি কেন আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন বা কেন অসম্মতি জানালেন, তার ব্যাখ্যা দেওয়ার কোনও দায়ও সেই নারী বা পুরুষের নেই। কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় হ্যাঁ বা না বলার মাঝেও অনেক কথা রয়ে যায়। ধরুন একজন মহিলা বা পুরুষ – তিনি হতে পারেন আপনার স্ত্রী বা স্বামী, জানালেন যে তিনি আপনার সঙ্গে যৌন মিলনে লিপ্ত হবেন কিনা, সেই বিষয়ে মনস্থির করে উঠতে পারেননি। সেক্ষেত্রেও আপনাকে 'হ্যাঁ' বা 'না' শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে এগিয়ে না গিয়ে। একজন মহিলার পোশাক, তাঁর মদ বা ধূমপান, তাঁর একা চলাফেরা করা, তাঁর চাকরি করতে বেরনো, তাঁর বিয়ে না করে বা সম্পর্কে না গিয়ে একা থাকার সিদ্ধান্ত কোনওটাই কিন্তু সম্মতির লক্ষণ নয়।

আরও পড়ুন- দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অপেক্ষায় প্রহর গুণছি

“কিন্তু ও তো আমার স্ত্রী”

এই আলোচনায় যাওয়ার আগে, একবার মনে করে নিন ধর্ষণের সংজ্ঞা কী। যে কোনও ব্যক্তির সঙ্গে জোরপূর্বক, তাঁর সম্মতির বিরুদ্ধে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়াই ধর্ষণ। হতে পারে সেই ব্যক্তি আপনার স্ত্রী বা প্রেমিকা, স্বামী কিংবা প্রেমিক। সেই ব্যক্তির সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা গভীর, ঘনিষ্ঠতা কত দীর্ঘদিনের তা এখানে অনাবশ্যক। আপনার স্ত্রী বা আপনার প্রেমিকা আপনার সম্পত্তি নয়। তিনি আপনার স্ত্রী বা প্রেমিকা মানেই তাঁর দায় নেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে আপনার সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত হওয়ার। ঠিক একই কথা খাটে স্বামীদের ক্ষেত্রেও। আপনার স্বামী বা প্রেমিকেরও সম্পূর্ণ অধিকার আছে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আপনার সঙ্গে যৌনতায় লিপ্ত না হওয়ার। বিয়ে বা সম্পর্ক সুস্থভাবে একসঙ্গে থাকার অঙ্গীকার। সুখের দিনে, বিপদের সময়ে পাশাপাশি থাকার প্রতিশ্রুতি। বিয়ে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে যৌনতায় লিপ্ত হওয়ার অঙ্গীকার নয়। না তো তা সম্মতি লঙ্ঘনের দাপ্তরিক লাইসেন্স। বিয়ে যৌনবস্তু বা যৌনভৃত্য হওয়ার প্রতিশ্রুতি নয়। বিয়েতে বা একটি সম্পর্কে থাকাকালীন ঘনিষ্ঠতা হওয়া স্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যকর বিষয়। সেই ঘনিষ্ঠতার অনেকটাই খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘটে কিন্তু সেই শারীরিক ঘনিষ্ঠতায় কোনও এক পক্ষ যদি অসম্মতি প্রকাশ করে, তার ইচ্ছেকে সম্মান জানান। এখানে উল্লেখ্য, কেউ আপনার সঙ্গে কোনও এককালে যৌনতায় লিপ্ত হয়েছিল মানেই আপনি তাঁকে জোর করতে বা বাধ্য করতে পারেন না আপনার সঙ্গে আবার যৌনতায় লিপ্ত হতে। কেউ আজ আপনাকে সম্মতি দিয়েছে মানে ভবিষ্যতেও সেই সম্মতি বহাল থাকবে কিংবা আপনি তাঁকে যখন খুশি যৌনবার্তা পাঠাতে পারেন বা যৌনইঙ্গিত দিতে পারেন, এমনটাও নয়।

“খিদে পেলে তো মানুষ সামনে যা পাবে, তাই খাবে"

যৌনতা, যৌন চাহিদা কিংবা যৌন উত্তেজনা খুব স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু ধর্ষণ মানেই সেখানে নিজের জোর খাটানো। নিজের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। কেউ তর্ক করে এখানে বলতেই পারেন, “খিদে পেলে মানুষ তো খাবেই।" যদিও খিদের জ্বালা আর ধর্ষণ এই দু’টির তুলনা করা মানে আপেলের সঙ্গে আলুর তুলনা করা, কমলালেবুরও নয়। তবুও একটু পাখিপড়া পড়ানো যাক। কিছু অতিসাধারণ কথা বলা যাক। প্রথমত, পেটের খিদে খুব প্রাথমিক চাহিদা। খাদ্য বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজন। খিদের জ্বালা অসহনীয়। যৌনতা, ধর্ষণ কিন্তু কোনও প্রাথমিক জৈবনিক ও জৈব চাহিদা নয়, যা না পেলে মানুষের প্রাণনাশ হবে। দ্বিতীয়ত, খিদে পাওয়া খুব স্বাভাবিক বিষয়। নিজেকে প্রশ্ন করুন, খিদে পেলে আপনি কি জোর করে কারও খাবার কেড়ে খান? কেউ হয়তো বলবেন, খিদে পেলে মানুষ চোখের সামনে যা পাবে তাই তো খাবে। তাহলে খিদে পেলে কি আপনি বিষ খান? কিংবা একটু অ্যাসিড, ফিনাইল, বাথরুম সাফ করার তরল? খান?

ধর্ষণকে লঘু করে দেখার পর্ব মিটে গেলে শুরু হয় 'ভিক্টিম ব্লেমিং' ও 'ভিক্টিম শেমিং'। যার সোজাসাপ্টা অর্থ হলো, ধর্ষণের জন্য ধর্ষিতার দিকেই আঙুল তোলা। সে ধর্ষিতা হয়েছে, তাই দোষ তারই। “ধর্ষণ হওয়ার সময় আপনি কী পরেছিলেন?”, “আপনার শরীরের কতটা অংশ সেদিন দেখা যাচ্ছিল?”, “ড্রিংক করেছিলেন? কতটা?”, “রাত করে বাড়ি ফিরেছিলেন নিশ্চয়ই!”, “অবশ্যই তোমার দোষ!”, “অচেনা পুরুষের সঙ্গে কথা কেন বলেছিলে? তার মানে নিশ্চয়ই তোমার ইচ্ছে ছিল।", “আগে থেকে চেনাশোনা ছিল?”, “ধর্ষণের আগে তোমার ধর্ষকের দিকে তাকিয়ে হেসেছিলে? কেন? নিশ্চয়ই তোমার ইচ্ছে ছিল।", “সবার বাড়িতেই এরকম দু’একজন আত্মীয় থাকে। এই নিয়ে এত কথার কী আছে?”

বিরক্তি আসছে পড়তে? বিশ্বাস করুন, আমাদেরও আসে বিরক্তি। আপনাদের ওপর। আপনারা ক্লান্ত হন না একই প্রশ্ন সব ক্ষেত্রে করতে? আপনাদের লজ্জা লাগে না? আপনাদের একবারও মনে হয় না, পরিস্থিতি যাই হোক, ধর্ষণ অন্যায়? ধর্ষণ করে খুন না করে ফেলা অবধি আপনারা ধর্ষকের দিকে আঙুল তোলেন না। যেন খুনটা করেই অন্যায় করে ফেলেছে, তার আগে অবধি যা করেছে সেটুকু ঠিকই ছিল। ধর্ষক যখন আড়াই মাসের শিশুকে ধর্ষণ করে, তখন কী বলেন? “শিশুটি জন্মেছিল, নিশ্চয়ই ধর্ষিত হওয়ার ইচ্ছে ছিল।" বলেন? একজন পুরুষ যখন মৃতার শরীর ধর্ষণ করে, কী বলেন তখন? আর ষাট বছরের বৃদ্ধা? কিংবা রাস্তার সারমেয়? খামারের ছাগল? পোশাক, নারীর মদ্যপান, ধূমপান, রাত করে বাড়ি ফেরা যদি ধর্ষণের কারণ হয়, তাহলে বাকি যা যা উদাহরণ দিলাম, সেই ক্ষেত্রগুলোতে ধর্ষণের কারণ কী? জবাব আছে? খুনের পরে নিহতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “রাত করে বেরিয়েছিল লোকটা। নিশ্চয়ই মরার ইচ্ছে হয়েছিল!” বলেন না তো!

“For anybody whose once normal everyday life was suddenly shattered by an act of sexual violence– the trauma, the terror, can shatter you long after one horrible attack. It lingers. You don’t know where to go or who to turn to…and people are more suspicious of what you were wearing or what you were drinking, as if it’s your fault, not the fault of the person who assaulted you…We still don’t condemn sexual assault as loudly as we should. We make excuses, we look the other way…[Laws] won’t be enough unless we change the culture that allows assault to happen in the first place.” - President Barack Obama, September 2014

মহিলারা রাত করে বেরোলেই যদি ধর্ষণ হয়, তাহলে মহিলাদের জন্য দিনগুলোও নিরাপদ তো? তাহলে কেন দিনের বেলা রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রামে একজন মহিলার শরীরের ব্যক্তিগত স্থানে অযাচিত স্পর্শ ধেয়ে আসে? বাড়ির বাইরেটা মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়। তাহলে তার নিজের ঘর, যা কিনা তাঁর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হওয়ার কথা, সুখ-দুঃখের দিনে নিশ্চিন্ত ঠাই হওয়ার কথা– সেই বাড়ি তার জন্য ঠিক কতটা নিরাপদ?

মহিলাদের মদ্যপান, ধূমপান করতে দেখলেও আপনাদের যৌনবাসনা জেগে ওঠে? কীভাবে? কেন? পুরুষরা একই কাজ করলে তো সেই ইচ্ছে জাগে না! নাকি নারী 'পুরুষদের মতো' করে আনন্দ করলে মনে হয় একজন 'মেয়েছেলে' কেন আনন্দ করবে 'আমাদের মতো'? 'মেয়েছেলে' খুব উড়ছে! ওর ডানা ছেঁটে দেওয়া দরকার। দেখিয়ে দিতে হবে কেন 'মেয়েছেলের' বেশি ওড়া উচিত নয়। একইরকম আক্রোশ একজন মহিলা চাকরি করতে বেরোলেও হয়। কারণ আপনারা ভেবেই নেন, 'মেয়েছেলে' চাকরি-বাকরি করছে মানেই বস বা কলিগের সঙ্গে শুতে যাচ্ছে। তাঁর নিজের কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতা, ডিগ্রি বা দক্ষতা নেই, যা দিয়ে সে পয়সা অর্জন করে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হবে।

ধর্ষণের কারণের পাশে মেয়েদের রোজগারের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হলো বলে, রে-রে করে তেড়ে আসার আগে একটা মজার কথা বলি। 'দ্য ইকোনমিস্ট'-এ ২৭ জুন প্রকাশিত একটি খবর বলছে, এশিয়ার যে সমস্ত দেশে মেয়েরা উচ্চশিক্ষিত, চাকুরে এবং স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে, সেই দেশগুলোতে পুরুষেরা তত বেশি নারীবিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। হয়ে উঠছে নারীবাদ-বিরোধীও। আর তা যত প্রকট হবে, মেয়েদের প্রতি কটুক্তি, মানসিক আক্রমণও শুরু হবে,  শুরু হয়েও গেছে। ক্রমেই তা শারীরিক ও যৌন আক্রমণের দিকে যাচ্ছে।

ভারতের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রকের ২০২১-২০২২-এর মধ্যে করা এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে ভারতে মহিলা কর্মজীবীদের সংখ্যা বেড়ে ৩২.৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর সমীক্ষা বলছে, ২০২২ সালে মহিলাদের উপর ৪.৪৫ লক্ষেরও বেশি লিঙ্গ-ভিত্তিক অপরাধের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তার মধ্যে ১৮.৭ শতাংশ শ্লীলতাহানির ঘটনা। ৭ শতাংশ ঘটনা ধর্ষণের। এদিকে ২০২০ সালের পর থেকে ভারতবর্ষে আবারও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। সোজা কথায়, এদেশে চাকুরিরতা মেয়েদের সংখ্যার পাশাপাশি ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েছে। দু’টি ঘটনা হয়তো একটি আরেকটির কারণ নয় কিন্তু এদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষত, যদি 'দ্য ইকোনমিস্ট'-এর প্রতিবেদনের কথা মাথায় রাখি।

এখানে উল্লেখ্য, ৪.৪৫ লক্ষ সংখ্যাটা কেবল দায়ের করা অভিযোগের সংখ্যা। আসল সংখ্যাটা তার বহুগুণ বেশি। কারণ, এদেশে একজন মহিলাকে ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের করার আগেও দশবার ভাবতে হয়। থানায় অভিযোগ করতে গেলে সবার আগে পুলিশই 'ভিক্টিম ব্লেম' করে। সোজাসাপ্টা ভাবে কিংবা ঘুরিয়ে মেয়েটিকেই 'বেশ্যা' বলে দাগিয়ে দেয় খোদ আইনের রক্ষকরা। এফআইআর দায়ের করতে গেলেও তা নেওয়া হয় না।

সারা পৃথিবীতে প্রতিটি মেয়ে জীবনের কোনও না কোনও সময়ে অন্তত একবার শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের শিকার হন। ভারতবর্ষেও তাই। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে গড়ে প্রতি ৫১ মিনিটে অন্তত একজন মহিলা লিঙ্গ-ভিত্তিক অপরাধের অভিযোগে এফআইআর করেছেন। আশা করি এবার বুঝতে পারছেন, মেয়েরা স্বাধীনচেতা হয়ে উঠলে পুরুষের কেন বিদ্বেষ জেগে ওঠে? আসলে সমাজ বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে বুঝিয়ে এসেছে, একজন মেয়ের সম্মান তাঁর যোনিতে গোঁজা থাকে। তাই এখনও একজন অবিবাহিত মেয়ের সামাজিক অবস্থান, মান-মর্যাদা, পারিবারিক মান-মর্যাদা মাপা হয় তাঁর সতীত্ব দিয়ে। বিয়ে করলেই তাঁর সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদা বেড়ে যায়। আর যদি সে বিয়ের আগে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয় কিংবা ধর্ষিত হয়, ওমনি সমাজ ও পরিবার তাঁকে কালিমালিপ্ত করে। একটি মেয়ে স্বাধীনচেতা হলেই, স্বনির্ভর হলেই পুরুষের ইচ্ছে হয় তাঁকে দমন করা প্রয়োজন। যেহেতু আপনারা মনে করেন, যোনিতেই তাঁর সমস্ত সম্মান প্রোথিত তাই ধর্ষণ করে নিজের 'পুরুষত্ব' জাহির করতে পারলে, ক্ষমতার প্রকাশ করতে পারলেই মেয়েকে যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে ফেলা যাবে। যেন তাঁর সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন, ইচ্ছে, স্বপ্ন, বেঁচে থাকা সেখানেই শেষ করে ফেলা যাবে চিরতরে। আর ধর্ষণ, নারীর প্রতি যৌন আক্রমণ, পান থেকে চুন খসলে তাঁকে যৌনায়িত করার যে প্রবৃত্তি, তা তো পুরুষের ভেতরে চেপে রাখা নিকষ কালো বিদ্বেষ প্রকাশের মাধ্যম ভিন্ন আর কিছু নয়। সেই কারণেই আজও গ্রামে সালিশি সভায় মেয়েদের শাস্তি হিসেবে তাঁদের নগ্ন করে পাড়া ঘোরানোকেই বেছে নেওয়া হয়। নগ্ন সে নিজে থেকে তো হয় না, শরীরের পোশাক কেড়ে নেওয়ার জন্য কিছু নারী-পুরুষ উপস্থিত থাকেনই। আজও সালিশি সভায় শাস্তিস্বরূপ মহিলাকে ধর্ষণের নিদান দেওয়া হয়।

শুধু মহিলারা স্বাধীনচেতা হলেই যে তাঁদের উপর বিদ্বেষের খাঁড়া নেমে আসে, তা নয়। এদেশে, একজন উঁচুজাতের মহিলার তুলনায় দলিত এবং আদিবাসী মহিলাদের ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির শিকার হওয়ার হার তুলনামূলক ভাবে বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের উপর যৌনহিংসা ধেয়ে আসে উঁচু জাতির পুরুষদের থেকে। কেন? কারণ সেই পুরুষরা চায়, ক্ষমতার জোরে দলিত বা আদিবাসী মেয়েটিকে সমাজে তাঁর 'স্থান' দেখিয়ে দিতে। আর ক্ষমতার জোর মানেই ধর্ষণ। অর্থাৎ ঘুরেফিরে সেই ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ, বিষাক্ত পৌরুষের বহিঃপ্রকাশ, বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ।

আরও পড়ুন- প্রতি ৩ জনে ১ জন ডাক্তারই অনিরাপদ! হাসপাতালের ভয়াবহ পরিস্থিতি ফাঁস সমীক্ষায়

“চুড়ি পরে বসে থাকুন”

“আবার একটা মেয়েছেলে জন্মেছে!”, “মেয়ের জাত। ওদের বুদ্ধি কম।", “মেয়েছেলে মেয়েছেলের মতো থাক!”, “মেয়েছেলের আবার চাকরি করার কীসের দরকার?”, “চুড়ি পরে বসে থাক।"

নারীবিদ্বেষের শুরু কোথায়? উত্তরটা খুব সোজা। নারীবিদ্বেষের বীজ এই শব্দগুলোয় পোঁতা। নারীবিদ্বেষ আর পুরুষতন্ত্র একে-অপরের হাত ধরে চলে। আর এখানেই লুকিয়ে রয়েছে রেপ কালচারের জন্মের ইতিহাস। মেয়েদের জন্য ব্যবহার করা এই শব্দগুলো, এই বিদ্বেষের বীজ যুগের পর যুগ, কালের পর কাল এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে গেছে। এই কথাগুলো একঘেয়ে মন্ত্রের মতো শুনতে শুনতে মেয়েরাই কখন নিজেদের মধ্যে আপ্ত করে নেয়, এক মেয়েই আরেক মেয়েকে বলতে আরম্ভ করে, পুরুষ তো কোন ছাড়।

এই বিদ্বেষের বীজ, পুরুষতন্ত্রের বীজ পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যেই কখন যেন প্রোথিত করে দেয় সমাজ। সেই বীজ থেকে জন্মানো চারা সযত্নে লালিত-পালিত হয়ে একদিন মহীরূহে পরিণত হয়। কী লাগে তাকে লালন-পালন করে বড় করতে? মেয়েরা এটা করবে না, মেয়েরা ওটা করবে না। বাড়ির পুরুষের জন্য তোলা থাকবে মাছের মুড়ো, গরুর ঘন দুধ। মেয়েদের জন্যে তুলে রাখা থাকবে হাঁড়ির কোণার সামান্য ভাত। একটু বড় হলে সেই মেয়ের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হবে বক্রোক্তি, অশ্লীল শব্দ। রাস্তায় বেরোলে দেখানো হবে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি। নারীবিদ্বেষের বীজ যখন মহীরূহের আকার নেয়, সে তো আসলে মহীরূহের রূপে আসে না। আসে যৌনহিংসা, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণের রূপে।

আরজি করের ঘটনায় কলকাতা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ছিল প্রথম থেকেই। প্রশ্ন আছে পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে। প্রশ্ন থাকবে পুলিশের দ্বারা শাসকদলের পদলেহন নিয়েও। প্রশ্নগুলো করা একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার কর্তব্য। কিন্তু কলকাতা পুলিশের অপারগতা বোঝাতে, পুলিশের শাসকদলের চোখ রাঙানিকে ভয় পাওয়াকে প্রকাশ করতে একটি ছবি সমাজমাধ্যমে নিরন্তর ঘুরছে বেশ কয়েকদিন যাবৎ। অক্ষয় কুমার পুলিশের উর্দি পরে রয়েছেন। তাঁর হাতে একগাছা লাল চুড়ি। সম্প্রতি ‘ছাত্র সমাজ'-এর নবান্ন অভিযানের একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যাচ্ছে বৃদ্ধ এক 'ছাত্র' পুলিশের ছোড়া প্রবল শক্তিশালী জলকামানের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছেন। পুলিশকে হাতের ইশারায় বোঝাচ্ছেন, “চুড়ি পরে বসে থাকুন”। এই কথাটি অবমাননাসূচক অর্থে বোঝানো হয়। যার গভীরে লুকিয়ে আছে নারী বিদ্বেষ। নারীকে ছোট করার প্রয়াস। ধর্ষণের মতো নারীবিদ্বেষী ও পুরুষতান্ত্রিক ঘটনার প্রতিবাদ করতে রাজনৈতিক দল ও মত নির্বিশেষে যখন নারীবিদ্বেষ ও পুরুষতন্ত্রকেই হাতিয়ার করা হয়, তখন সেই সমাজের প্রতি কী প্রত্যাশা রাখা উচিত?

সমাজ নারীকে অবলা বলে দাগিয়ে দিয়েছে। আজ সারা বিশ্বে কয়েকটি উপজাতির পুরুষ ভিন্ন কেবল নারীরাই চুড়ি পরে। চুড়ি তাই দুর্বলতার প্রতীক। সমাজ বলে দিয়েছে, পুরুষ দুর্বল হতে পারে না। পুরুষ চোখের জল ফেললে সে মেয়েলি। আর পুরুষকে মেয়েলি বললে পুরুষের 'পৌরুষে' লাগে। নারী সাহস দেখালে, শত আঘাতেও ভেঙে না পড়লে তাকে বাহবা দিয়ে বলা হয়, 'পুরুষের মতো'। আর পুরুষ দৌর্বল্য দেখালে তাঁকে ছোট করে বলা হয় 'মেয়েছেলের মতো'। যে পুরুষতন্ত্র শিখিয়েছে 'মেয়েছেলের' চাকরি করার দরকার নেই, তাঁর স্বনির্ভর হওয়ার প্রয়োজন নেই, সেই পুরুষতন্ত্রই শিখিয়েছে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব কেবল পুরুষের। যে পুরুষতন্ত্র নারীকে দমন করতে শিখিয়েছে, সেই পুরুষতন্ত্রই বলেছে, 'ব্যাটাছেলের রেপ হতে পারে না'। পুরুষতন্ত্র কেবল নারীকেই দমন করে না, তা যে পুরুষকেও নিপীড়ন করার হাতিয়ার, সে কথা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা আর কবে বুঝব?

More Articles