প্লাস্টিকের রমরমা! ভারতের 'সুন্দর গ্রাম'-কে সুন্দর রাখতে পর্যটকে 'না' বাসিন্দাদের

Kollengode, Most Beautiful Village of India: কোলেঙ্গেড়ের আনাচেকানাচে যত্রতত্র প্লাস্টিক ফেলছেন পর্যটকেরা। জায়গায় জায়গায় পড়ে পলিথিন, প্লাস্টিকের গ্লাস-প্লেট। ইতিউতি উঁকি মারছে খালি মদের বোতল।

খয়েরি পাহাড়, নীল সমুদ্র কিংবা সবুজের জঙ্গল। প্রকৃতির টানে কত দূর দূরান্তই না ছুটে যায় মানুষ। সুন্দরের লোভ তাঁর চিরকালীন। তাই সে ফুলের দিকে ছুটে যায়, শিশুর মুখ দেখলে খুশি হয়। পাখির গানে আপ্লুত হয়। আবার এই মানুষের মধ্যেই রয়েছে এক চির হিংসুটে সত্তা। যা সুন্দরকে সুন্দর থাকতে দেয় না। তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে উপড়ে না নিয়ে শান্তি নেই তার। গোটা পৃথিবীকে সে তুলে আনতে চায় নিজের আয়ত্তের মধ্যে। নিজের অঙ্গুলিহেলনে চালিত করতে চায়। কিন্তু প্রকৃতিই বা সে কথা শুনবে কেন? সে তো সর্বশক্তিমান। সে-ও তখন শোধ নেয়। গরম বাড়িয়ে দেয়। গলতে থাকে হিমবাহ। সমুদ্রে বাড়ে জলস্তর। একসময় প্রলয় আসে। তাতে ছাড়খার হয়ে যায় মানুষ, মানুষের সাজানো বাগান, ইমারত। তার পরেও তার মত্ত নেশা থামে না। সে ফের লেগে পড়ে প্রকৃতির সুন্দরকে উপড়ে আনতে।

আরও পড়ুন: হিন্দুদের পবিত্র তীর্থে মারাত্মক দূষণ! আবার কি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে চারধামের এই ধাম?

খুব বেশি দিন আগে নয়। মুক্তি পেয়েছিল জেমস ক্যামেরন পরিচালিত 'অবতার' সিরিজের দ্বিতীয় সিনেমাটি। সিরিজের প্রথম অর্থাৎ 'অবতার'-এ আমরা দেখেছি মানুষের ভয়ঙ্কর উন্নাসিকতাকে। অ্যানিমেশন ছবি 'মোয়ানা'-তেও দেখবেন,  সবুজ শ্যামল তিফেতির হৃদয় কেমন ভাবে মানুষের অত্যাচারে আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তরিত হয়। যেখানে প্রাণ ফিরিয়ে দেবে মোয়ানা নামক সেই সমুদ্রবালিকা। এ সব আমরা দেখি, শুনি, বুঝি। কিন্তু মগজে ঢোকাই না। ঠিক তার পরক্ষণেই হাতের প্লাস্টিকটি ছুঁড়ে ফেলে দিই সবুজ ঘাসে। পাহাড়ের খাঁজে জঙ্গলের ভাঁজে প্লাস্টিকের মেলা রেখে আসি। সমুদ্রের নীলে তুবড়ানো বোতলের ভেসে যাওয়া, জঙ্গলে চিপসের পরিত্যাক্ত প্যাকেট, প্লাস্টিকের গ্লাস- এসব পড়ে থাকা দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গিয়েছে আমাদের। অবশ্য চোখ সওয়ারই বা কী আছে। এমনটাই তো দস্তুর। আমরা যে থালায় খাই, সে থালাতেই ফুটো করি, এমনই 'কালীদাস' এ মনুষ্য সমাজ। তাই জন্যই তৎকালীন মার্কিন সরকারের শীর্ষ নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনও বিশ্বাসই করলেন না, উষ্ণায়ন বলে কোনও শব্দের অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে আছে।

ঠিক তেমনই অবস্থা পৃথিবীর সুন্দরতম গ্রামের। কেরলের পালাক্কড় জেলার একরত্তি গ্রাম কোলেঙ্গোড়ে। চারপাশ জুড়ে নীলচে-সবুজ পাহাড়, সারি সারি তাল-নারকেল গাছ, সবুজ ধানক্ষেত- আদর্শ পর্যটন কেন্দ্র যাকে বলে। স্বাভাবিক ভাবেই ওই এলাকার বাসিন্দাদের রুজি রোজগারের অনেকটাই নির্ভর করে পর্যটকদের আসা-যাওয়ার উপরেই। নিত্যদিন শুটিং পার্টির আনাগোনা লেগেই থাকে। মালায়লম সিনেমার জনপ্রিয়তম শুটিংস্থল এটি। দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন পর্যটকেরা সৌন্দর্যের টানে।

সম্প্রতি শিল্পপতি আনন্দ মাহিন্দা টুইটারে দশটি সুন্দরতম জায়গার একটি তালিকা ছবি-সহ পোস্ট করেছিলেন। যেখানে জায়গা পেয়েছিল কোলেঙ্গোড়ে গ্রাম। আর তার পরেই চড়চড়িয়ে জনপ্রিয়তা বেড়েছে এই গ্রামের। আশপাশের গ্রাম, জেলা এমনকী পড়শি রাজ্য থেকেও ভিড় জমিয়েছেন অনেকে কোলাঙ্গোড়ে। ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন, তাতে এলাকার বাসিন্দাদের দু-পয়সা আয়ও হয়েছে। তবে শুধু ছবি-ভিডিওতেই সীমিত থাকছেন না তারা। ব্যাপক হারে সুন্দর গ্রামকে নোংরাও করছেন। যত্রতত্র প্লাস্টিক ফেলছেন, জায়গায় জায়গায় পড়ে পলিথিন, প্লাস্টিকের গ্লাস-প্লেট। ইতিউতি উঁকি মারছে খালি মদের বোতল। সব মিলিয়ে নরক পরিস্থিতি যাকে বলে।

এ হেন পর্যটকদের জ্বালায় তিষ্টোতে পারছেন না গ্রামের লোকজন। মানুষের যা স্বভাব, তাই করছে। সুন্দরকে নষ্ট করার সমস্ত আয়োজন তাঁরা সেরে ফেলেছে। তবে ভক্ষকের ভিড়ে দু-একজন রক্ষক বরাবর থেকেছেন। যেমন আলে বুক পেতে সারারাত জল আটকে রেখেছিলেন আরুণী, যেভাবে চিপকো আন্দোলনের সময় মেয়েরা জাপ্টে ধরেছিলেন সারি সারি গাছেদের, 'জঙ্গল ছোড়ব নাহি' গানে কেঁপে উঠেছিল দিগ্বিদিক, ঠিক সেভাবেই এগিয়ে এসেছেন কোলাঙ্গোড়ে গ্রামের বাসিন্দারা। রুখে দাঁড়িয়েছেন পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে। তাতে রুজিরুটি না হয় না হবে। কিন্তু প্রকৃতিকে না বাঁচালে যে একদিন পৃথিবীটাই শেষ হয়ে যাবে তাঁরা তা বুঝেছেন।

সাধারণ ভাবে কোনও পর্যটকস্থল থেকে বেরোনোর সময়েই 'ভিজিট এগেইন' লেখা বোর্ড চোখে পড়ে আমাদের। ভারতবর্ষ 'বসুদেব কুটুম্বকম'-র দেশ, 'অতিথি দেবঃ ভব'-র দেশ। তবে প্রকৃতিকে বাঁচাতে সেই আন্তরিক পরম্পরার পথ থেকে সরে এসেছে কোলাঙ্গেড়ে গ্রাম। তাই 'থ্যাঙ্ক ইউ, ভিসিট এগেইন'-র পরিবর্তে তাঁরা গ্রামে পুঁতে দিয়েছে একেবারে প্রথাভাঙা একটি বোর্ড। যেখানে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, 'প্লিজ ডোন্ট ভিজিট এগেইন।' দয়া করে আর এ মুখো হবেন না।- কতটা বিতৃষ্ণা এবং বিরক্তি থেকে এই পদক্ষেপ করতে পারে একটি পর্যটককেন্দ্রীক গ্রাম, তা আঁচ করা যায় সহজেই। স্থানীয়দের দাবি, ধানক্ষেত থেকে পুকুর, নদী- সব কিছু জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে শুধু ফাঁকা মদের বোতল আর খাবারের অবশিষ্ট। যে কীর্তি আসলে পর্যটকদের। সরু রাস্তা জুড়ে দিনরাত বাইকারোহীদের যাতায়াতও যথেষ্ট বিরক্তিকর তাঁদের জন্য। তার উপর গাড়ির ভিড়, সব কিছু মিলিয়ে জীবনযাপন যেন অসহ্য হয়ে উঠছে গ্রামবাসীদের পক্ষে।

আরও পড়ুন: চিপকো আন্দোলনের নারীরা আজও পরিবেশ আন্দোলনের মুখ

তাই একদিন চরম পদক্ষেপটি করেই ফেলেছেন গ্রামবাসী। গ্রামের অন্তে পুঁতে দিয়েছেন তাঁরা একটি সাইনবোর্ড। যেখানে 'অতিথি দেবঃ ভব'-এর মন্ত্র নয়, বরং পর্যটকদের কে না-আসার অনুরোধ করা হচ্ছে। গ্রামবাসীদের সাফ বক্তব্য, তাঁরা আদপেও পর্যটনের বিরুদ্ধে নয়। তবে তাতে যদি গ্রামের সৌন্দর্যের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়, তাহলে কোনও মতেই রাজি নন তাঁরা। অমন সুন্দর ঝর্না, নীল রঙেরে পাহাড়, সবুজ বনের হাতছানিকে এতই সহজে বিকিয়ে দেওয়া যায় নাকি! তার জন্যই কোমর বেঁধে দাঁড়িয়েছেন গ্রামবাসী। যাতে তাঁদের সুন্দর গ্রামের সৌন্দর্যকে কেউ স্পর্শ না করতে পারে।

More Articles