কুস্তির পর রাজনীতির ময়দানে! মহিলারা ভোট দেবেন ভিনেশ ফোগাটকে?
Vinesh Phogat Haryana Election 2024: তপশিলি জাতির অনেকে মহিলাই বলছেন, তারা কংগ্রেসকে ভোট দেবেন কারণ একজন মহিলা হিসাবে ভিনেশ তাঁদের সমস্যাগুলি বুঝতে পারবেন
অলিম্পিকে তাঁর সঙ্গে যা ঘটেছে তা ক্রীড়াজগতের ইতিহাসে ভুলতে না-পারা অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে। সমস্ত চেষ্টা করেও পদকজয় সম্ভব হয়নি, অথবা বলা ভালো সম্ভব হতে দেওয়া হয়নি। দেশের একটা বড় অংশের মানুষ মনে করেছেন মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্থা নিয়ে বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাতেই এই পরিণতি ভিনেশের। অলিম্পিকের পর্ব, হৃদয়ভঙ্গের পর্ব মিটতেই কংগ্রেসে যোগদান করেন ভিনেশ। জুলানা আসন থেকে ভিনেশ ফোগাট লড়ছেন নির্বাচনে। আর এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি মহিলাদেরই পাশে পাচ্ছেন তিনি।
এমন দৃশ্যটি হরিয়ানার সাধারণ দৃশ্য নয়। এই রাজ্যে পুরুষের প্রাধান্যই বেশি, রাস্তাঘাটে মহিলাদের খুব কমই দেখা যায়। অন্তত দল বেঁধে মহিলাদের তো দেখাই যায় না। অথচ ভিনেশ ফোগাটের প্রচারে জুলানার হাট-বাজারে মেয়েদের উপচে পড়া ভিড়। রাস্তা দিয়ে যখন হাঁটছেন তিনি, প্রতিটি দোকানে গিয়ে দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলছেন, তাঁর পিছনে সার দিয়ে রয়েছেন মহিলাদের বিশাল দল। হরিয়ানার রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন সংহতি দেখা যায়নি আগে।
হরিয়ানার জিন্দ জেলার একটি ছোট শহর জুলানা। আজ অবধি কখনও কোনও মহিলা বিধায়ক হননি এই আসনে এমনকী বিধানসভা নির্বাচনে কোনও মহিলা দ্বিতীয় অবধি হননি। এবারের বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন ভিনেশ ফোগাট। ভারতের শীর্ষস্থানীয় কুস্তিগীরদের অন্যতম ভিনেশ ফোগাট গত বছর বিজেপির সাংসদ ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন নিগ্রহ নিয়ে বিক্ষোভের প্রথম সারির মুখ ছিলেন। তখন ভারতের রেসলিং ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন ব্রিজ ভূষণ। গত অগাস্টে প্যারিস গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ফাইনালে উঠেছিলেন ভিনেশ কিন্তু তাঁর বিভাগে অনুমোদিত ওজনের চেয়ে ১০০ গ্রাম বেশি হওয়ার কারণে তাঁকে প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়া হয়। প্রবল চেষ্টা করেও রাতারাতি ওজন কমাতে পারেননি ভিনেশ। এই চরম হতাশা কাটিয়ে দেশে ফিরে কংগ্রেসে যোগ দেন ভিনেশ। তাঁর প্রার্থী হওয়ার পর হরিয়ানার জুলানার নির্বাচনে এখন চোখ রয়েছে সারা দেশের।
আরও পড়ুন- মাত্র ১০০ গ্রাম ওজন বেশি! এক রাতেই কীভাবে অলিম্পিক বক্সিংয়ে অযোগ্য হলেন ভিনেশ?
এই নির্বাচন ভিনেশের জন্য একেবারেই মসৃণ নয়। একজন ক্রীড়াবিদ হিসেবে ভিনেশ ফোগাটের জনপ্রিয়তা কতটা এবং যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ ও পরিণামের পর কতখানি মানুষের কাছে (হরিয়ানার বিশেষ করে) তিনি 'আইডল' হয়ে উঠতে পেরেছেন তা স্পষ্ট নয় এখনও। এই জুলানা আসন কংগ্রেসের জন্যও কঠিন। এই আসনে জাত-পাতের রাজনীতিই কথা বলে।
জুলানার নির্বাচনে ভিনেশ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল লোকদলের সুরেন্দর লাথার এবং বিজেপির যোগেশ বৈরাগীর বিরুদ্ধে লড়ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, মহিলাদের ভোট কি ভিনেশের সঙ্গে আছে? জুলানার মহিলা ভোটারদের মধ্যে ভিনেশ ফোগাটের প্রতি ব্যাপক সমর্থন রয়েছে তা হলফ করেই বলা যায়। মহিলাদের একটা অংশের বিশ্বাস, একজন মহিলা বিধায়কই মহিলাদের দাবি দাওয়ার কথা আরও ভালোভাবে তুলে ধরতে পারবেন সরকারের কাছে।
তপশিলি জাতির অনেকে মহিলাই বলছেন, তারা কংগ্রেসকে ভোট দেবেন কারণ একজন মহিলা হিসাবে ভিনেশ তাঁদের সমস্যাগুলি বুঝতে পারবেন এবং ভিনেশের কাছেও মহিলারা দেখা করে খোলাখুলি কথা বলতে পারবেন। পুরুষ বিধায়ক হলে এখনও তাঁর সঙ্গে কথা বলতে সমস্যাই হয় এখানকার মেয়েদের। তারা এও জানিয়েছেন, "আমরা একজন পুরুষের সঙ্গে কথা বললে আমাদের স্বামীরা রাগ করবে কিন্তু তিনি মহিলা হলে কেউ আমাদের বাধা দেবে না।"
এই এলাকার বয়স্করাও বলছেন, জুলানায় বিধানসভা নির্বাচনে কোনও মহিলা প্রার্থী হয়েছেন এমন কথা মনেও পড়ে না তাঁদের। তাই ভিনেশকে নিয়ে সেখানে সমস্ত মহিলারাই খুব উত্সাহী। একজন মহিলাকে রাজনীতিতে দেখতে চান তারা।
নতুন প্রজন্মের মহিলা ভোটারদের অনেকে বলছেন, ভিনেশ একজন কুস্তিগীর হিসেবে তাঁদের অনুপ্রেরণা ছিলেনই। তিনি যদি জিতে ক্রীড়ামন্ত্রী হন তাহলে রাজ্যের ক্রীড়াবিদরা অনেকটা সুবিধা পাবেন, মনে করছেন মহিলারা। কারণ একজন মহিলা হিসেবে এই দেশে যে যে সমস্যা ভোগ করতে হয় ভিনেশ নিজে তার ভুক্তভোগী। ব্রিজভূষণ শরণ সিং-এর বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই মনে রেখেছেন মহিলারা।
আজীবন কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছেন, এমন ভোটার নন যারা তাঁদের কাছেও ভিনেশ ফোগাট জনপ্রিয়। অনেকেই, যারা গত নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন তারা এবার ভিনেশকে ভোট দেবেন বলছেন। হরিয়ানা জন সেবক পার্টি কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও আনুষ্ঠানিক জোট করেনি। তবে ভিনেশ ফোগাটকে সমর্থন করার জন্য জুলানা থেকে নিজেদের প্রার্থীকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে এই দল।
জুলানায় ভিনেশের অন্য আরেক পরিচয়ও রয়েছে। 'জুলানা কি বহু' হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। ভিনেশের স্বামী সোমবীর রাঠী জুলানা তহসিলের বখতা খেরা গ্রামের বাসিন্দা। তাই নিজেদের গ্রামের পুত্রবধূকে জেতাতে চাইছেন মানুষ, জুলানার সম্মানের সঙ্গে বিষয়টিকে এক করে দেখছেন তারা। হেনস্থার প্রতিবাদ করায় দিল্লির রাস্তায় কেন দেশের গর্ব একজন কুস্তিগীরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হল, এই প্রশ্ন তুলছেন জুলানার মানুষ। বলছেন, এই ঘটনা আসলে তাঁদের অপমান। কারণ ভিনেশ ফোগাট শুধু জুলানার পুত্রবধূ নন, সারা দেশের কন্যা, গর্ব। আসলে এই মানুষরা কংগ্রেসের ভোটার নন, তারা ভিনেশের ভোটার।
আরও পড়ুন- শিরদাঁড়া ছিল, তাই ষড়যন্ত্র করেই বাদ দেওয়া হলো ভিনেশে ফোগাটকে?
এই মুহূর্তে জুলানার বিধায়ক অমরজিৎ ধান্দা জননায়ক জনতা পার্টির নেতা। বিজেপির সঙ্গে জোট গঠন করে জাঠদের স্বার্থের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ফলস্বরূপ, জননায়ক জনতা পার্টি হরিয়ানার বেশিরভাগ জাঠ নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। বিজেপি এবার এখানে খুব একটা ভালো ফল করতে পারেনি। লোকসভা নির্বাচনে, জীবিকা ও মুদ্রাস্ফীতি সংক্রান্ত অসন্তোষের কারণে বিজেপি রাজ্যের দশটি আসনের অর্ধেক হেরে যায় কংগ্রেসের কাছে।
কেন্দ্রের অগ্নিপথ প্রকল্প ছিল এই ক্ষোভের অন্যতম কারণ। সশস্ত্র বাহিনীতে হরিয়ানার যুবকদের বড় অংশ চাকরি করতে ভালোবাসেন। অগ্নিপথ প্রকল্পের অধীনে, সশস্ত্র বাহিনী এখন স্থায়ী মেয়াদের পরিবর্তে চার বছরের চুক্তিতে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার পদমর্যাদার নীচের সৈন্যদের নিয়োগ করবে। মাত্র এক-চতুর্থাংশ সৈন্যকে স্থায়ী করা হবে। তাই যুবকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ছিলই। বিজেপির বিরুদ্ধে আরেকটি সাধারণ অভিযোগ ছিল 'লাঠিমার সরকার' হওয়ার।