হিজবুল্লাহকে চাপে রাখতেই লেবাননে স্থল আক্রমণ! ইজরায়েলে পাল্টা পরমাণু হামলার ফন্দি আঁটছে ইরান?

Israel-Hezbollah Conflict: কিছুদিন আগেই লেবাননে স্থল আক্রমণের কথা জানিয়েছিল ইজরায়েলি সেনা। মঙ্গলবার থেকেই সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোনো শুরু করেছে তারা।

লেবাননে গত কয়েক দিনে লাগাতার হামলার ঝাঁঝ বাড়িয়েছে ইজরায়েল। গত ২৭ সেপ্টেম্বর লেবাননের রাজধানী বেইরুটের দক্ষিণে দাহিয়া এলাকায় হিজবুল্লাহের সদর দফতরে হামলা চালায় ইজরায়েল। যে হামলায় মৃত্যু হয়েছে হিজবুল্লাহ-প্রধান নাসরাল্লাহের। তার পরেও থামেনি ইজরায়েলের আগ্রাসন। কিছুদিন আগেই লেবাননে স্থল আক্রমণের কথা জানিয়েছিল ইজরায়েলি সেনা। মঙ্গলবার থেকেই সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোনো শুরু করেছে তারা। মঙ্গলবার থেকেই দক্ষিণ লেবাননে স্থল অনুপ্রবেশ শুরু করেছে ইজরায়েলি সেনা।

গাজার বিরুদ্ধে ইজরায়েলের যুদ্ধ ঘোষণার পর থেকেই উত্তর ইজরায়েলে একের পর এক রকেট ছোড়া শুরু করে হিজবুল্লাহরা। সম্প্রতি লেবাননে পেজার হামলাকে শুরু করে ইজরায়েল-হিজবুল্লাহ শত্রুতা নতুন মাত্রা পায়। ২০০৬ সালে হিজবুল্লাহ-ইজরায়েলের যুদ্ধের পর এই প্রথম বার স্থল আক্রমণের পথে হাঁটল ইজরায়েল। কার্যত হিজবুল্লাহের উপর চাপ বাড়ানোই এই অভিযানের প্রধান লক্ষ্য।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, মঙ্গলবার লেবাননে স্থল আক্রমণের ঘোষণার আগেই ইজরায়েলি সেনা লেবানন সীমান্ত সংক্রান্ত এলাকায় হিজবুল্লাহের সুড়ঙ্গে ঢোকা শুরু করেছে। হিজবুল্লাহের শক্ত ঘাঁটি দাহিয়েহ শহরের বাসিন্দাদের নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যেই ইজরায়েলি সেনার তরফে। আর তার পরেই একের পর এক বিমানহামলা শুরু হয় বেইরুটে। ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র আভিচায় আদ্রাই মঙ্গলবার বিবৃতি জারি করে জানিয়েছেন, লেবাননের উত্তর থেকে লিতানি নদীর দক্ষিণে অঞ্চলে বাসিন্দারা যাতে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে কোনও রকম যানবাহনে ভ্রমণ না করেন।

আরও পড়ুন: ইজরায়েলের হামলায় নিহত নাসরাল্লাহ, এবার হিজবুল্লাহর দায়িত্ব সামলাবেন কে?

লেবানন-ইজরায়েল সীমান্তের প্রায় ২০ মাইল উত্তরে এই লিতানি নদীই সীমান্ত অঞ্চলটিকে লেবাননের বাকি অংশ থেকে আলাদা করেছে। ২০২৩ সালে গাজায় ইজরায়েলের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইজরায়েলি সেনা হিজবুল্লাহকে লিতানি নদীর উত্তর থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে । তবে হিজবুল্লাাহের তরফে জানানো হয়, গাজায় যুদ্ধবিরতি না হওয়া পর্যন্ত তারা লিতানি নদীর দক্ষিণ থেকে তাঁদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করবে না।

সোমবার রাতেও ইজরায়েলি যুদ্ধবিমান দক্ষিণ লেবাননে এক ডজনেরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়। বেইরুটের দাহিয়েতেও চলে একের পর এক হামলা। যে হামলায় হিজবুল্লাহের আর এক শীর্ষ কম্যান্ডারের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। সোমবারের হামলায় অন্তত ৯৫ জনের মৃত্যুর খবর মেলে লেবাননে। তার পরেই মঙ্গলবার সকাল থেকে লেবাননের স্থল আক্রমণের প্রস্তুতি ইজরায়েলের। কার্যত লেবাননে হিজবুল্লাহের অবস্থানকে টলিয়ে দিতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখছে না ইজরায়েল, তা বলাই যায়।

২০০৬ সালে ইজরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহের ৩৪ দিনের সংঘাত চলাকালীন শেষবার লেবাননে স্থল আক্রমণ করেছিল ইজরায়েল। তবে সেই প্রথম নয়। ১৯৮২ সালে যে ইজরায়েলের সঙ্গে যে সংঘাত হিজবুল্লাহের জন্ম দিয়েছিল, লেবানন ভূখণ্ডের বেকা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ইরানের সমর্থনে গড়ে উঠেছিল হিজবুল্লাহ নামক একটি গোষ্ঠী। বিশ্বের বহু দেশের কাছে এই দলটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে পরিচিত হলেও, লেবাননে ভোটে অংশ নেয় হিজবুল্লাহরা। ফলে ওদের কাছে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল এই হিজবুল্লাহ।  ১৯৮২ সালে সেই সময় লেবাননে প্রবেশ করেছিল ইজরায়েলি ট্যাঙ্ক। তার পর ২০০৬ সালের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ, আর তার পর এই ২০২৪ সাল। আপাতত সেই ২০০৬ সালের শিক্ষা থেকেই ইজরায়েলকে প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিয়েছে লেবানন।

মাটির ১০০ ফুটেরও বেশি গভীরে কংক্রিটের বাঙ্কারে গা ঢাকা দেওয়ার পরে ইজরায়েলি হামলা থেকে বাঁচেননি হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরাল্লাহে। তাঁর মৃত্যুর পর তড়িঘড়ি লেবাননের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীর অন্যতম শীর্ষনেতা নঈম কাশেমকে হিজবুল্লাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। হিজ়বুল্লার কর্মসমিতির প্রধান হিসাবে হাশেম সংগঠনের তরফে রাজনৈতিক বিষয়গুলি দেখতেন তিনি। গত তিন দশক ধরে শিক্ষা, অর্থনীতি-সহ সংগঠনের অসামরিক কার্যকলাপও দেখাশোনা করেছেন হাশেম। এখন তার হাতেই হিজবুল্লাহের দায়ভার।

শুধু লেবাননই নয়। একই সঙ্গে সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসেও হামলা চালিয়েছে ইজরায়েলি সেনা। সেখানকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সানা সূত্রের খবর, মঙ্গলবার ইজরায়েলি বিমান হামলায় তিন সাধারণ নাগরিকের মৃত্য়ু হয়েছে। জখম অন্তত ৯। কিছুদিন আগেই হিজবুল্লাহের উপর হামলার প্রতিবাদে ইজরায়েলে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া শুরু করে ইয়েমেনি জঙ্গি গোষ্ঠী হাউথিরা। তার পর ইয়েমেনেও হামলা চালানো শুরু করেছে ইজরায়েল। সূত্রের খবর, রাস ইসা, হোদেইদাহ বন্দরের বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সমুদ্র বন্দর লক্ষ্য করে বিমানহামলা চালায় ইজরায়েলি সেনা। সেই হামলায় একজন বন্দরকর্মী ও তিন জন বৈদ্যুতিক কর্মী-সহ মোট চারজনের মৃত্যু হয়।

এদিকে লেবাননের এক ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে ইজরায়েলের সাম্প্রতিক হামলায় স্ত্রী, পরিবার-সহ এক হামাস নেতার মৃত্যু হয়ছে। পাশাপাশি গাজাতেও আগ্রাসন জারি রেখেছে ইজরায়েল। মঙ্গলবার গাজায় ইসরায়েলের নতুন করে হামলায় অন্তত ২১ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। ইসরায়েল খোদ জানিয়েছে, তারা হামাসের কেন্দ্রগুলিকে নিশানা করে হামলা অব্যহত রেখেছে। সাম্প্রতিত এই হামলায় নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

আরও পড়ুন: হিজবুল্লাহ খুনের বদলা নিতেই তেল আভিভে আক্রমণ হাউথির? কোন পথে এগোবে এখন ইজরায়েল?

মনে রাখতে হবে, হিজবুল্লাহ, হামাস ও হাউথি, এই তিনটি জঙ্গিগোষ্ঠীকেই প্রত্যক্ষ ভাবে মদত জুগিয়ে চলে ইরান। ফলে যে ভাবে লেবাননে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়িয়েছে ইজরায়েল, তাতে ছেড়ে কথা বলতে রাজি নয় ইরানও। মধ্যপ্রাচ্যে যে ভাবে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে, এবং যে ভাবে উদ্দেশ্যপ্রণদিত ভাবে হিজবুল্লাহ প্রধান নাসরুল্লাহকে হত্যা করেছে ইজরায়েল, তাতে ক্ষুব্ধ ইরান। ইরানের কট্টরপন্থীরা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেই কড়া নিন্দা করেন এই হামলায়। সূত্রের খবর, কট্টরপন্থী ইরানি নেতারা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের কার্ড ব্যবহার করারও পরামর্শ দিয়েছে। যদিও উল্লেখ্য, এর মধ্যেই লেবাননে নতুন করে সেনা পাঠিয়ে হিজবুল্লাহকে সাহায্য় করতে অস্বীকার করেছে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনেই। তবে পারমাণবিক হামলার কথা যে ভাবে নানা মহল থেকে উঠতে শুরু করেছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নানা মহল। তবে এরই মধ্যে ইরানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে আমারিকার প্রধান মিত্রশক্তি আমেরিকা। তারা জানিয়ে গিয়েছে, ইজরায়েলের উপর ইরান সরাসরি হামলা চালালে তার ফলাফল হবে ভয়াবহ।

সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। একদিকে স্থল আক্রমণের পরে লেবাননে হামলার তীব্রতা ক্রমশ বাড়াচ্ছে ইজরায়েল। শোনা যাচ্ছে, হিজবুল্লাহ জঙ্গিদের সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে আইডিএফের। একদিকে ইরানের পারমাণবিক হামলার ভাবনাচিন্তা, অন্যদিকে, ইরানকে আমেরিকার কড়া হুঁশিয়ারি। এদিকে সার্বিক যুদ্ধপরিস্থিতি নিয়ে ক্রেমলিনের উদ্বেগ। রাশিয়া যে গোড়া থেকেই ইরানের দিকেই ঝুঁকে, তা সকলেরই জানা। এই পরিস্থিতিতে কী হতে চলেছে এই ভয়াবহ যুদ্ধের পরিণাম, তা চিন্তা করে উদ্বেগে গোটা বিশ্বই।

More Articles