উপমুখ্যমন্ত্রিত্বে স্তালিন-পুত্রই, ভারতীয় রাজনীতিতে কতটা গভীরে পরিবারতন্ত্রের শিকড়?
Familism in Indian politics: মোদির তৃতীয় বারের মন্ত্রিসভাতেও 'পরিবারতন্ত্রে'র প্রভাব নিয়ে জোর বিতর্ক হয়েছিল। সেখানে পরিচিত নেতানেত্রীদের পুত্র-কন্যা, পুত্রবধূদের জায়গা করে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে 'পরিবারতন্ত্র'। সেই পরম্পরাই বজায় রাখল দেশের দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ু। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন তাঁর ছেলে উদয়নিধিকেই রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী করলেন। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এমকে করুণানিধিও নিজের ছেলে এমকে স্ট্যালিনকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়েছিলেন। সম্প্রতি সেনথিল বালাজি-কেও স্থান দিয়েছেন স্ট্যালিন। তবে শেষপর্যন্ত উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর নিজের ছেলেকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই উদয়নিধির উত্থানের ইঙ্গিত ছিল। বছরের শুরুতেই সেই সংক্রান্ত ঘোষণার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ছেলে উদয়নিধির 'সনাতন ধর্ম' মন্তব্য ঘিরে বিতর্কের আবহে পিছিয়ে দেওয়া হয় সেই সিদ্ধান্ত। ২০২২ সালেই স্ট্যালিন মন্ত্রীসভার সদস্য হন উদয়নিধি। রাজ্যের ক্রীড়া এবং উন্নয়ন দফতরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সে সময়।
অন্যদিকে, মোদির মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও পরিবারের রাজনৈতিক যোগসূত্র রয়েছে। মোদির তৃতীয় বারের মন্ত্রিসভাতেও 'পরিবারতন্ত্রে'র প্রভাব নিয়ে জোর বিতর্ক হয়েছিল। মন্ত্রিসভায় পরিচিত নেতানেত্রীদের পুত্র-কন্যা, পুত্রবধূদের জায়গা করে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। মন্ত্রীসভার ৭২ জন সদস্যদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশেরই পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচিতি রয়েছে। এই সদস্যদের মধ্যে অন্য দল থেকে আসা মন্ত্রীরাও রয়েছেন। কয়েক জন পূর্বতন ইউপিএ সরকারের সময়েও মন্ত্রী ছিলেন। বিজেপিও কি তবে সেই পরিবারতন্ত্রেরই উদাহরণ বয়ে চলেছে অন্দরে?
আরও পড়ুন: মোদি-মন্ত্রিসভার সিলমোহর, ‘এক দেশ এক ভোট’ চালু করতে কেন এত মরিয়া বিজেপি সরকার?
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ছেলে তথা বিসিআই সচিব জয় শাহকে ICC-তে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয় অর্থ এবং বাণিজ্য কমিটির প্রধান হিসেবেও নির্বাচিত করা হয়। তিনি BCCI-এর প্রতিনিধি, ICC-র ফিনান্স ও কমার্শিয়াল অ্যাফেয়ার কমিটির প্রধান হন। এটি ICC-র প্রধান কমিটি। এর মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশে অর্থপ্রদান, সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় থাকে। এর আগে এই কমিটির সদস্য ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রাক্তন সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। প্রশ্ন উঠেছিল, যাঁর নাম কোনওদিন ক্রিকেটের ময়দানে শোনা যায়নি, তিনি কীভাবে ভারতীয় ক্রিকেটের এত উচুঁ পদে জায়গা করে নিলেন?
মন্ত্রীসভার 'পরিবারতন্ত্র'-এর তালিকায় রয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁর বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর। তাঁর বাবা মঞ্জুলাকৃষ্ণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তালিকায় রয়েছেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়ার পুত্র তথা জেডিএস নেতা কুমারস্বামী। তিনি একটা সময় কংগ্রেসের সমর্থনে কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। আরও রয়েছেন প্রয়াত প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মাধবরাও সিন্ধিয়ার পুত্র জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, প্রয়াত প্রাক্তন কংগ্রেস সহ-সভাপতি জিতেন্দ্র প্রসাদের পুত্র জিতিন। মনমোহন সিং সরকারের মন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ সিংও নয়া মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন। তিনি আবার হরিয়ানার প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রাও বীরেন্দ্র সিং-এর পুত্র।
মোদির তৃতীয় বারের মন্ত্রিসভার সদস্য কিরেণ রিজিজুর-র বাবা ছিলেন অরুণাচল প্রদেশের নেতা তথা বিধায়ক। আবার মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন বিজেপি মন্ত্রী তথা বর্তমান এনসিপি নেতা একনাথ শিন্ডের পুত্রবধূ রক্ষা খড়সে। ইউপিএ এবং এনডিএ দুই সরকারেই মন্ত্রী ছিলেন প্রয়াত রামবিলাস পাসোয়ান। তাঁর ছেলে চিরাগ পাসোয়ান জায়গা করে নিয়েছেন মোদি মন্ত্রিসভাতেও। বিজেপির সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জেপি নাড্ডার শাশুড়ি মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা প্রাক্তন সাংসদ জয়শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়।
কংগ্রেস আমলের প্রধানমন্ত্রী চরণ সিং, মোদির মন্ত্রিসভার সদস্য জয়ন্ত চৌধরির ঠাকুরদা। আবার জয়ন্তের পিতা অজিত সিং, প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। বিহারের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী কাপুরী ঠাকুরের ছেলে মোদি সরকারের জেভিইউ-র প্রতিনিধি রামনাথ ঠাকুর। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বেদপ্রকাশ গয়ালের ছেলে পীযূষ গয়াল। আরেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবেন্দ্র প্রধানের ছেলে ধর্মেন্দ্র প্রধান মোদির মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়েছেন।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধি ‘খামখেয়ালি টুরিস্ট রাজনৈতিক’! কতখানি সত্যি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দাবি?
মোদি মন্ত্রিসভার নতুন মুখ কীর্তি বর্ধন সিং। তাঁর বাবা আনন্দ সিং উত্তরপ্রদেশ সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন। নতুনদের মধ্যে বীরেন্দ্র কুমার খটিকের বাবা গৌরীশঙ্করও মধ্যপ্রদেশ সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সভার 'পরিবারতন্ত্র'-র তালিকায় রয়েছেন আরজেডির বিধায়ক রমেশপ্রসাদ যাদবের স্ত্রী ঝাড়খণ্ডের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী। উত্তরপ্রদেশের কুর্মি সমাজের নেতা তথা আপনা দল (এস)-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত সোনেলাল পটেলের মেয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুপ্রিয়া পটেল। পঞ্জাবের প্রাক্তন কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী বিয়ন্ত সিং-এর নাতি রভনীত সিং বিট্টু।
গত একদশক বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার শক্তিশালী সরকার ছিল। ২০২৪ নির্বাচনের আগে মুখে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা বললেও তা পায়নি মোদি সরকার। ফলে এবারের সরকার অনেকটাই জোট নির্ভর। ভোটের প্রচারে বিজেপি নেতারা লাগাতার পরিবারতন্ত্র নিয়ে বিরোধীদের খোঁচা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই, ভারতের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রবল সমালোচক। প্রশ্ন ওঠে, বিজেপি নিজেই কি তবে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম প্রমাণ করতে ব্যর্থ হল?