কর্পোরেট চাকরি যেন মৃত্যুফাঁদ! অন্য দেশের তুলনায় কেন এত বিষাক্ত ভারতের চাকরির বাজার?

Corporate Work Culture: ভারতীয়রা প্রতি সপ্তাহে জার্মানির একজন কর্মচারীর চেয়ে ১৩ ঘণ্টা বেশি কাজ করেন।

দিনে মোটামুটি ৮ ঘণ্টার ঘুম দরকার, বিজ্ঞানীরা বলেছেন। দিনে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে একদিন মানুষ আন্দোলন করেছিল। ৮ ঘণ্টার ঘুম আর ৮ ঘণ্টার কাজ, দুইই এখন ইতিহাস! গড় ভারতীয়দের ক্ষেত্রে, কাজের সপ্তাহ এখন আগের চেয়ে ঢের দীর্ঘ, মোট প্রায় ৪৭ ঘণ্টা। সাম্প্রতিক শ্রমবিষক তথ্য অনুসারে, এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিশ্রমী শ্রমশক্তি রয়েছে ভারতেই। অর্থাৎ ভারতেই মানুষ সবচেয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে কাজ করেন। ভারতে মোট কাজের সময়কাল চিন, সিঙ্গাপুর এবং জাপান, যে দেশটি চেয়েও বেশি নিরলস কর্মসংস্কৃতির জন্য বিখ্যাত, তাদের থেকেও ভারতীয়রা বেশি কাজ করেন বা করতে বাধ্য হন। গড়ে, ভারতীয়রা প্রতি সপ্তাহে জার্মানির একজন কর্মচারীর চেয়ে ১৩ ঘণ্টা বেশি কাজ করেন।

ভারতে যারা কর্মরত তাদের প্রায় ৯০% অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত। অর্থাৎ এখানে কাজের ধরন অনিয়ন্ত্রিত এবং শোষণমূলক। এই অসংগঠিত কাজের অবস্থা সম্পর্কেও ধীরে ধীরে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে ভারতের কর্পোরেট সেক্টরে, যেখানে কাজের ধরন বিগত কয়েক দশক ধরেই অনেকাংশে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। এই ক্ষেত্রগুলিতে মুনাফাই একমাত্র অভীষ্ট।

আরও পড়ুন- আবার কাজের চাপে যুবতীর মৃত্যু! কীভাবে এত বিষিয়ে গেল ভারতে চাকরির পরিবেশ? 

গত জুলাই মাসে, কর্পোরেট অ্যাকাউন্টিং জায়ান্ট আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর ইন্ডিয়া অফিসের ২৬ বছরের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আনা সেবাস্তিয়ান পেরাইল মারা যান। কাজে যোগ দেওয়ার ঠিক চার মাস পরেই এক তরুণীর মৃত্যু ঘটল! আনার মা লিখেছিলেন, প্রবল কাজের চাপ সামলাতে পারেনি মেয়ে। প্রতিদিন চাপ বাড়তে বাড়তে অবশেষে শরীর জবাব দিয়ে দিয়েছিল। অকালেই মারা যান আনা। আনার মা একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, "ও গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করেছে, এমনকী সপ্তাহান্তেও! নিঃশ্বাস ফেলার কোনও সুযোগ পেত না। নিরলস চাহিদা এবং অবাস্তব প্রত্যাশা পূরণের চাপ কোনও কাজের কথা নয়। এই পরিবেশ আমাদের এত সম্ভাবনাময় একজন তরুণীর জীবন কেড়ে নিল।" আনার মা আরও জানিয়েছিলেন, কোম্পানির কেউ তাঁর মেয়ের শেষকৃত্যেও যোগ দেননি।

আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর কর্মচারীরা অবশ্য অনেকেই বলেছেন, এমন বিষাক্ত কর্মসংস্কৃতি নতুন নয় এই সংস্থায়। খুব শীর্ষস্তর থেকেই এমন প্রবল চাপ তৈরি করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মী 'দ্য গার্ডিয়ান'-কে বলেছিলেন, "জীবন বেশ নৃশংস এবং প্রত্যেকেই অতিরিক্ত চাপে রয়েছে।" তিনি জানিয়েছেন, প্রতিদিন ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা কাজ করাকে এখানে আদর্শ হিসাবে তুলে ধরা হয়। সকাল থেকে শুরু করে অন্তত রাত ১০টা অবধি কাজ করা এবং সপ্তাহান্তে দুই দিনই নিয়মিত কাজ করাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়।

কর্মীদের দমিয়ে রাখা এসব সংস্থার কাছে খুব সাধারণ বিষয় ছিল। কর্মচারীদের মানুষ নয়, যন্ত্র হিসেবেই দেখা হয়। তিনি বলেছেন, "চরম শ্রেণিবিন্যাস আছে। সিনিয়র ম্যানেজাররা সকলকে ক্রমাগত পায়ের তলায় রাখতে জুনিয়রদের ভয় দেখান। সিনিয়ররা কেবল চিৎকার করবেন, ফাইল ছুঁড়ে দেবেন এবং চারপাশের লোকজন কান্নায় ভেঙে পড়বে, এটাই চলে আসছে।"

আরও পড়ুন-বিখ্যাত সংস্থায় মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপে যুবতীর মৃত্যু! কেন তদন্তে নামল কেন্দ্র?

ভারতে এই সংস্থাগুলিতে চাপ আর প্রতিযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে। তরুণ ভারতীয়রা, যারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, অ্যাকাউন্টিংয়ের মতো কাজের যোগ্যতা অর্জন করছেন, এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অথচ কর্পোরেট সেক্টরে শূন্যপদের চাহিদা মেটেনি। স্নাতক পড়ুয়াদের মাত্র ৪০% কাজে নিযুক্ত। আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর মতো সংস্থাগুলিতে চাকরি পেতে মরিয়া থাকেন অনেকেই। একটি পদের জন্য কয়েক হাজার আবেদনকারী আবেদন করেন। আর এই বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলি জানে, যদি একজন কেউ কাজ করতে না পারেন, হাজার হাজার অন্য লোক বসে রয়েছেন যারা তাদের জায়গা নেবেন, হয়তো কম মাইনেতেই নেবেন! এই সংস্থাগুলির একমাত্র লক্ষ্য, উত্পাদনশীলতা বাড়ানো আর দীর্ঘ সময় কাজ করা। কর্মীদের সুস্থতার জন্য কোনও চিন্তা এখানে কখনই করা হয়নি।

আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর ভারতের প্রধান, রাজীব মেমানি আনার মৃত্যুর পরে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, কাজের বেশি চাপের অভিযোগগুলি তাঁদের সংস্থার সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। "আমাদের এখানে কর্মীদের কল্যাণকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়," লিখেছিলেন রাজীব।

অত্যধিক চাহিদা আর অত্যধিক চাপ তো শুধুমাত্র ভারতের বড় অ্যাকাউন্টিং সংস্থাগুলিতেই ঘটছে তা নয়। ভারতের বৃহত্তম আইটি সংস্থা ইনফোসিসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি গত বছরই বলেছিলেন, দেশের বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে ভারতীয়দের সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

আরও পড়ুন- টার্গেট পূরণের প্রবল চাপ! স্ত্রী-সন্তানদের তালাবন্ধ করে চরম সিদ্ধান্ত বাজাজ ফিন্যান্স কর্মীর

আইটি কোম্পানিগুলিও একইরকম বিষাক্ত কাজের পরিবেশই তৈরি করেছে দেশে। কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে কথা বলা বা সামাজিক মেলামেশার অনুমতিও থাকে না। কে কখন কী জন্য বিরতি নিচ্ছে তাও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। বেতন নির্বিচারে কেটে নেওয়া হয়। কর্মীদের প্রতিটি আচরণ সংস্থার নজরে। কারণ এই আইটি-র মাথারা জানেন, কর্মীদের শোষণ করাই যায় কারণ সবাই এই ধরনের চাকরি পাওয়ার জন্য মরিয়া, তারা বছরের পর বছর এমন চাকরির জন্যই অপেক্ষা করে। তাই কর্মীরা সব জেনেও চুপ। তাঁদের নিবিড় শোষণ হচ্ছে জেনেও, শ্রম আইন ভঙ্গ হচ্ছে জেনেও, শরীর-মন শেষ হয়ে যাচ্ছে জেনেও তারা অভিযোগ করেন না। ভয়ে!

মিডিয়া, বিনোদন এমন ক্ষেত্রের কর্মচারীরাও জানিয়েছেন, সমস্যাটি সেখানেও একই। কর্পোরেট ইভেন্টে দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ করাকে স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হয়। রবিবার রাত ১১টায় কাজ দিয়ে সোমবার সকালের মধ্যে জমা দিতে বলাকে এখানে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া হয়। এই সংস্থাগুলি ভয়াবহ এক অফিস রাজনীতিকে তোল্লাই দেয়। সংস্থার মাথারা মনে করেন, কর্মীদের যদি বারবার চাকরি 'খেয়ে নেওয়ার' ভয় দেখানো হয়, হুমকি দেখানো হয় তাহলেই তা আখেরে ব্যবসার জন্য ভালো! এই ভয়ে কর্মীরা আরও বেশি পরিশ্রম করবে, তাতে লাভ বাড়বে! তাতে কর্মীরা ঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া করতে পারুক চাই নাই পারুক, তাঁদের ঘুম হোক বা না হোক, বুকে ব্যথা হোক বা না হোক, চোখ ঝাপসা হয়ে যাক বা না যাক, পরিবারকে দেখার সময় থাকুক বা না থাকুক, নিজের দেহ ক্রমেই অবসন্ন, মৃত্যুমুখী হয়ে যাক না কেন, 'বস'রা নিঃস্পৃহ! ভারতে চাকরি নেই, তাই যা আছে তা ধরে রাখতে কর্মীদের সঙ্গে পাশবিক ব্যবহার করাই ভারতের কর্পোরেট সংস্থার মূল মন্ত্র।

More Articles