রেডিওর সুরে এক হয়ে যায় আজও ফরাসি আর বাঙালিরা?

Radio in France: রেডিও থেকে ভাষা শেখা যায়। ফরাসি শেখার সময় আমাদের শিক্ষকরা বলতেন সারাদিন রেডিও শুনতে।

ছোট থেকে কলেজ জীবন অবধি শুনলাম, বাঙালি আর ফরাসির নাকি অনেক মিল। তাদের ভাষা সুললিত, তারা কাব্যি করে। রাজনীতি আর বিপ্লব, তাও করে একইরকম। চায়ের দোকানে বসে। সিগারেট খায় মুঠোমুঠো। নারীস্বাধীনতা নিয়ে ইদানিং কথা বেশি বলে না কারণ এই দু-জাতির কাছেই নাকি নারী পুরুষ সমান! শেষ পাতে মিষ্টিমুখ না হলে হয় না। রান্না নিয়ে তাদের অনেক বক্তব্য। সবকিছু নিয়েই এদের নানা মুনির নানা মত। পরে দেখলাম, দুই তরফেই একইরকম উন্নাসিকতা, স্বগর্বে ডুবে থেকে পৃথিবী থেকে মুখ ফেরায়, আবার লুকিয়ে খানিক অন্যদের মতো হতেও চায়। আজীবন যা কিছু দেখেছি, শুনেছি, ফরাসি মাটিতে বাঙালি হৃদয় নিয়ে তা যাচাই করে দেখার লোভ সামলানো গেল না।সেখান থেকেই এই ধারাবাহিকের সূত্রপাত।

রেডিও

হেমন্তের উৎসবে বাঙালির প্রথম উদযাপন রেডিও। হয়তো সারাবছর কুরুশের কাপড়ে ঢাকা থাকে শো-পিস হিসেবে। আশ্বিনের শারদপ্রাতে তার একদিনের কেরামতি। রানির মতো মধ্যমণি হয়ে বসে সবার মাঝে। তাকে ঘিরে বাড়ির ঘুম জড়ানো চোখগুলি, হাতে চায়ের কাপ। দেখা যাচ্ছে না কিছুই কিন্তু আকাশবাণীর আলোয় সবাই দেখতে পাচ্ছে আগমনীর ভোর। আলোর অমল কমলখানি ফুটছে হালকা হয়ে আসা স্থলপদ্ম আকাশে।

মহালয়ার আগের দিন পাড়ার দোকানগুলোতে ব্যাটারি কেনার ব্যস্ততা চলত। আমাদের বাড়িতে নিয়মিত রেডিও চলে। সকালের চায়ের সঙ্গে জানালার পাশে রাখা আদ্দিকালের ঘড়ঘড়ে আওয়াজ। জানালার পাশে না রাখলে, সে চলে না। অন্য ঘরে মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম হলে আওয়াজ হারিয়ে যায়। তখন ঘরের দরজা টেনে তাকে একটু নির্জনতা দিলে সে আবার ঠিকঠাক চলতে থাকে। আমাদের রেডিওটা বাড়ির সদস্য, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে। সে জানলার ধারে বসে কথা বলতে ভালোবাসে। অদৃশ্য যান্ত্রিক তরঙ্গে তার কষ্ট হয়, সে নিজের তরঙ্গ খুঁজে বাঁচে। নিত্যদিনের ব্যবহার সত্ত্বেও আমার বাড়িতে মহালয়ার আগের দিন রেডিওর ব্যাটারি বদলানো হয়। আক্ষরিক কারণ, যদি মহিষাসুরমর্দিনী চলতে চলতে ব্যাটারি শেষ হয়ে যায়! আমার মনে হতো, নতুন ব্যাটারি রেডিওর জন্য কেনা পুজোর নতুন জামা।

আরও পড়ুন- অঞ্জনের প্রিয় বন্ধু: শিকড়হীন আর শিকড়গাঁথাদের সংলাপ

ছোটবেলায় সবারই কল্পনিক বন্ধু থাকে। আমার কল্পনিক বন্ধুগুলি রেডিও থেকে উঠে আসত। কারও নাম পছন্দ হলে ভেবে নিতাম সে আমার বন্ধু, তার বাড়ি ওই ছোটদের আসরে। শৈশবের এমনই আত্মীয়তা রেডিওর সঙ্গে। বছর দুয়েক আগে বড়দিনের ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম আমাদের বন্ধু মাতিলদ আর রেমির বাড়িতে। ওদের ছোট মেয়ে আগাথের বয়স তখন ৭। নিজের দুনিয়ায় থাকে, মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে গল্প করে। গভীর সেসব গল্প। যে কোনও ফরাসির মতোই, ছোট্ট আগাথের সব বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত রয়েছে। মতামত প্রকাশ করতে সে কুণ্ঠিত নয়, দারুণ সব শব্দ ব্যবহার করে কঠিন বাক্যগঠনে সে কথা বলে। আগাথের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হলো নিরামিষাশি বা ভেগান হওয়ার রাজনীতি নিয়ে। তিরিশোর্ধ্ব আমি আগাথের থেকে অনেক কিছু শিখে তার বাবা-মাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, এত কিছু জানল কোথা থেকে, ওর মা জানাল, ও সারাদিন রেডিও শোনে।

দেখলাম, আগাথের হাতে একটা সবুজ রঙের ছোট্ট রেডিও। নিজে টিউনার ঘুরিয়ে চ্যানেল ঠিক করতে সে পারে না। ফ্রান্সে ছোটদের জন্য এক ধরনের রেডিও পাওয়া যায়। গড়নে বড়দের রেডিওর মতো। ভিতরে রেকর্ড করা কিছু প্রোগ্রাম রয়েছে। গান বাজনা রয়েছে। আর কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের ওপর শিশুদের বয়সোপযোগী কিছু আলোচনা। আগাথ সারাদিন তার রেডিও কানে ঘুরে বেড়ায়। বাঙালি শিশুরা রেডিও থেকে কতটুকু শিখছে, মনে মনে প্রশ্ন করি।

ফ্রান্সে ছোটদের জন্য প্রি-রেকর্ডেড রেডিও মার্লিন

বিশ শতকে ফরাসি সংস্কৃতিতে রেডিওকে বলা হতো গেরস্থের হৃদস্পন্দন। বাড়ির সকলে মিলে রেডিও ঘিরে বসে খবর শোনা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শোনা ছিল দৈনন্দিনের ছবি। বাঙালির কাছে রেডিও যেন খানিক নিভৃতের আশ্রয়। আমার ঠাকুরদা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে রেডিওতে খবর শুনতেন, তখন যদিও বাড়িতে টিভি এসে গেছে। দাদুকে দেখতাম, রেডিও পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন, তাতে বাজছে শ্যামাসঙ্গীত। রেডিও ঘিরে বাঙালির পারিবারিক উদযাপন আমার স্মৃতিতে নেই। কেবল, মহালয়ার ভোরবেলা ছাড়া। যদিও পাড়ার মোড়ে রেডিও হাতে ক্রিকেট ফুটবলের ধারাবিবরণী শুনছেন এক দল মানুষ, এমন সামাজিক উদযাপনের সাক্ষী থেকেছি বহুবার। মফসসলে রেডিওর আওয়াজ অন্যরকম ছিল। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে যখন ভোরবেলা উঠে পড়তে বসতাম, কোনও এক বাড়ি থেকে ভেসে আসত আকাশবাণী শুরুর মন্তাজ। এমন এক গায়ে কাঁটা দেওয়া সুর, মফসসলের হিমপড়া ভোরে যার আওয়াজের তুলনা এ জগতে আর কখনও পাইনি।

রেডিও থেকে ভাষা শেখা যায়। ফরাসি শেখার সময় আমাদের শিক্ষকরা বলতেন সারাদিন রেডিও শুনতে। সেইসব প্রোগ্রাম নিয়ে রচনা লিখতে হতো। কখনও ফরাসি ইতিহাস, কখনও ফ্রান্সে বেড়ানো, ফরাসি খাবার ইত্যাদি নানা বিষয়ে আমরা শুনতাম। ভাষার চলন শিখতাম, বাক্যগঠন শিখতাম। এখনও শিখি রেডিও থেকে। গানের অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের কথা বলার কায়দা থেকে টুকে রাখি সুন্দর সুন্দর বাক্য। আগাথ যেমন রেডিও শুনে বড়দের মতো ফরাসি বলা রপ্ত করছে, আমিও রেডিও শুনে ফরাসিদের মতো ফরাসি বলতে শিখছি। ভাষা তো কেবল শব্দসংখ্যা আর ব্যাকরণে গঠিত নয়। নেটিভ স্পিকারদের ভাষার কায়দা অন্যরকম। সেইসব শেখা যায় রেডিও থেকে। বিবিসি শুনেও যেমন অনেক ইংরেজি কায়দাকানুন রপ্ত করেছিলাম এক সময়। বছর দুয়েক আগে যখন কলকাতায় গেলাম, গাড়িতে রেডিওতে শুনছি সঞ্চালক তার শ্রোতাদের 'তুমি' বলে সম্বোধন করছেন। একটি গোটা বাক্যও পুরো বাংলায় বলছেন না। বাক্যগঠনে ইংরেজি-হিন্দির ছাপ। ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখলাম সম্পূর্ণ অচেনা এক কর্মী আমার সিনিয়র সিটিজেন বাবাকে 'কাকু-তুমি' বলে ব্যাঙ্কের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। রেডিও-জকি যে ভাষায় কথা বলছিলেন, ব্যাঙ্ককর্মীর বাক্যগঠনে একই ছাপ। এতেও কোনও দোষ নেই, কিন্তু খটকা লাগল। আমি তো এভাবে বাংলা শিখিনি? এ নিয়ে নতুন করে আলোচনা করার কিছু নেই। ভাষা বদলায় নিজের নিয়মে, তা ঠিক। কিন্তু কতটুকু বদল ঘটলে বাংলা আর বাংলাই থাকবে, না হলে অন্য ভাষা হয়ে যাবে, তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। আজ যদি বিদেশি কেউ বাংলা শিখতে চায়, আমার মাতৃভাষার কারিকুরি ও সৌন্দর্য শেখানোর জন্য আমি অন্তত তাকে বাংলা রেডিও শুনতে বলব না।

সারা পৃথিবীতে রেডিও শ্রোতার সংখ্যা কমছে। ইউরোপে যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধোত্তর সময়ে রেডিও নিয়ে যে মাতামাতি চলত তার রেশটুকুও নেই। আমার বন্ধুবান্ধবরা রেডিও শোনে না, পডকাস্টে রেডিওর অনুষ্ঠান এবং আলোচনা শোনে, কারণ, নিজের সময়মতো শুনে নেওয়া যায়। সম্প্রচারের নির্দিষ্ট সময়ের অপেক্ষা করতে হয় না। স্বাভাবিক, কারণ আমরা সবাই ছুটছি। সময়ের নিয়মে আমরা চলি না, আমাদের নিয়মে সময় চলে। যার ফলে, রেডিও স্টেশনগুলিও নিজেদের বদলে নিয়েছে, তাদের প্রোগ্রাম সম্প্রচারের পর পডকাস্ট হিসেবে প্রকাশ পায়। তবে, অনুষ্ঠানের গঠন একই রয়েছে! মনোরঞ্জন থেকে শুরু করে জাতীয় এবং বিশ্ব রাজনীতি, সবটাই চলে এবং মানুষ শোনে। সেই কারণে এ দেশে উবারে উঠলে চালকের সঙ্গে এভোলিউশনারি বায়োলজি বা সাইকোলজি নিয়ে আলোচনা চলে, দেখা যায়, আধুনিক গবেষণার কিছু কিছু গল্প তারাও জানেন। রেডিও শুনে।

আরও পড়ুন- আজও মহালয়ার ভোর মানেই রেডিও! আকাশবাণী থেকে এফএম, অব্যাহত নস্টালজিয়া

অন্যান্য অনেক দেশের মতোই ফ্রান্সেও এখন কেবল লং-ড্রাইভে রেডিও শোনে গোটা পরিবার। ফরাসি স্যালনে সন্ধেবেলায় চোখে পড়ে না সকলে রেডিও ঘিরে বসেছে। যদিও ব্রেকিং-নিউজ বা সংকট, যেমন মহাদেশে দু'টি যুদ্ধ চলছে, সেই বিষয়ে খবরের জন্য এখনও রেডিওর ওপর ভরসা করে ফরাসি শ্রোতা। সাপ্তাহিক হিসেবে এখনও চার লক্ষ মানুষ নিয়মিত রেডিও শোনে এদেশে। ভারতে বা বাংলায় এই সংখ্যাটা কত আমার জানা নেই। তবে ফরাসি গ্রামেগঞ্জে রেডিওমুখী মানুষের সংখ্যা শহরের তুলনায় অনেক বেশি। উপরন্তু, এদেশে প্রান্তিক মানুষদের জন্য বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র ব্যবস্থা রেডিও। যার বাড়িতে টিভি নেই, যার হাতে স্মার্টফোন নেই, যার টিভি রাখার মতো কোনও বাড়িই নেই, এমন লোকের সংখ্যা এদেশে অনেক। হলিউডের ছবির মতো, বিদেশ মানেই সবাই সুখী, সবাই প্রিভিলেজড নয়। অফিস যাওয়ার পথে ফুটপাথে একটা পরিবারের পাশ দিয়ে রোজ হেঁটে যাই। ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে এরা উঠে এসেছিল, এখনও ফুটপাতেই থাকে। এক একদিন শুনতে পাই, ওদের হাতের রেডিও থেকে ভেসে আসছে যুদ্ধের খবর। সব সম্পদ ছেড়ে আসার সময় রেডিওটা ঠিক নিয়ে এসেছিল ওরা!

আমার বাড়ির নিচে মস্ত বাজার। কোণার ঘুপচি কফিশপের বাইরে এক বৃদ্ধ বসে থাকেন লাল চেয়ারে। পাশে টেবিলে রাখা কাচের গ্লাসে কড়া কালো কফি, আর বাঁ হাতে তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে পাকানো সিগারেটে আগুন। ডান হাতে কানে ধরা রেডিও। চোখ বুজে, বাজারের কোলাহল কাটিয়ে মন দিয়ে শুনছেন আঞ্চলিক ভাষায় তার দেশের খবর। আলজেরিয়ার খবর। উদ্বাস্তু প্রবাসী সম্প্রদায়গুলির কাছে জন্মভূমি বা মাতৃভাষার সঙ্গে একমাত্র যোগসূত্র এখনও রেডিওই।

More Articles