ভারতে আবার ভাইরাসের হানা! কীভাবে সংক্রমণ, কতটা ক্ষতিকর?

ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসের সংক্রমণ সহজেই প্রতিরোধ করা যায় বেশ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে। প্রথমেই তার জন্য মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

কতটা ক্ষতিকর ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস? প্রতিকার কী? মে মাসের শেষেই ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসে (West Nile Virus) আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন কেরলের এক সাতচল্লিশ বছর বয়সি মহিলা। তবে ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসের ঘটনা ভারতে প্রথম নয়। ২০১৯ সালেও কেরলের মল্লপুরমে ছয় বছর বয়সি এক বালক ঠিক এই ভাইরাসেই আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল।

ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসের জেনেটিক মেটেরিয়াল হিসেবে থাকে আর.এন.এ. (RNA) বা রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (Ribonucleic Acid)। ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের (World Health organization) সূত্রে জানা গেছে, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস, ফ্ল্যাভিভাইরাস (Flavivirus) প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত।

আফ্রিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আমেরিকা-সহ পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাসের দেখা মেলে।

আরও পড়ুন: এবার ওষুধেই সারবে ক্যানসার! ঐতিহাসিক আবিষ্কারের পিছনে কারা?

কীভাবে ছড়ায় ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস?
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজে়শনের (WHO) সূত্রে জানা যাচ্ছে, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস একটি মশা-বাহিত রোগ। ওয়েস্ট নাইলে আক্রান্ত মশা যখন মানুষকে কামড়ায়, তখনই এই ভাইরাস আমাদের শরীরে বাসা বাঁধে। WHO-র তরফ থেকে জানানো হচ্ছে, সাধারণত কিউলেক্স মশা থেকেই এই ভাইরাস ছড়ায়।

তবে ওয়েস্ট নাইলের সংক্রমণ চক্রে, প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত হয় পাখিরা বা অন্য কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী (যেমন, ঘোড়া)। সেই পাখিদের বা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মশা কামড়ালে, ভাইরাসটি জমা হয় মশাদের লালাগ্রন্থিতে। ফলে মশার কামড়ের ফলে খুব সহজেই সেই ভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করে।

মশার পাশাপাশি এই ভাইরাসে আক্রান্ত অন্য প্রাণীদের রক্ত বা কোশের সংস্পর্শেও ছড়াতে পারে এই ভাইরাস। সেন্টার ফর ড্রাগ কন্ট্রোল ও প্রিভেনশন (Centre for Drug Control and Prevention) বা সিডিসির (CDC) তরফে জানানো হচ্ছে, আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের মাধ্যমে বা সন্তানসম্ভবা মহিলারা সংক্রমিত হলে তাঁর থেকে শিশুর শরীরে সংক্রমিত হতে পারে এই ভাইরাস। এই ভাইরাসে আক্রান্ত মহিলা শিশুকে স্তন‍্যপান করানোর সময় শিশুটির আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রবল।

তবে স্পর্শের কারণে সংক্রমিত ব্যক্তির থেকে সুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা শোনা যায়নি আজ অবধি, জানা যাচ্ছে WHO-র সূত্রেই।

সংক্রমণের লক্ষণ কী?
আশি শতাংশ ক্ষেত্রে ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সেই ব্যক্তির শরীরে কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। অর্থাৎ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তি অ্যাসিম্পটোম্যাটিক থাকেন।

তবে কুড়ি শতাংশ ক্ষেত্রে, আক্রান্ত ব্যক্তি ওয়েস্ট নাইল ফিভারে আক্রান্ত হন। সঙ্গে দেখা যায় গায়ে ব্যথা, মাথা যন্ত্রণা, গাঁটে-গাঁটে ব্যথা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, ডায়েরিয়া, গায়ে ফুসকুড়ি বেরনোর মতো লক্ষণ। জ্বর-সমেত এই লক্ষণগুলি দেখা গেলে, এই অসুখকে ফিব্রাইল ইলনেস বলে। তাই ওয়েস্ট নাইলের ফলে দেখা যেতে পারে অ্যাকিউট ফিব্রাইল ইলনেস।

বেশ কিছু ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ খুব ভয়াবহ হতে পারে। পঞ্চাশ জনের মধ্যে অন্তত এক জনের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটে থাকে। যদিও যে কোনও বয়সের মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তবে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে শারীরিক অবস্থা সংকটজনক অবস্থায় পৌঁছনোর আশঙ্কা বেশি। রোগ খুব ভায়াবহ রূপ নিলে প্যারালাইসিস, এনসেফালাইটিস, মেনিনজাইটিস, হাত-পা কাঁপা (Tremor), খিঁচুনি (Convulsion), শারীরিক অসড়তা (Numbness), দৃষ্টিশক্তি হারানো, চিন্তাভাবনার ক্ষমতা লোপ পাওয়ার মতো ঘটনা দেখা যায়। দশ জনের মধ্যে এক জন ব্যক্তির ক্ষেত্রে, ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ফলে স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

এখানে উল্লেখ্য, এনসেফালাইটিসে (Encephalitis) মস্তিষ্কে প্রদাহ হয়। অন্যদিকে, মেনিনজাইটিসে (meningitis) মস্তিষ্ক এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রর আবরণ, অর্থাৎ, মেনিনজেসে (Meninges) প্রদাহ (Inflammation) হয়।

সেন্টার ফর ড্রাগ কন্ট্রোল ও প্রিভেনশন (Centre for Drug Control and Prevention) বা সিডিসি-র (CDC) তরফে জানানো হচ্ছে, যে সমস্ত রোগীর বিশেষ কিছু শারীরিক অবস্থা, যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, কিডনির অসুখ, বা ক্যানসারের মতো রোগ রয়েছে, পাশাপাশি যাদের শরীরের কোনও অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও খুব সাবধান থাকা জরুরি।

কীভাবে বুঝবেন এই ভাইরাসে আক্রান্ত?
ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসে আক্রান্ত হলে এলাইজা টেস্ট এবং আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে তা শনাক্ত করা যায়।

কী চিকিৎসা?
ওয়েস্ট নাইলের ফলে জ্বর এবং গায়ে, হাতে, পায়ে ব্যথা বা গাঁটে ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। তবে শারীরিক অবস্থা সংকটজনক হলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীতে নিকটবর্তী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া জরুরি। সেক্ষেত্রে ইন্টারভেনাস ফ্লুইড (যেমন, স্যালাইন), ব্যথার ওষুধ দিয়ে রোগের প্রতিকার সম্ভব। এই ভাইরাসের ফলে ডায়েরিয়া এবং বমি হলে, ওআরএস, পর্যাপ্ত পরিমাণ জল এবং ফলের রস খাওয়া উচিত। তবে প্রয়োজনে ইন্টারভেনাস ফ্লুইডের প্রয়োজন হতে পারে।

কী করে প্রতিরোধ করবেন সংক্রমণ?
ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসের সংক্রমণ সহজেই প্রতিরোধ করা যায় বেশ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে। প্রথমেই তার জন্য মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মশা ডিম পাড়তে পারে, এমন জায়গাগুলোকে জলমুক্ত রাখা অত্যাবশ্যক। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, মশারির ব্যবহার করা, মশা-অধ্যুষিত জায়গা এড়িয়ে চলা বা প্রয়োজনে সেই জায়গায় যেতে হলে শরীর ভালোভাবে ঢেকে রাখবে এমন পোশাক পরা জরুরি।

মশার উৎপাত নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি, প্রাণীদের থেকেও সংক্রমণের পথ বন্ধ করা উচিত। অসুস্থ প্রাণীদের চিকিৎসা করার সময়ে বা ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রাণীদের কাটার সময়ে খেয়াল রাখতে হবে প্রাণীদের রক্ত যাতে শরীরে প্রবেশ না করতে পারে। সেই সময় গ্লাভস পরে প্রাণীদের ছোঁয়াই শ্রেয়। 

রক্তদান বা অঙ্গদানের সময়ে চিকিৎসকদের খেয়াল রাখতে হবে, রক্ত বা অঙ্গদাতা এই ভাইরাসে আক্রান্ত কি না। সেক্ষেত্রে রক্তদান বা অঙ্গদান থেকে বিরত থাকা উচিত।

 

More Articles