গর্তেশ্বরী থেকে লোটাদেবীর মন্দির, যে ইতিহাস ছড়িয়ে তরাইয়ের আনাচে কানাচে
Temples of Jalpaiguri: তরাইয়ের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন লোকায়ত মন্দির। এইসব মন্দির গুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিচিত্র সব ইতিহাস।
জলপাইগুড়ি জেলার এক দীর্ঘ অংশ বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন। এই অঞ্চলে দেশভাগ নিয়ে যেমন গভীর ক্ষত রয়েছে, আবার তেমনই তরাইয়ের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন লোকায়ত মন্দির। এইসব মন্দির গুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিচিত্র সব ইতিহাস। আসুন, এক ঝলক নজর রাখি তেমন পাঁচটি মন্দিরে─
ধাপচণ্ডী
জলপাইগুড়ি শহর থেকে হলদিবাড়ি যাওয়ার রাস্তায় পড়ে ধাপগঞ্জ। রাস্তার দু'পাশে বাজার। এ'খানকার মিষ্টি বেশ বিখ্যাত। এই অঞ্চলেই বিরাজমান ধাপচণ্ডী। রাস্তা থেকে ধাপে ধাপে উঁচু ঢিপির উপরে উঠতে হয় বলেই হয়তো এই নামকরণ। এই দেবী চণ্ডীর প্রতীক একটি কষ্টিপাথর। শিবমন্দির ও কালীমন্দিরও রয়েছে পাশে। রথযাত্রাও পালিত হয় এ'খানে। চারুচন্দ্র সান্যাল লিখেছেন, “শোনা যায়, হুসেন শাহ যখন বৈকুণ্ঠপুর আক্রমণ করেন ধাপচণ্ডীর মন্দিরটি তখন মুসলমান সেনাদের হাতে ধ্বংস হয়েছিল।"
গর্তেশ্বরী পীঠ
জলপাইগুড়ি-হলদিবাড়ি-মানিকগঞ্জ-সাতকুরা হয়ে পৌঁছবেন গর্তেশ্বরী মন্দিরে। জলপাইগুড়ি শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪০ কিমি। সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার, মন্দির সংলগ্ন জমির ১৬.৫ বর্গমাইল বাংলাদেশ। যাকে বলে অ্যাডভার্স ল্যান্ড। কিন্তু মন্দিরটি ভারতেই। র্যাডক্লিফের রেখা তাকে ছুঁতে পারেনি। অনেকের বিশ্বাস মায়ের মন্দিরের জন্যেই দক্ষিণ বেরুবাড়ির অধিবাসীরা আজও সুরক্ষিত। এর তিনদিকে বাংলাদেশ। কিন্তু কে এই গর্ভেশ্বরী বা গর্তেশ্বরী দেবী? বৈকুণ্ঠপুর রাজ এস্টেটের নথিপত্র ঘেঁটে গবেষক উমেশ শর্মা দেখিয়েছেন, যে সেখানে এই দেবীর নাম গর্ভেশ্বরী। আবার দীর্ঘদিন মাটিচাপা অবস্থায় ছিল বিগ্রহটি। তাই এঁর আরেক নাম গর্তেশ্বরী। বলা হয়, দেবীর বামপদ এখানে পতিত হয়েছিল। তাই এ'টি সিদ্ধপীঠ। কষ্টিপাথরের চতুর্ভূজা দেবী বিগ্রহ। লম্বোদর গজাননের বাঁ কাঁধে দেবী বাম পা রেখেছেন। গনেশ একটি পদ্মের উপর দাঁড়িয়ে। হাতে গদাদি আয়ুধ। গনেশের পায়ের কাছে কালী ও যক্ষিণী মূর্তি।
আরও পড়ুন: বোদাগঞ্জ থেকে মেটেলি, ডুয়ার্স ভ্রমণে যে ঐতিহাসিক মন্দিরগুলি দেখতেই হবে
জুড়াবান্ধা ঠাকুর
মোহিতনগর রেল ঘুমটি থেকে মন্থনীগামী রাস্তায় পড়ে চেচাপাড়া। এ'খানেই রয়েছে জুড়াবান্ধা ঠাকুরের মন্দির। মন্দিরের বিগ্রহটি মহাদেবের। একটি হাত বরাভয়ের মুদ্রায় উত্তলিত। সংলগ্ন বটগাছে অনেকেই মনস্কামনা পূর্ণ করার জন্য ঢেলা বেঁধে রাখেন। স্থানীয় ভাষায় এই ঢেলাকেই জুড়া বলা হয়। তাই ঠাকুরের নাম জুড়াবান্ধা ঠাকুর। এই মূর্তিটির সঙ্গে দীর্ঘ ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। পাশের নদীটির নাম মুখে মুখে জুড়াপানি। একটু এগোলেই জুড়াবান্ধা হাট। আলিপুরদুয়ারের এবং কোচবিহারের মাসান ঠাকুরের ছাপ বিগ্রহটিতে লক্ষ করা যায়।
গৌরীহাটের মদনমোহন ঠাকুর
গোড়ীহাটের পুবদিকে বিরাট এলাকা জুড়ে রয়েছে মদনমোহন মন্দিরটি। কোচবিহার ঘরানায় শঙ্করদেবের বৈষ্ণবধর্ম মতে বৈকুণ্ঠপুরেও রাধাহীন কৃষ্ণভজনা শুরু হয়েছিল। এই বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বৈকুণ্ঠপুর এস্টেটের প্রসন্নদেব রায়কত। রাজবাড়ির নঠি বলছে, গৌরীহাটের প্রাচীন নাম রানিগঞ্জের হাট। পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে করলা। করলা এখানে উত্তরস্রোতা। এই জল গঙ্গাজল হিসেবেও সমাদৃত। ১৯০০ সালে রানিগঞ্জ হাটের উত্তরাস্রোত থেকে তীর্থবারি সংগ্রহ করা হয়েছিল। জলপালিয়া গোষ্ঠী সেই কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই জলপালিয়া গোষ্ঠী থেকেই অঞ্চলটির নাম হয় জলপাইগুড়ি।
লোটাদেবীর মন্দির
আসাম মোড় ও মোহিতনগরের উপকণ্ঠে করলাপারে লোটাদেবীর মন্দির। মুখে মুখে প্রচলিত, দেশভাগের আগে কোনও ভক্ত যদি লোটাদেবীর মন্দিরে পুজো দিয়ে বিবাহাদি অনুষ্ঠানের বাসনকোসনের জন্য মায়ের কাছে মানত করতেন, তবে প্রদিন নাকি লোটাদিঘির পাড়ে সত্যি বাসন কোসন পাওয়া যেত। কাজের শেষে সে সব বাসন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সন্ধেবেলা মায়ের থানে রেখে দিলে তা আবার দিঘির তলায় তলিয়ে যেত। এখনও ফাল্গুন মাসে লোটাদেবীর মন্দিরে পুজো হয়, মানত চলে। মেলায় প্রচণ্ড ভিড় হয় এইসময়।