ভূতের থেকেও ভয়ঙ্কর, হাইওয়ের বিভীষিকা রেমন্ড থিওডোরের হাড় হিম করা কাহিনি
Highway Terror Green Man: গ্রিন ম্যান বা চার্লি নো ফেস, মুখবিহীন এক ভূতের ভয়াল কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে। পেনসিলভেনিয়ার রাস্তায় রাতের বেলায় দেখা যেত এই অশরীরীকে।
বিভিন্ন উৎস থেকে কিংবদন্তীর জন্ম হতে পারে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম হয়তো কোনও গল্প চালু রয়েছে মুখে মুখে। পাড়ার প্রাচীন বটগাছটার পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে কারও ঠাকুরদার ঠাকুরদা হয়তো একটি লম্বা ছায়া দেখেন। সেই গল্প লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। একসময় দেখা গেল বটগাছটিই অভিশপ্ত হয়ে গিয়েছে। লোকে তার পাশ দিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছেন। আবার কখনও নির্ভেজাল সত্য ঘটনাও কিংবদন্তী হয়ে ওঠে। আজ আপনাদের জন্য রইল তেমনই নির্ভেজাল এক কাহিনি। গ্রিন ম্যান বা চার্লি নো ফেস, মুখবিহীন এক ভূতের ভয়াল কাহিনি ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে। পেনসিলভেনিয়ার রাস্তায় রাতের বেলায় নাকি দেখা যেত এই অশরীরীকে। কিন্তু এই ভূতুড়ে জনশ্রুতির নেপথ্যে রয়েছে এক হাড় হিম করা ইতিহাস।
আরও পড়ুন: রাতে যে অভিশপ্ত রাস্তারা জেগে ওঠে, ভারতের কুখ্যাত হাইওয়েগুলির হাড় হিম করা কাহিনি
গত শতকের শুরু। আমেরিকার বিভার কাউন্টি তখন শান্ত উপদ্রবহীন। সে'খানে রেমন্ড থিওডোর রবিনসন নামে এক কিশোর বাস করত। রেমন্ডের যখন বছর সাতেক বয়েস, তখন তাঁর বাবা মারা যান। ফলে শাসনের কড়াকড়ি ছিল না। সারাদিন এ'দিক ও'দিক ঘুরে বেড়াত ছেলেটি। নদীতে সাঁতার দিতে দিতে কেটে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। জঙ্গলে বন্ধুবান্ধবদের খেলাধুলো করত সে। দিনটা ১৯১৯ সালের ১৮ জুন। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সাঁতার কাটছিল রেমন্ড। এমন সময় তাদের নজরে পড়ে যে তারা ওয়ালেস রান ব্রিজের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। সেতুটির ওপর দিয়ে স্থানীয় শহরের নিত্যনৈমিত্তিক ট্রলি যাতায়াত করত। এই ট্রলিগুলি ১২০০ ভোল্ট ডিসি শক্তিতে চলত। ফলে গোটা ব্রিজটিতেই তড়িৎপৃষ্ট হওয়ার আশঙ্কা ছিল মারাত্মক। অথচ বাচ্চাদের কাছে এই ব্রিজটি ছিল প্রবল আকর্ষণের জায়গা। রেমন্ড ও তার বন্ধুরা জানত, বছর খানেক আগেই রবার্ট লিটল নামে এক কিশোর তড়িৎপৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছে সেতুটিতে। কিন্তু সে'দিকে তাদের ভ্রূক্ষেপ ছিল না। দলটি ক্রমেই ব্রিজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
একসময় বাচ্চাদের দলটি ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছয়। এই সময় ব্রিজের গায়ে একটি বড় পাখির বাসা নজরে পড়ে তাদের। প্রথমটায় কেউ ভয়ে যেতে চায় না। তখন রেমন্ড রাজি হয়। কতগুলো পাখি আছে দেখে এসে বলবে সে বন্ধুদের। অনেকখানি চড়েও গিয়েছিল ব্রিজের উপর। আর একটু উঠলেই পাখির বাসা। এমন সময় হঠাৎ, কোনও ভাবে বিজলি তার ছুঁইয়ে ফেলে সে। ওই চড়া মাত্রার তড়িৎ বয়ে যায় রেমন্ডের শরীর বেয়ে। শরীরটা একটু একটু করে পুড়ে যেতে থাকে।
আরও পড়ুন: চতুর্দিকে ‘প্রেতে’র ভিড়! রোম খাড়া হয়ে যায় ভারতের ১৪ দিনের এই ভূতমেলায়
আশঙ্কাজনক অবস্থায় পোড়া শরীরটা যখন হাসপাতালে আনা হয়, ডাক্তাররা বলেই দেন, একে বাঁচানো যাবে না। 'দ্য বিভার ফলস' নামে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে খবর হয়েছিল, যেভাবে পুড়ে গিয়েছে রেমন্ড, তাতে বাঁচার আশা নেই। শিরোনামে লেখা ছিল, “খোলা তারে তড়িতাহত মোরাডোর একটি বছর আটেকের ছেলে, ছেলেটি মারা যাবে"। শিরোনাম নিষ্ঠুর সন্দেহ নেই। কিন্তু সে'সময় প্রায় সবাই এই কথাই ভাবছিলেন। মুখ, শরীর সমস্ত পুড়ে গিয়েছিল রেমন্ডের। প্রভিডেন্স হাসপাতালে দিন রাত চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্চিলেন ডাক্তার-নার্সেরা। কিন্তু আশ্চর্য প্রাণশক্তি! ক'দিনের মাথায় ধীরে ধীরে সেরে ওঠার লক্ষণ দেখা দিল। মাসখানেকের মাথায় পরিষ্কার হয়ে গেল, এত সহজে হার মানবে না রেমন্ড। ভরসা ফিরে পেলেন ডাক্তাররাও। এবার তাঁরা ভাবছিলেন সেরে ওঠার পর কেমন দেখতে লাগবে রেমন্ডকে।
পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল রেমন্ড। মুখ যেন গলে গিয়েছিল। চোখ কান নাক মুখ বলে কিছু অবশিষ্ট ছিল না। বাঁ হাত কনুই থেকে বাদ গিয়েছিল। জ্বলে গিয়েছিল বুকও। কিন্তু হাল ছাড়েনি সেই কিশোর। বাঁচার প্রবল আকাঙ্ক্ষা সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে এনেছিল তাকে। এক সময় সম্পূর্ণ সেরে উঠল সে। দৃষ্টি রইল না। অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ব নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে হল। কিন্তু রেমন্ডের পরিবার সে সব গ্রাহ্য করেনি। আদর যত্নে নতুন জীবন শুরু হল রেমন্ডের। আবার আগের মতোই বাঁচতে শুরু করল সে। কিন্তু দিনে বেরোন সমস্যা। লোকে ভয় পায়, অস্বস্তিতে পড়ে। টিটকিরি দেয়। ফলে রাতে ওয়াকিং স্টিক নিয়ে বেরিয়ে পড়ত রেমন্ড। কোপেল থেকে নিউ গ্যালিলির দিকে যে হাইওয়ে গিয়েছে, তাই ধরে হাঁটাহাঁটি করত রোজ। রুট ৩৫১ নামে খ্যাত এই রাস্তায় তখন খুব বেশি লোক চলাচল ছিল না। ঠিক এমনটাই চেয়েছিল রেমন্ড। এমন এক টুকরো জায়গা যেখানে কেউ তার দিকে আলাদা করে নজর দেবে না। সবার নজরের বাইরে যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠত ছেলেটি। কিন্তু খুব বেশিদিন এই স্বস্তি রইল না।
রাতের বেলা সে রাস্তায় যাঁরা যেতেন তাঁরা আঁতকে উঠতেন। মুখে মুখে ভূতের গল্প ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তাকে দেখার জন্যই কেউ কেউ এ'রাস্তায় যাতায়াত শুরু করল। অবশ্য নিজের এলাকার কিশোরেরা তাকে খুব পছন্দ করত। এই ভক্তদের মুখে মুখেই চার্লি নো ফেস বা গ্রিন ম্যান নামটি বিখ্যাত হয়ে উঠল। এইসব কিশোরেরা রেমন্ডকে বিয়ার খাওয়াত, সিগারেট খাওয়াত। তার সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু রেমন্ডের কথা এতটাই অস্পষ্ট যে কিছু বোঝাই যেত না প্রায়। কেউ কেউ নিষ্ঠুর পরিহাস করে মজা পেত। বাকিরা জীবন্ত কিংবদন্তীর সঙ্গে আড্ডা দেওয়াটা সৌভাগ্যের ব্যাপার মনে করত। রেমন্ডকে যাঁরা দেখতে আসতেন, তাঁদের সঙ্গে অমায়িক ভাবে গল্প করত রেমন্ড, সময় কাটাত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল তাঁর কিংবদন্তী। একরকম শহুরে উপকথা হয়ে উঠল টুকরো টাকরা নানা গল্প। ভূতের গল্প হিসেবে সে'সব নেহাৎ মন্দ ছিল না। মূল ঘটনা চেপে গিয়ে অনেকে আরও নানা কাহিনি জুড়ে দিতেন। পেনসিলভেনিয়ার এই মানুষটি জীবিতাবস্থাতেই ভূত হয়ে গেল লোকের মুখে মুখে। পেনসিলভেনিয়ার বিখ্যাততম মানুষদের মধ্যে রে গণ্য হয় আজও। অবশেষে, ১৯৮৫ সালের ১১ জুন মৃত্যু হয় গ্রিন ম্যান রে রবিনসনের। কিন্তু তাকে ঘিরে থাকা সেই হাজারও গল্পেরা এখনও বেঁচে। সেই হাইওয়ে ধরে আজ গ্রিন ম্যানের গল্পদের হাঁটতে দেখা যায়। রে-কে কবর দেওয়া হয়েছিল গ্র্যান্ডভিউ সেমেটারিতে। সে'খান থেকেই নাকি ওয়ালেস ব্রিজের উপর রে নজর রাখে আজও, যেখানে তড়িতাহত হয়ে বিশ্রীরকম পুড়ে গিয়েছিল তার দেহ। যেখান থেকে এক জীবন্ত ভূতের আখ্যানের শুরু। আজও যা লোকের মুখে মুখে প্রবহমান।