প্রচারে মাত! বাস্তবে দুর্নীতি রোধ বা মহিলাদের সুরক্ষা দেওয়ার উদাহরণ কোথায় মোদির?

Narendra Modi Lok Sabah Polls: সাধারণ জার্মানবাসীও ভাবতে শুরু করেছিল, হিটলার ঈশ্বর প্রেরিত দূত। হিটলার স্থায়ী সরকার দিতে পারবেন। আমাদের দেশের অনেক মানুষই ভাবেন, প্রধানমন্ত্রীই সন্দেশখালির মহিলাদের পরিত্রাতা

বসন্ত এসে গেছে। বসন্তের অনুষঙ্গেই কোকিলের কথা স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে। কোকিল আর বসন্ত ছায়ার মতো সঙ্গে সঙ্গে চলে একে অপরের। তবে বাংলা ভাষার মজাই এমন, ‘বসন্তের কোকিল’ বললে কেবলই যে কোকিলের কথা মনে আসে তা নয়। এই শব্দবন্ধটি দিয়ে বহু মানুষকেও কী দুর্নাত বর্ণনা করা যায়! ইদানীং তেমন মানুষদের মধ্যে অন্যতম দু’জনের একজন বাংলায় পদার্পণ করে ফেলেছেন। তিনি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এখন, "বাতাসে বহিছে প্রেম/ নয়নে লাগিল নেশা/ কারা যে ডাকিল পিছে/ লোকসভা এসে গেছে।"

গত ২০২১ সালের বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে, যে কতিপয় দিল্লির নেতারা প্রায় নিত্যযাত্রীর মতো বাংলা সফর করেছিলেন, তাঁদের আবার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এবং যাবেও। অনেকেই উৎসুক হয়ে ছিলেন, নরেন্দ্র মোদি কী বলেন তা শোনার জন্য। বাংলার বিজেপির অনেকেই ভেবেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হয়তো এমন কিছু বলবেন যাতে কর্মী সমর্থকদের উৎসাহ বাড়বে কিন্তু যা বোঝা গেল, ২০২১ সালে কিংবা তার আগে তিনি বাংলাকে যেভাবে দেখতেন, যেভাবে এই রাজ্যের দুর্নীতি নিয়ে রাজনীতি করতেন, এই রাজ্যের শাসকদলের দাদাগিরির বিরুদ্ধে কথা বলতেন, তার থেকে এক ইঞ্চিও তিনি এগোননি। তিনি গতানুগতিকভাবেই বাংলার শাসকদলের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন, তিনি সন্দেশখালির ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন, কীভাবে সেখানে শেখ শাহজাহানকে আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে, তার উদাহরণ দিয়েছেন, কীভাবে সেখানে মহিলাদের উপর অত্যাচার সংগঠিত হয়েছে, সে কথাও বলেছেন। কিন্তু তিনি কেন নানা অজুহাতে বাংলার হকের উন্নয়নের টাকা আটকে রেখেছেন, তা বলেননি। স্বরাষ্ট্র দপ্তর নাগরিকত্ব আইনের নিয়ম কানুন আনবে বললেও, মতুয়া উদ্বাস্তু আদিবাসীদের নাগরিকত্ব নিয়ে একটি কথাও প্রধানমন্ত্রী বলেননি। সমস্ত কথাই অবশ্য বলা হয়েছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে পাশে বসিয়ে।

যে শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে কিছুদিন আগেই এই বিজেপি দুর্নীতির অভিযোগ করত, সেই শুভেন্দু এখন প্রধানমন্ত্রীর নয়নের মণি কী করে হয়ে উঠলেন? প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্য রাখার সময়ে কীভাবে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার মানুষদের উপরে সন্দেশখালিতে হামলা হয়েছিল, তা বলেছেন কিন্তু একবারও বলেননি কীভাবে ওই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে সামনে রেখে বেশ কিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের থেকে জোর করে ৩৩৫ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে নির্বাচনী বন্ড নামক একটি অস্বচ্ছ ব্যবস্থার মাধ্যমে। তিনি সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহানের নির্দেশে যেভাবে ইডির আধিকারিকদের উপর আক্রমণ হয়েছিল তার উদাহরণ দিয়েছেন কিন্তু একটিবারও বলেননি ছগন ভুজওয়ালের, অজিত পাওয়ার, হিমন্ত বিশ্ব শর্মাদের বা সাম্প্রতিক কালে কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অশোক চহ্বানদের বিরুদ্ধে চলা দুর্নীতির মামলাগুলো কেন স্তব্ধ হয়ে গেল? আসলে মোদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে চান না কিন্তু ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন যে তিনিই দুর্নীতি বিরোধী একমাত্র মুখ, আর মানুষও তা বিশ্বাস করে এখন।

আরও পড়ুন- নরেন্দ্র মোদি ওবিসি নন?

ফ্যাসিবাদ একজন নায়ক বানায়, পরিত্রাতা খোঁজে। ২০১৪ সালের আগে তাঁর সম্বন্ধে এমন এক আখ্যান রচনা করা হয়েছিল, মানুষের মনে এমন এক ধারণা তৈরি করা হয়েছিল যে তিনিই দুর্নীতি বিরোধী একমাত্র মুখ। তিনি কাউকে অসৎ পথে রোজগার করতেও দেন না, নিজেও করেন না। ২০১৪ সালের আগে ‘ইন্ডিয়া আগেনস্ট কোরাপশন’ মঞ্চ তৈরি করার পিছনে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদে অভিষেক করার ব্যবস্থা ছিল, তা সেদিন বোঝা না গেলেও আজ জলের মতো পরিষ্কার।

ইতিহাসে অবশ্য এই ধরনের প্রোপাগান্ডার উদাহরণ ছিলই। তবে মানুষ ভেবেছে, হয়তো নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে এই দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে, নারী নির্যাতন কমে যাবে, বেকারদের চাকরি হবে। বাস্তবে কি এই স্বপ্নগুলোর একটাও পূরণ হয়েছে? যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল তার কত শতাংশ মানুষ পেয়েছেন? সাধারণ মানুষ তো নিজের দৈনন্দিন যাপন দিয়েই বুঝতে পারছেন কতটা পেয়েছেন তাঁরা! এই যে অষ্টপ্রহর শোনা যাচ্ছে, ‘মোদি কি গ্যারান্টি’, বিকশিত ভারতের যে স্বপ্ন আবারও দেখানো হচ্ছে, তার চুলচেরা হিসেব না করলেও সাদা চোখে কি একটুও ফলাফল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে? 

ইতিহাসের নানা সন্ধিক্ষণে দেখা গেছে, মানুষ এমন একজন নেতার খোঁজ করে, যাঁর মধ্যে দিয়ে উর্বর জমি তৈরি হয় এবং দেশের মানুষের রক্ষাকর্তা হিসেবে কোনও একজন নেতার জন্ম হয়। জার্মানিতে বিশের দশকে এইরকমই একজন নেতার উত্থান আমরা দেখতে পেয়েছিলাম, অ্যাডলফ হিটলার। সেই সময়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। চারিদিকে বেকারত্ব, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। নাজিরা এই সুযোগের সদব্যবহার করে অ্যাডলফ হিটলারকে জার্মানদের উদ্ধারকর্তা হিসেবে উপস্থাপিত করার কাজটা করেন। জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে হিটলার নিজের ছবি তুলতেও রাজি ছিলেন না। পরে তাঁরই ছবি দেওয়া পোস্টকার্ড বিলোনো হয়েছিল জার্মানদের মধ্যে। সেই সময়ে হিটলারকে সামনে রেখে যেভাবে প্রচার এবং প্রজ্ঞাপন করা হয়েছিল
এবং তার মধ্যে দিয়ে যেভাবে নাৎসি পার্টি ধীরে ধীরে পুরো জার্মানিতে একেবারে সামনের সারিতে এসে গিয়েছিল, তা থেকে নিশ্চিত আজকের শাসকেরা শিক্ষা নিয়েছেন বলেই মনে হয়। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের প্রথম দিকে, নাৎসি পার্টির নির্বাচনী প্রচারের ধরন দেখলে আজকের সময়ের সঙ্গে প্রচুর সাদৃশ্য পাওয়া যাবে।

বিভিন্ন গণজমায়েতে হিটলারের বক্তব্য, রেডিওর মাধ্যমে তাঁর বাণী যেভাবে প্রচারিত হয়েছিল, তা দেখলে আজকে আমাদের দেশের শাসকদলের প্রচারের সঙ্গে হুবহু মিল পাওয়া যাবে। হিটলারকে জড়িয়ে যেভাবে একটা ‘কাল্ট’ তৈরি হয়েছিল, যেন তিনি ঈশ্বরের অবতার, সমগ্র জার্মান জাতির রক্ষাকর্তা- একইরকমভাবে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে অনেকেই ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ বা ঈশ্বরপ্রেরিত দূত ভাবেন।

আরও পড়ুন- সারা বিশ্বের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেল নরেন্দ্র মোদির নির্বুদ্ধিতা

যে কোনও ছবির খুব গুরুত্ব থাকে। সেটা হিটলার এবং তাঁর প্রচার সচিব জোসেফ গোয়েবেলস জানতেন। নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর আশেপাশে যাঁরা তাঁর
এই প্রচার দেখেন, তাঁরাও জানেন কীভাবে মূর্তির চেয়ে ভাবমূর্তি বড় করে দেখানো যায়। সেইজন্যেই গত লোকসভা নির্বাচনের আগে তিনি মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেরিয়ে, ছবি তুলিয়ে তা প্রচার করেছেন। এবার নির্বাচনের আগেও তাই করছেন। কখনও মন্দিরে, কখনও সমুদ্রের তলায় দ্বারকার হারিয়ে যাওয়া শহর খোঁজার ছবি আমাদের দেখানো হচ্ছে। এই ছবিগুলো যে সাধারণ মানুষের মাথায় গেঁথে দেওয়া যায়, তা জার্মানিতে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালে যেমন অ্যাডলফ হিটলার জানতেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীও জানেন। সেই জন্যই গরিবদের জন্য রেশনে বিনামূল্যে যে খাদ্যদ্রব্য দেওয়া হয়, তার বস্তাতে প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিতে ১৫ কোটি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে খরচ হলেও বিরোধীরা বিষয়টি নিয়ে রাস্তায় নামতে পারে না কারণ প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তির কাছে এই ছবি নগণ্য। এই ধরনের ছবির সঙ্গে যদি নরেন্দ্র মোদি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছেন বা ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ জাতীয় শব্দবন্ধ মানুষের মধ্যে ভাসিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে প্রচার একদম শেষতম মানুষটার কাছেও পৌঁছে যায়। ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল, অ্যাডলফ হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাধারণ সৈনিক হিসেবে লড়াই করার সময়ে বুঝেছিলেন, জার্মানি সেদিন শুধুমাত্র রণক্ষেত্রে পরাজিত হয়নি, প্রতিপক্ষের প্রচারের কাছেও হেরে গিয়েছিল। সেইখান থেকে শুরু করে ১৯৩২ সালে জার্মানির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তাঁর অন্যতম একজন পদপ্রার্থী হয়ে ওঠার পিছনে তাঁর সুপরিকল্পিত প্রচার ছিল।

গুজরাত গণহত্যার সময়ে সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদি। সেদিন তিনি বলেছিলেন, গুজরাত গণহত্যার সময়ে তিনি সমস্ত রকম উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিন্তু গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। সেই জন্যই তাঁর বদনাম হয়েছিল। নাৎসি প্রচারযন্ত্র এমনভাবে হিটলারের ভাবমূর্তি নির্মাণ করেছিল যে একজন
সাধারণ জার্মানবাসীও ভাবতে শুরু করেছিল, হিটলার ঈশ্বর প্রেরিত দূত। হিটলার স্থায়ী সরকার দিতে পারবেন। চাকরি দিতে না পারলেও জার্মানিকে একটা উচ্চতায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হবেন। আমাদের দেশের অনেক মানুষই একইরকমভাবে ভাবেন। ভাবেন, প্রধানমন্ত্রীই সন্দেশখালির মহিলাদের পরিত্রাতা, তিনিই স্থিতিশীল সরকার দিতে পারবেন, চাকরি দিতে না পারলেও কর্মক্ষম যুবদের জন্য ভাববেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মণিপুরের মহিলাদের নগ্ন করিয়ে হাঁটানোর কথা থাকে না, মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্থাকারীর শাস্তির কথা উচ্চারিত হয় না। গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়, সন্দেশখালির নির্যাতিতা মহিলাদের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি কথা বলেছেন। তাঁরাও দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আশান্বিত হয়েছেন। সেই কারণেই লোকসভা নির্বাচনে বাংলার আসানসোল কেন্দ্রে যখন তাঁর দলের পক্ষ থেকে পবন সিং নামে একজন নারী বিদ্বেষীকে, বিশেষ করে বাঙালি মহিলা বিদ্বেষীকে প্রার্থী করা হয়, তখন তা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। তাই রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতি স্বামী শরণানন্দ মহারাজকে দেখতে হাসপাতালের নিয়ম ভেঙে আইসিইউতে ক্যামেরাপার্সন নিয়ে প্রবেশ করলেও আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে যাই। আমরা বুঁদ হয়ে থাকি ছবিতে এবং মোদির গ্যারান্টিতে। আর সেখানেই প্রচারযন্ত্র জিতে যায়।

More Articles